X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

মানবাধিকার হরণের উপায় খুঁজছেন থেরেসা মে?

আশফাক মাহমুদ
২৩ জানুয়ারি ২০১৯, ১৭:৩১আপডেট : ২৩ জানুয়ারি ২০১৯, ১৭:৩৭
image

১৯৯৮ সালে পাস হওয়া ‘হিউম্যান রাইটস অ্যাক্ট’ নামের আইনে ইউরোপীয় মানবাধিকার সনদকে অঙ্গীভূত করেছিল যুক্তরাজ্য। সে কারণে ইউরোপীয় মানবাধিকার নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনও আইন প্রণয়নের সুযোগ নেই সেখানে। ২০০০ সালে কার্যকর হওয়া সেই মানবাধিকার আইন (হিউম্যান রাইটস অ্যাক্ট) ব্রেক্সিটের পর বহাল থাকবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ব্রেক্সিট পরবর্তী ইউরোপীয় ইউনিয়ন-যুক্তরাজ্য সম্পর্কের রূপরেখা কী হবে, তা নিয়ে ২০১৮ সালে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী থেরেসার সেই ব্রেক্সিট শ্বেতপত্রে মানবাধিকার আইনের প্রতি ‘অঙ্গীকারবদ্ধ’ থাকার কথা বলা হয়েছিল। তবে খসড়া ব্রেক্সিট চুক্তি পরবর্তী রাজনৈতিক ঘোষণায় ওই আইনের প্রতি ‘শ্রদ্ধাশীল’ থাকার কথা। ভাষাগত এই পার্থক্য আইনটির ভবিষ্যতকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এদিকে সম্প্রতি হাউস অব লর্ডসের সাব কমিটিকে ব্রিটিশ আইন প্রতিমন্ত্রীর দেওয়া চিঠিতেও মানবাধিকার আইন থেকে যুক্তরাজ্যের সরে আসারই ইঙ্গিত মিলেছে।

প্রতীকী ছবি
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের ‘বিশ্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র’র মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছিল মানবাধিকার ইস্যু। দুই বছর পর জাতিসংঘের সে ঘোষণাপত্রকে অনুসরণ করে পাস হয় ইউরোপীয় মানবাধিকার সনদ (ইসিএইচআর)। এ সনদ সরাসরি যুক্তরাজ্যে কার্যকর করতে ১৯৯৮ সালে সেদেশে পাস হয় মানবাধিকার আইন (হিউম্যান রাইটস অ্যাক্ট)। আর ২০০০ সালের ২ অক্টোবর থেকে সে মানবাধিকার আইন কার্যকর হয় সেখানে। এই আইনের কারণে ফ্রান্সের স্ট্রসবার্গে অবস্থিত ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের বদলে যুক্তরাজ্যের আদালতেই সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা সংস্থা মানবাধিকার হরণের বিষয়ে অভিযোগ জানাতে পারে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিপেনডেন্টের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৮ সালে থেরেসা মে সরকার প্রকাশিত ব্রেক্সিট শ্বেতপত্রে বলা হয়েছিল মানবাধিকার আইনের সুরক্ষা দিতে যুক্তরাজ্য অঙ্গীকারবদ্ধ। তবে গত ডিসেম্বরে ইইউ-এর সঙ্গে যুক্তরাজ্য যে ‘রাজনৈতিক ঘোষণা’র ব্যাপারে সম্মত হয়েছে সেখানে ‘অঙ্গীকারবদ্ধ’ শব্দটি নেই। সেখানে বলা হয়েছে, ‘ইউরোপীয় মানবাধিকার সনদের রূপরেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল’ থাকবে যুক্তরাজ্য।

ডিসেম্বরের ওই রাজনৈতিক ঘোষণাপত্রে ‘অঙ্গীকারবদ্ধ’ এর জায়গায় ‘শ্রদ্ধাশীল’ শব্দটি থাকায় এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। এ উদ্বেগের কথা জানিয়ে হাউস অব লর্ডসের আইনবিষয়ক সাব কমিটি ব্রিটিশ আইন মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দেয়। এর জবাবে হাউস অব লর্ডসের কাছে একটি পাল্টা চিঠি দিয়েছেন আইন প্রতিমন্ত্রী এডওয়ার্ড আরগার। চিঠিতে তিনি বলেন, ‘ইইউয়ের সঙ্গে আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের মূল ভিত্তিগুলোর একটি হচ্ছে মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার গুরুত্বের বিষয়ে আমাদের যৌথ বিশ্বাস।’

এর পরপরই আরগার ইঙ্গিত দিয়েছেন, ব্রেক্সিট প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর মানবাধিকার আইন বাতিল করা হতে পারে। আরগার বলেন, ‘ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বের হয়ে আসার প্রক্রিয়া চলাকালীন  মানবাধিকার আইন বাতিল কিংবা প্রতিস্থাপন না করার ব্যাপারে আমরা বদ্ধপরিকর। এটা ঠিক যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করব। এরপর নতুন সাংবিধানিক ক্ষেত্র বিশ্লেষণ করে বিষয়টিকে আমরা বিবেচনায় নেব।’

হাউস অব লর্ডসের আইন বিষয়ক সাব কমিটির সদস্যরা আইন প্রতিমন্ত্রীর উত্তরকে ‘বিভ্রান্তিকর’ মনে করছেন। তাদের ভাষ্য, এমন কৌশলী ভাষায় উত্তর দেওয়া হয়েছে যে এতে আশ্বস্ত হওয়া যাচ্ছে না ব্রেক্সিটের পর থেরেসা মের সরকার ইসিএইচআর (ইউরোপিয়ান কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটস)  মেনে চলবে কি না। কমিটির সদস্য ব্যারোনেস কেনেডি প্রশ্ন করেছেন, ‘ইসিএইচআর রক্ষার বিষয়ে সরকার কি আগের মতোই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ? যদি তা হয়ে থাকে, তাহলে তারা কেন আমাদেরকে আশ্বস্ত করছে না যে ব্রেক্সিটের পর ইসিএইচআরকে অনুসরণকারী ব্রিটিশ ‘হিউম্যান রাইটস অ্যাক্ট’ বাতিল বা পরিবর্তন করা হবে না?

যুক্তরাজ্যের নাগরিক হোক বা না হোক দেশটির আইনি সীমার মধ্যে থাকা সব ব্যক্তি কে  জীবন রক্ষার; নির্যাতন-দাস প্রথার শিকার না হওয়ার; ‘দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ’ নীতির আলোকে বিচার পাওয়ার, বিনা বিচারে আটক হয়ে না থাকার, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সুরক্ষার, চিন্তা ও ধর্ম পালনের স্বাধীনতার, বাক স্বাধীনতার, বর্ণ-লিঙ্গ-জাতি-প্রতিবন্ধিত্ব-ধর্ম-বয়সের সূত্রে বঞ্চিত না হওয়ার, সম্পত্তির মালিকনার, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার, সুষ্ঠু-অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো অধিকারের নিশ্চয়তা দেয় ‘হিউম্যান রাইটস অ্যাক্ট’ (এইচআরডব্লিউ)। এইচআরডব্লিউয়ের ১৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কাউকে জোর করে তার দেশে ফেরত পাঠানো যাবে না যদি সেখানে গেলে তার প্রাণ হারাবার বিশ্বাসযোগ্য সম্ভাবনা থেকে থাকে। যুক্তরাজ্যের অন্যান্য আইনকে ‘হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টের’ সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পাঠ করতে হয়। যুক্তরাজ্যের আদালত কোনও আইনের ব্যাখ্যা নির্ধারণে বা সেই অনুযায়ী আদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে যথাসম্ভব ‘ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের’ দেওয়া আগের রায়ের উদাহরণ অনুসরণ করে। দেশটির পার্লামেন্টে পাস করা কোনও আইন যদি হিউম্যান রাইস অ্যাক্টের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে যুক্তরাজ্যের আদালত সংশ্লিষ্ট আইনটিকে অবৈধ ঘোষণা করতে পারে। তবে আদালতের আদেশের মাধ্যমে আইনটি বিলুপ্ত হয়ে যায় না। পার্লামেন্ট এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার রাখে।

থেরেসা মে
২০১৬ সালে কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জে নেমে থেরেসা মে বলেছিলেন, ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের সদস্য হয়ে যুক্তরাজ্যের ক্ষতি হয়েছে। অন্য দেশ থেকে যুক্তরাজ্যে যাওয়া যেসব ব্যক্তি জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদে জড়িত তাদেরকে তাদের মূল দেশে প্রত্যর্পণ করা যাচ্ছে না। এ প্রতিবন্ধকতা দূর করতে ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সে মতৈক্য না থাকা নিয়েও হতাশা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। সে কারণে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালেই তিনি ইসিএইচআরের বিরোধী হয়ে ওঠেন। জঙ্গিবাদে অভিযুক্ত আবু কাতাদাকে জর্ডানে প্রত্যর্পণ করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইসিএইচআর। সে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে আট বছর সময় লেগেছিল। ব্রেক্সিট গণভোটের আগের দিন থেরেসা মন্তব্য করেছিলেন, ‘ইসিএইচআর এর কাছে আমাদের হাত বাঁধা, আমাদের সমৃদ্ধিতে কোনও অবদান রাখেনি এ আইন। অন্যদিকে বিপজ্জনক বিদেশি অপরাধীদের প্রত্যর্পণে বাধা দিচ্ছে এটি। অন্যদিকে মানবাধিকার প্রশ্নে রাশিয়ার মতো দেশগুলোর আচরণে পরিবর্তন আনতেও এ আইনের আওতায় কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।’

ইন্ডিপেনডেন্টের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ‘ইউরোপিয়ান কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটস’ (ইসিএইচআরকে) সম্পূর্ণভাবে মেনে না চললে ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাজ্যের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তি করতে সমস্যা হওয়ার কথা আগেই সতর্ক করেছিল ইইউ। তবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে ইসিএইচআরকে সমস্যা বলে মনে করেন। দেশটি আগে বেশ কয়েকবার জঙ্গিবাদ দমনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে মানবাধিকার ক্ষুণ্নকারী আইন বা ধারা পাস করেছে। এমন আইন আগে বাতিল হয়েছে, তেমনি এমন আইনের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যে এখনও মামলা বিচারাধীন। মানবাধিকার হর্ন করার অভিযোগ ওঠা সংশ্লিষ্ট আইনগুলোর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ করা যায় এই কারণে, যে সেগুলো ইসিএইচআর অনুপ্রাণিত ব্রিটিশ ‘হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টের’ পরিপন্থী।

সমালোচকরা বলছেন, ‘হিউম্যান রাইটস অ্যাক্ট’ বাতিল বা পরিবর্তন করলে তা যুক্তরাজ্যের আইনি কাঠামোর সঙ্গে ইইউয়ের আইনি কাঠামোর আনুষ্ঠানিক যোগসূত্রকে ছিন্ন করে দেবে। ওই আইনটি কার্যকর হওয়ার আগে মানবাধিকার প্রশ্নে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে যুক্তরাজ্যের আদালতের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর ফ্রান্সের স্ট্রসবার্গে যেতে হতো। কারণ সেখানে ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত স্থাপিত। এতে যেমন দীর্ঘ সময় লাগত, তেমনি ব্যয় হতো বিপুল পরিমাণ অর্থ। ১৯৯৮ সালে ‘হিউম্যান রাইটস অ্যাক্ট’ পাসের মাধ্যমে দূর হয় এই বাধা। 

/এফইউ/বিএ/
সম্পর্কিত
ইউক্রেনকে ৬২ কোটি ডলারের অস্ত্র সহায়তা দেবে যুক্তরাজ্য
ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে গিয়ে অন্তত ৫ অভিবাসী নিহত
ইউরোপে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তাপমাত্রা বাড়ছে
সর্বশেষ খবর
গোপনে ইউক্রেনকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
গোপনে ইউক্রেনকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ ২৯ এপ্রিল
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ ২৯ এপ্রিল
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ক্যাসিনো কাণ্ডের ৫ বছর পর আলো দেখছে ইয়ংমেন্স ও ওয়ান্ডারার্স
ক্যাসিনো কাণ্ডের ৫ বছর পর আলো দেখছে ইয়ংমেন্স ও ওয়ান্ডারার্স
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি