বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন নিয়ে প্রথমে সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে যথেষ্ট সময় পার হয়ে যাওয়ায় এখন বিস্তারিত মত জানাতে শুরু করেছেন তারা। তাদের কেউ কেউ মনে করেন, সুনির্দিষ্টভাবে নির্বাচন হিসেবে বিবেচনা করলে বাংলাদেশে একটি ভালো নির্বাচন হয়েছে। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই তারা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিকাশ দেখতে চান। বাংলাদেশের বিরোধিরা নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে দাবি করে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং বাতিলের কথা বলছেন।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি কোনও সহানুভূতি নেই বলে পরিচিতি পাওয়া কলকাতাকেন্দ্রিক পর্যবেক্ষক চারুব্রত রায়। তিনি বলেন, নির্বাচনের দিনের সহিংসতার মাত্রা এবং ক্ষমতাসীন দলের আক্রমণাত্মক মনোভাব ছিল অবিশ্বাস্য। কিন্তু বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, এবার আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বড় একটি জয় পেয়েছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সমালোচনা ছিল বোধগম্য। সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামীলীগ কর্তৃক বিএনপিকে কোনঠাসা করার প্রবণতার কথা তুলে ধরা হয়েছে এসব সমালোচনায়। রাজনৈতিক বিরোধিদের গ্রেফতার ও প্রায় ৩ লাখ মামলার কথা কয়েকটি সংবাদমাধ্যম উল্লেখ করেছে।
বিপরীত মতও এসেছে ভারতের সংবাদমাধ্যমে। বাংলাদেশ ও ভারতের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে সহিংস ঘটনার সংখ্যা সবসময়ে বেশি হয়ে থাকে। একইভাবে এই সহিংসতায় বিভিন্নভাবে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও বেশি হয়। তারা গ্রেফতার হয়ে থাকেন, নিহত হন কিংবা আহত। এই সংখ্যা নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করতে পারে। কারণ তারা কম জনসংখ্যার ঘনত্বের পশ্চিমা দেশ থেকে আসা মানুষ। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ২০ জনের মতো মানুষের মৃত্যু নিয়ে ভারতের নেতৃবৃন্দ বা সংবাদমাধ্যমের তরফ থেকে স্বল্পমাত্রায় সমালোচনা ছাড়া বড় কোনও ক্ষোভ ছিল না।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র ভিত্তি গড়তে শুরু করার দিকে ইঙ্গিত করে এক পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থ সিং, মত দেন, এটা ঠিক যে ব্রিটিশ ধারা বা পশ্চিমের পরিচিত আদর্শের সঙ্গে মিলবে না। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা বাংলাদেশে টিকে আছে কিন্তু এতে করে সেখানে বিভক্তি বেড়েছে। সমাধান হিসেবে একটি দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি বিকল্পের চেষ্টা ২০০৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ওই সময়ে বাংলাদেশ বাস্তবিকভাবে সরকারহীন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা থাকা পশ্চিমের দিকে তাকালে দেখা যায় তাদেরটা ঠিকভাবেই কাজ করছে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। তাদের সেই মডেল দক্ষিণ এশিয়ায় কাজে আসবেই এমন কোনও কথা নেই।
বিভক্তির প্রশ্নে কলকাতাকেন্দ্রিক পর্যবেক্ষকরা সিদ্ধার্থ সিং-এর সঙ্গে একমত নন। তারা ট্রাম্প পরবর্তী মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, সেখানে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটরা নিজেদের অচলাবস্থায় আটকে ফেলেছে। এমনকি শাসন প্রক্রিয়াও এগিয়ে নিতে পারছে না তারা। একই কথা বলা যায় ভারতীয় জনতা পার্টি ও জাতীয় কংগ্রেসের বর্তমান তিক্ত সম্পর্ক নিয়েও। এই বিশ্লেষকরা বলেন, সব জায়গাতেই বিভক্তি রয়েছে। আর তা বিকশিত গণতন্ত্রকে আক্রান্ত করছে। বাংলাদেশই একমাত্র নেতিবাচিক উদাহরণ নয়।
বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৭ বা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হারে অর্জিত হতে থাকার কারণে দেশটির সাধারণ মানুষ অন্য যেকোনও বিবেচনার আগে অর্থনৈতিক অগ্রগতিকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন। একারণে স্বাভাবিকভাবে কট্টরপন্থী রাজনৈতিক দল, গ্রুপ বা সংস্থার আবেদনে সাড়া দিচ্ছে না মানুষ। শেখ হাসিনার স্লোগান ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ মানুষের মানসিকতায় নতুন তাৎপর্য অর্জন করেছে।
বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর ভালো-মন্দ বিচারের বিষয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এনজিও এবং সুশীল সমাজের মূল্যায়নের বিষয়ে সতর্ক করেছেন সিদ্ধার্থ সিং। তিনি মনে করেন, এসব সংস্থার নিজেদের ভূমিকার অতিমূল্যায়ন করা উচিত না। তিনি বলেন, এনজিও এবং সুশীল সমাজকে রাজনৈতিকভাবে কী করণীয় ও কী টিক না তা নির্ধারণ করার দায়িত্ব দেওয়ার বিপদ সম্পর্কে বাংলাদেশ আমাদের শিক্ষা দেয়। দীর্ঘদিন দেশটির অর্থনীতি বিদেশি সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল থাকার কারণে বাংলাদেশ কার্যত দাতা সংস্থা ও এনজিও’র মুঠোয় ছিল। গণতন্ত্রে এটা মেনে নেওয়া যায় না। কেউ যদি রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশ হতে চায় তাহলে তাকে একটি দল গড়ে তুলতে হবে ও রাজনীতিতে যোগ দিতে হবে। কেউ এই কষ্টকর ও রাজনীতির চড়াই-উতরাই পার না হয়েই রাজনৈতিক কর্তৃত্ব চালিয়ে যেতে পারে না।
কেউ যদি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অংশ নিতে চায় তাহলে তার দল গঠন করে রাজনীতিতে যোগ দিতে হবে। এই রাজনীতির রুক্ষ্মতা কেউ এড়াতে পারে না। নিছক কাগুজে হলেও এটা গণতন্ত্রের বৃহত্তর অর্জনকে ম্লান করে।
এটাই হয়তো আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থকদের কাছে সুখকর। কিন্তু কোনও সন্দেহ নেই যে, সিদ্ধার্থ সিংয়ের অবস্থানের বিরুদ্ধে যুক্তি দেওয়া কঠিন।