X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘ফ্রেন্ডলি ফায়ার’কে আরসার হামলা বলছে মিয়ানমার?

আরশাদ আলী
২০ জানুয়ারি ২০১৯, ১৭:৪৭আপডেট : ২০ জানুয়ারি ২০১৯, ১৭:৫৬

সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ওপর সংঘটিত একটি সন্ত্রাসী হামলায় প্রথমে আরাকান আর্মিকে (এএ) দায়ী করা হলেও ঘটনার তিন দিন পর এসে মিয়ানমার বলছে, রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ওই হামলা চালিয়েছে। রাখাইনের মংডুতে দেশটির বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ওপর হামলায় তাদের ৬ সদস্য আহত হয়। সেদিনই মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ দাবি করে, আরাকান আর্মি ওই হামলা চালিয়েছে। হামলায় আরাকান আর্মির সংশ্লিষ্টতার কথা বলা হয়েছিল শনিবারের পুলিশ প্রতিবেদনেও। তবে ওই শনিবারেই কিছু সময় পর দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দাবি করা হয়েছে, এটি আরসার হামলা। আরাকান আর্মির দাবি, এটি আদতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যকার ‘ফ্রেন্ডলি ফায়ার’ ছিল। আরাকান আর্মির ভাষ্যের পাশাপাশি রোহিঙ্গা ও আরসার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক সেনাপ্রচারণার অতীত নজিরের সাপেক্ষে প্রশ্ন উঠেছে, ‘ফ্রেন্ডলি ফায়ার’র দায় আরসার ওপর চাপানো হচ্ছে কি না।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যদের ফাইল ছবি

বুধবার মংডু শহরের ওয়াট কেইন গ্রামের কাছে হামলার কবলে পড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর একটি পুলিশ ভ্যান। ঘটনার পর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে একে আরাকান আর্মির হামলা আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ান জেনারেল জাউ লিন টুন দাবি করেছিলেন, আরাকান আর্মির ওই হামলায় আহত ছয় বিজিপি সদস্যকে চিকিৎসার জন্য ইয়াঙ্গুনে পাঠানো হয়েছে। এদের একজনের অবস্থা গুরুতর। শনিবারই পুলিশ প্রতিবেদনে হামলাটির জন্য রাখাইনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মিকে দায়ী করা হয়েছিল। পুলিশের অফিসিয়াল ফেসবুকে পেজে আরাকান আর্মিকে দায়ী করে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। তবে রবিবার সকালে ওই পাতায় ঢুকে খবরটি আর পাওয়া যায়নি।

শনিবারই মুহূর্তেই বদলে যায় হামলা নিয়ে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের ভাষ্য। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে মিয়ানমার রেডিও অ্যান্ড টেলিভিশন (এমআরটিভি) দাবি করে, এই হামলা চালিয়েছে আরসা। তাদের প্রতিবেদনের ভাষ্য, ‘সংগঠনটির অন্তত দশজন সশস্ত্র হামলাকারী মংডুর ওয়েট কিয়েইন গ্রামে বিজিপি’র একটি ফাঁড়িতে হামলা চালায়।’ মংডুর পুলিশ কর্মকর্তারাও (বিজিপি) পূর্ববর্তী ভাষ্য পরিবর্তন করে দাবি করে, নিরাপত্তাবাহিনীর ওপর হামলার জন্য আরসা দায়ী। এদিনের পুলিশ প্রতিবেদনে ঘটনায় আরাকান আর্মিকে দায়ী করার প্রসঙ্গে লেফটেন্যান্ট কর্নেল তিন হান লিন রয়টার্সকে বলেন, ওটা প্রাথমিক তদন্ত ছিল। তিনি দাবি করেন, এখন তারা নিশ্চিত, হামলাটি আরসার।

আরাকান আর্মির এক মুখপাত্র অবশ্য কোনও হামলা হওয়ার কথাই অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, বুধবার মংডুতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের কোনও সংঘর্ষ হয়নি। কিন্তু বামার আর্মি (সেনাবাহিনী) ও বিজিপির মধ্যে ভুল বুঝাবুঝিতে গোলাগুলি হয়েছে। তিনি এটাকে ‘ফ্রেন্ডলি ফায়ার’ আখ্যায়িত করেন।

এখন প্রশ্ন, মিয়ানমার একটি ‘ফ্রেন্ডলি ফায়ার’র ঘটনাকে আরসার বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে কিনা। উত্তর খুঁজতে গিয়ে সামনে আসে সে দেশের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম মিয়ানমার টাইমস-এর সম্পাদক ও নির্বাহী পরিচালক কাভি চংকির্তাভন-এর এক বক্তব্য। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক উত্তরণ বিষয়ক এক আলোচনায় তিনি বলেছিলেন, ‘সত্য-মিথ্যা নয়, সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো মিয়ানমার সংক্রান্ত ইতিবাচক বয়ান নির্মাণ করা।’ মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সংস্কারের আন্দোলনকারী লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস-এর গবেষক জারনি ২০০৪ সালে সামরিক শাসনের কবল থেকে বাঁচতে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছিলেন। ২০১৭ সালে তিনি জানিয়েছিলেন, ২০১২ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ২ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে পালানোর সময় থেকেই মুসলিমবিরোধী প্রচারণা জোরদার হয়। সামনে আসতে থাকে সন্ত্রাসী-জিহাদি পরিচয়গুলো।

মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতী জানিয়েছে, হামলাটি কয়েকদিন আগে ঘটলেও এই ঘটনার একটি ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ার পর শনিবার সরকার আরসাকে দায়ী করা হলো। ওই ভিডিওতে হামলার তারিখ ও আরসার লোগো দেখা গেছে। ভিডিওতে দেখা গেছে, যোদ্ধার পোশাক পরে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মুখোশ পরা কয়েকজন চলমান একটি পুলিশের গাড়িতে গুলি করছে। ইরাবতী বলছে, আরসার আগের ভিডিও গুলোতেও এমন পোশাক ও একে ৪৭ রাইফেল দেখা গেছে। ভিডিওটি ভাষান্তরসহ প্রচার করছে এমআরটিভি। ভাষান্তর অনুসারে হামলাকারীরা গুলির পর বলছে, আমাদের আরসা ১৬ জানুয়ারি হামলা চালিয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করতে আল্লাহ আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন।

রাখাইনে অভিযানে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বিজিপি সদস্যরা

ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর সত্যত্যা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে ২০১৭ সালে শুদ্ধি অভিযানের সময়কার এক ঘটনায়। সে সময় সেনা মুখপাত্রের ভূমিকা পালনকারী সংবাদমাধ্যম ইলেভেন মিয়ানমার বাঙালি মুসলিমরা নিজেদের ঘরবাড়িতে আগুন দিচ্ছে উল্লেখ করে বেশকিছু ছবিসহ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কিছুদিন পর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অধীনেই রাখাইনে গিয়েছিলেন বিবিসি’র স্বনামধন্য সাংবাদিক জোনাথন হেড। ফিরে এসে এক প্রতিবেদনে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন তিনি। জানান, তাদেরকে একটি বৌদ্ধ মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানকার একজন ভিক্ষু অভিযোগ করে ‘মুসলিমরা তাদের নিজেদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে।’ তবে ঘটনার প্রমাণ হিসেবে যে ছবি জনাথনকে দেখানো হয়, তা দিয়েই মিয়ানমারের মিথ্যাচার ধরা পড়ে। জোনাথন হেড ছবিতে দেখেন ‘টুপি পরিহিত একজন লোক ঘরে আগুন দিচ্ছেন। একজন নারী তলোয়ার উঁচিয়ে নাটকীয় ভঙ্গি করছেন।’ পরে টুপি পরিহিত ওই ব্যক্তি আর একই নারীকে একটি হিন্দু ক্যাম্পে দেখেন তিনি।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও আরসার বিরুদ্ধে মিয়ানমার ও দেশটির সেনাবাহিনীর সুপরিকল্পিত ও বিদ্বেষী প্রচারণার আরও বেশকিছু নজির এরইমধ্যে ফাঁস হয়েছে সংবাদমাধ্যমে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স প্রকাশিত এক খবরে উঠে আসে রাখাইনে সেনা-বিদ্রোহী সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে নিহত হওয়া ‘হিন্দু’ সম্প্রদায়ের মরদেহকে প্রচারণার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের সেনা-কৌশল। সে সময় মার্কিন মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মিয়ানমারের এই ভূমিকাকে ‘মরদেহের রাজনীতি’ আখ্যা দেয়। অক্টোবরে জাতিসংঘ তাদের নিজস্ব অনুসন্ধান শেষে জানায়, রোহিঙ্গা নিধনের স্বার্থে সেখানে পরিকল্পিতভাবে সংগঠিত ও কাঠামোবদ্ধ কায়দায় সেনা-প্রচারণা ও অভিযান চালিয়েছে মিয়ানমার। 

২০১৮ ফেব্রুয়ারি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের অনুসন্ধানে জানায়, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সামরিক প্রচারণা সেখানকার সমাজকে বিদ্বেষী করে ২০১৮ সালের অক্টোবরে মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ধারাবাহিক ভুয়া প্রচারণা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনযজ্ঞে নেপথ্য ভূমিকা পালন করেছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রোহিঙ্গাবিরোধী প্রচারণা চালাতে ৭শ’ কর্মীকে নিয়োগ দিয়েছিল সেদেশের সেনাবাহিনী।

এখন প্রশ্ন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জোরালো হতে থাকা আন্তর্জাতিক চাপের মুখে, আরসাকে সামনে এনে মিয়ানমার কি তাদের রোহিঙ্গাবিরোধী মিথ্যা প্রচারণার আরেকটি নজির স্থাপন করলো?

 

/বিএ/
সম্পর্কিত
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
মিয়ানমারে বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত শহরে কোণঠাসা জান্তা
আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায় চীন ও ইন্দোনেশিয়া
সর্বশেষ খবর
বাঘ ছাড়া হবে জঙ্গলে, তাই শেষবার ভোট দিলেন বাসিন্দারা!
বাঘ ছাড়া হবে জঙ্গলে, তাই শেষবার ভোট দিলেন বাসিন্দারা!
তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে যশোর, জনশূন্য রাস্তাঘাট
তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে যশোর, জনশূন্য রাস্তাঘাট
মুখোমুখি ইরান-ইসরায়েল, পরীক্ষার মুখে মার্কিন সামরিক কৌশল
মুখোমুখি ইরান-ইসরায়েল, পরীক্ষার মুখে মার্কিন সামরিক কৌশল
শহীদ মিনারে বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাসের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা
শহীদ মিনারে বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাসের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া