X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যেভাবে জলবায়ু-অভিবাসীদের শহরে রূপান্তরিত হচ্ছে ঢাকা

বিদেশ ডেস্ক
২৭ জানুয়ারি ২০১৯, ১৯:৫৪আপডেট : ২৮ জানুয়ারি ২০১৯, ১৪:০৫
image

তখনও জাগেনি ভোরের সূর্য। তবে জাগতে হয়েছে গোলাম মোস্তফাকে। একটু পরেই ছুটতে হবে জীবিকার উদ্দেশে। ঘুমিয়ে থাকার উপায় নেই তার। রাজধানী ঢাকার একটি ইটের কারখানা তার কর্মক্ষেত্র। দিনে ‌১৫ ঘণ্টা করে সপ্তাহের সাতদিন বাধ্যতামূলক শ্রমযাপন তার নিয়তি। তবে সবসময় জীবন এমন ছিল না। যেখানে তার জন্ম-বেড়ে ওঠা আর জীবিকার নিশ্চয়তা ছিল, দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলীয় সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার সেই গ্রাম ছেড়ে জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় আসতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। প্রাণ-প্রকৃতিভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেই নিয়তির গল্প বলেছেন মোস্তফা
ঢাকায় বস্তি আর উঁচু স্থাপনার সহাবস্থান
২৪ জানুয়ারি (বৃহস্পতিবার) প্রকাশিত প্রতিবেদনের জন্য সাক্ষাৎকার নিতে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের সাংবাদিকদের যেতে হয় মোস্তফার কাছে। বস্তির ছোট্ট একটা ঘরে গাদাগাদি করে আরও ১৪ জনের সঙ্গে তার বসবাস। মাথার ওপরে স্বল্প ভোল্টের এক বৈদ্যুতিক বাতি। কাজে যেতে স্বল্প আলোতেই দ্রুত শর্টস আর টি-শার্ট পড়ে নেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিককে বলেন, ‘যদি নদীভাঙনে আমাদের জমি ভেসে না যেত, তবে এখানে থাকতে হতো না।’

আন্তর্জাতিক দুনিয়া জানে, শিল্পোন্নত দুনিয়ার কার্বন মচ্ছবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষস্থানে। যে দক্ষিণাঞ্চলে মোস্তফার ঘর-জমি আর স্বপ্ন ছিল, ইতোমধ্যেই সেখানে বৈশ্বিক উষ্ণতার ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়েছে। বেড়েছে ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার প্রচণ্ডতা। উষ্ণতা বৃদ্ধি কী জিনিস, মোস্তফা কখনও তা শোনেননি। জলবায়ুর চিরাচারিত পরিবর্তনের সঙ্গে এখনকার পরিবর্তনের পার্থক্য কী তাও জানেন না তিনি। তাই বুঝে উঠতে পারেন না, নদীগর্ভে তার কৃষিজমি বিলীন হয়ে যাওয়ার জন্য মানুষের কর্মকাণ্ডই দায়ী। মোস্তফা জানেন না, শিল্প বিপ্লবের পর থেকে জারি থাকা সুদূর পাশ্চাত্যের মুনাফালোভী উৎপাদন ব্যবস্থা কী করে তার জীবিকার অবলম্বনকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।

বুড়িগঙ্গা তীরে জলবায়ু-অভিবাসীদের কর্মকাণ্ড, ছবি: পপি ম্যাকপার্সন

সুনির্দিষ্ট সময় পর পর প্রাকৃতিক ধারাবাহিকতায় বদলে যায় জলবায়ু। মানুষ সৃষ্ট কারণেই এই স্বাভাবিক বদলের ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হয়েছে। বিশ্ব বহুদিন থেকে এক আকষ্মিক পরিবর্তনের মুখোমুখি। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন, শিল্পবিপ্লব পরবর্তী যুগে উন্নত দেশগুলোর মাত্রাতিরিক্তি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৈশ্বিক উষ্ণতার মাত্রাকে ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। উষ্ণায়নের কারণে গলছে হিমবাহের বরফ, উত্তপ্ত হচ্ছে সমুদ্র, বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ব্যহত হচ্ছে স্বাভাবিক ঋতুচক্র। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি, স্থানচ্যুত হচ্ছে মানু্ষ। অভিবাসী কিংবা শরণার্থীতে রূপান্তরিত হচ্ছে তারা। বাংলাদেশে এই বাস্তবতা এরইমধ্যে ভয়াবহভাবে দৃশ্যমান।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জবাবদিহিতা সংক্রান্ত দফতর (ইউনাইটেড স্টেট গভর্নমেন্ট’স অ্যাকাউন্টিবিলিটি অফিস) থেকে গত সপ্তাহে  প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও খরা বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, জলবায়ু পরির্তন কৃষি ও মৎস চাষের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করায় মানুষ নিজেদের এলাকা ছেড়ে উপকূলবর্তী অঞ্চলে আবাস গড়ছে। অথচ ওই উপকূলীয় অঞ্চলগুলোও জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব মোকাবেলা করছে। ইন্টারন্যাশনাল ডিসপ্লেসমেন্ট ম্যানেজমেন্ট সেন্টারের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালে দুর্যোগজনিত কারণে বাংলাদেশে ঘর হারিয়েছে প্রায় সাড়ে নয় লাখ মানুষ।   

বন্যার পানি থেকে বাঁচতে খড় নিয়ে ছুটছেন বাংলাদেশের নারী

ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার প্রকাশিত জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে বিগত এক দশকে প্রতি বছর গড়ে প্রায় সাত লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ২০০৯ সালে এই সংখ্যা বেড়ে যায়। সেবছর আইলার আঘাতে ২০০ জন প্রাণ হারিয়েছেন, আর ঘর ছেড়েছেন ১০ লাখেরও বেশি মানুষ। কিন্তু অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল আবহাওয়ার মধ্যেও মানুষ ঘর ছেড়েছে। বাস্তুচ্যুত এতো এতো মানুষ কোথায় গেছে?  ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের প্রতিবেদন বলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, ভূমিক্ষয়, পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি কিংবা ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনায় এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে মানুষ। গোলামের মতো করেই ওইসব মানুষের একটা বড় অংশ অভিবাসী হয়েছে রাজধানী ঢাকায়।

উপকূল থেকে বেশিরভাগ মানুষ পালিয়ে নগরের বস্তি এলাকায় আশ্রয় নেয়। আসলেই অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা আসবে এমন ধারণা থেকে সবাই ঢাকায় পাড়ি জমায়। দারিদ্র, স্বাস্থ্য সংকটসহ অন্যান্য কারণে প্রতি বছর নিম্ন আয়ে ৪ লাখ মানুষ ঢাকায় পাড়ি জমান। পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে ২০ কোটি অভিবাসী তৈরি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ২০১৮ সালের মার্চে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে ১ কোটি ৩৩ লাখ বাংলাদেশি বাস্তুচ্যুত হতে পারে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বলছে, ঢাকা যেন সেই অদেখা বিশ্ববাস্তবতার ছোটখাট একটা আভাস।ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এর পরিচালক ও দেশের অন্যতম শীর্ষ পরিবেশ বিজ্ঞানী সালিমুল হক বলেন,  আমরা নিশ্চিত হয়েই বলতে পারি উপকূলে এখন অনেক মানুষ যেই পরিস্থিতি বসবাস করছে কিছুদিন পরে সেটা থাকবে না। সালিম হক বলেন, গ্রামে সাগর কিংবা নদীভাঙনে ভিটে হারিয়েছেন এমন মানুষেই আজ ঢাকা পূর্ণ। আরও কয়েক লাখ আসলে তাদের জায়গা দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে।

উপকূলীয় এলাকার জলবায়ু অভিবাসীদের সাধারণ গন্তব্য ইটভাটা। ছবি: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে নগর পরিকল্পনাবিদ, নীতিনির্ধারক, বিজ্ঞানী ও কৃষক সবাই বাঁধ দেওয়ার কথা বলছেন। তারা নতুন করে বাড়ি বানাচ্ছেন, আশ্রয়কেন্দ্র বানাচ্ছেন, বলছে লবণসহিষ্ণু ধানের বীজ উৎপাদনের কথা। তবে সেসবে ভরসা না দেখে মোস্তফার মতো অনেকেই গ্রাম থেকে রাজধানীতে অভিবাসী হতে বাধ্য হচ্ছেন।

মোস্তফা স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে জানান, তার শিশুকালেই ঝড়ে ভেঙে যায় তাদের আবাস। খুব ভালো করে মনেও নেই সেই বিভীষিকার কথা। কেবল মনে পড়ে বন্যায় তারে বাড়ি ভেঙে যায়, বাবার ফলের গাছ ভেঙে পড়ে, সংসার চালানোর সম্বল ছোট দোকান থেকে চা ও চালও ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তিনি তখন মায়ের সঙ্গে প্রতিবেশীর বাড়িতে আশ্রয় নেন। কিছুদিন পর সেই বাড়িও ভেসে যায়। এরপপর নদীর পার থেকে অন্ধকারের দিকে ছুটতে থাকেন তারা।  এরপর কয়েকবছর কেটে যায়, আবারও সেই বিভীষিকা, আবারও ঝড়ের আঘাতে ধ্বংস হয় বাড়ি। তারপর মাথা তুলে সেখানে বসবাসের স্বপ্ন দেখছিলো গোলামের পরিবার। তবে তৃতীয়বার ঘুর্ণিঝড় আইলার তাণ্ডবে শুধু বাড়ি না, তার সহায়-সম্বল সবই হারিয়ে যায়।

ঢাকার পরিবর্তে মংলায় আসা অনেক জলবায়ু অভিবাসীর একজন কবির হোসেন। ভ্যানই তার জীবিকার একমাত্র উৎস। ছবি: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

আইলার পর মোস্তফার পরিবারের মাথা থেকে হারিয়ে যায় নিজস্ব ছাদ। কৃষিজমির সঙ্গে সঙ্গে নদীতে বিলীন হয়ে যায় অনেকখানি আশা আর স্বপ্ন।  পানিতে লবণ বৃদ্ধি পাওয়ায় মাছও আগের মতো নেই। তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করা যুবক মোস্তফার সামনে তখন আর পথ থাকে না। পরিবারের খাবার জোগাড়ে ইটের কারখানায় যোগ দিতে বাধ্য হন তিনি। মোস্তফার ভাষ্য, ‘আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন কেউই কাজের জন্য এখানে আসতো না। আর এখন আমার গ্রামে প্রায় প্রত্যেক পরিবার থেকেই একজন ঢাকা আসছে।’ মোস্তফার নিজের পরিবার থেকে এসেছে দুজন। বছর দুয়েক আগে তার ছোট ভাইও এসে জুটেছে। প্রতি ছয়মাসে আয় হয়  ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা।

বৃষ্টিদিনে ইটভাটা কাজের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। প্রকৃতির বরষা আসে আশীর্বাদ হয়ে। গোলামি থেকে খানিকটা সময়ের ছুটি মেলে গোলাম মোস্তফাদের। তখন বাসে চেপে সোজা বিমানবন্দর চলে যান সাথীদের নিয়ে। দূর আকাশে তাকিয়ে দেখতে থাকেন বিমানের যাওয়া-আসা। ভাবতে থাকেন, কোথায় তাদের উদ্দেশ।

/এমএইচ/বিএ/
সম্পর্কিত
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে গিয়ে অন্তত ৫ অভিবাসী নিহত
সর্বশেষ খবর
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা