X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০
সিএনএন-এর ভেনেজুয়েলা বিশ্লেষণ

ট্রাম্পের ঘরে সমাজতন্ত্রের ভয়, বাইরে স্নায়ুযুদ্ধ যুগের নীতি

বিদেশ ডেস্ক
১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২২:২২আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৩:০৫
image

কার্ল মার্কস আর ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস তাদের ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’ শুরু করেছিলেন ‘ইউরোপকে এক ভূতে পেয়েছে, কমিউনিজমের ভূত’ বাক্যটি দিয়ে। স্নায়ুযুদ্ধ যুগে কমিউনিজমের ভূতের ভয়ই ছিল তখনকার দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নের (আজকের রুশ ফেডারেশন) মহাকাশযাত্রা, বিধ্বংসী অস্ত্র উন্নয়নসহ যাবতীয় সামরিক প্রতিযোগিতার ভিত্তি। ৯০-এর দশকে স্নায়ুযুদ্ধ যুগের অবসান হলেও ‘কমিউনিজম কিংবা সমাজতন্ত্রের ভূতকে’ আবার ফিরিয়ে এনেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আমেরিকার ‘পেছন দিককার প্রাঙ্গণ’ আখ্যা পাওয়া লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশে চলমান সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পাটাতনে দাঁড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ বিকাশের ‘আশঙ্কা’ প্রকাশ করছেন তিনি। আবাসন ব্যবসায়ী থেকে আচমকা মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়া ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক দুরাবস্থার জন্য সমাজতান্ত্রিক নীতিকেই দুষছেন। মাদুরোকে উৎখাতের যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেছেন, তার সমাজতান্ত্রিক নীতি-পরিকল্পনার কারণেই ভেনেজুয়েলা বিপন্ন। এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ট্রাম্পের দেশেরই সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএন বলছে, স্নায়ুযুদ্ধের যুগে সমাজতান্ত্রিক দেশে যুক্তরাষ্ট্র যেমন যুদ্ধজাহাজ পাঠাত বা সিআইএর সহায়তায় সংগঠিত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল ঘটাত, সেই একই কৌশল ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চাইছেন আজকের মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ট্রাম্পের ঘরে সমাজতন্ত্রের ভয়, বাইরে স্নায়ুযুদ্ধ যুগের নীতি
নির্বাচনি কারচুপির অভিযোগ আর অর্থনৈতিক সংকট ভেনেজুয়েলার জনগণকে তাড়িত করেছে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে। বিক্ষোভের সুযোগে ২৩ জানুয়ারি নিজেকে অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন বিরোধী নেতা হোয়ান গোয়াইদো।  ট্রাম্প প্রশাসন সেই স্বঘোষিত প্রেসিডেন্টকে স্বীকৃতি দিয়ে মাদুরো সরকারকে উৎখাতের ব্যাপারে প্রকাশ্য অবস্থান নিয়েছে। ‘প্রয়োজনে সামরিক হস্তক্ষেপের’ মতো হুমকিও দেওয়া হয়েছে। গত মঙ্গলবার (৫ ফেব্রুয়ারি) ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ‘স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণে বলেছেন, ‘ভেনেজুয়েলাবাসীর পবিত্র গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় আমরা তাদের পাশে আছি। একই সঙ্গে আমরা মাদুরো সরকারের নির্মমতার নিন্দা জানাচ্ছি, যার সমাজতান্ত্রিক নীতি লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে ধনী দেশের অবস্থান থেকে দেশটিকে দারিদ্র্য ও হতাশার ভূমিতে পরিণত করেছে। আমরা শঙ্কিত। কারণ যুক্তরাষ্ট্রেও আমরা সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের ডাক শুনতে পাচ্ছি। আমরা স্বাধীন হয়ে জন্মেছি এবং স্বাধীনই থাকব।’
সুদীর্ঘ অচলায়তন ভেঙে ২০১৬ সালে কিউবা সফরে গিয়েছিলেন বিগত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বরাক ওবামা। ১৯২৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেলভিন কুলিজের সফর আর ওবামার সফরের মধ্যকার ব্যবধান ৮৮ বছর। সফরকালে ওবামা বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র-লাতিন আমেরিকা সেই অতীতে আর ফিরে তাকাবে না, সম্পর্কহীনতার ইতিহাসকে সমাধিস্থ করে এগিয়ে যাবে নতুন দিনের উদ্দেশে। তবে ওই বক্তব্যের সূত্রে ভেনেজুয়েলা প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আর ট্রাম্পের সাম্প্রতিক বক্তব্যকে সামনে এনে সিএনএনের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বিপুল পরিমাণ ‘অতীত ইতিহাস’ এক কবরে ঢোকানো সম্ভব হচ্ছে না!
শুধু ট্রাম্প নন। তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টনও সমাজতান্ত্রিক নীতির কঠোর সমালোচক। তিনি ভেনেজুয়েলা, নিকারাগুয়া ও কিউবাকে ‘শয়তানের ত্রিভূজ’ (ট্রয়কা অব টায়রানি) আখ্যা দিয়ে তিন দেশের বিরুদ্ধেই কঠোর পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এদিকে আশির দশকে লাতিন আমেরিকায় মার্কিন নীতি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় যুক্ত একজন মার্কিন কর্মকর্তাকে ভেনেজুয়েলা বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। তার নাম ইলিয়ট আব্রামস। বিভিন্ন কারণে আব্রামস ব্যাপক নিন্দিত। আশির দশকে তিনি যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত এল সালভাদর সরকারের বিষয়ে কংগ্রেসকে অসত্য তথ্য দিয়েছিলেন। দেশটিতে সরকার সমর্থিত বাহিনী নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চালালেও তিনি তা গোপন করেছিলেন। ১৯৯১ সালে তাকে অভিযুক্ত করা হয় ইরানের কন্ট্রা বিদ্রোহীদের বিষয়ে অসত্য তথ্য দেওয়ার অভিযোগে। অন্যদিকে, গত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে তিনি খুব রূঢ় ভাষায় প্রতিবেদন লিখে বলেছিলেন, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্য নন। অথচ স্নায়ু যুদ্ধকালীন সমাজতন্ত্র ভীতির প্রত্যাবর্তনে এখন সেই আব্রামসকেই ভেনেজুয়েলা বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি করার কথা ভাবছে মার্কিন প্রশাসন।
এখানেই শেষ নয়। লাতিন আমেরিকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘কান’ হিসেবে কাজ করা সিনেটর মার্কো রুবিও ভেনেজুয়েলার সেনাবাহিনীর প্রতি মাদুরোকে উৎখাতের আহ্বান জানিয়েছেন। ভেনেজুয়েলার সেনাবাহিনীর উদ্দেশে টুইটারে তিনি বার্তা দিয়েছেন, ‘সময় এসেছে ভেনেজুয়েলার ইতিহাসের পাতায় নিজেদের নাম লেখার। এই সময়ে যারা এগিয়ে আসবে ইতিহাস তাদেরকেই নায়ক হিসেবে স্মরণ রাখবে।’ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাতিন আমেরিকা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম লিওগ্রান্দে একে ‘যুক্তরাষ্ট্রের বিশ শতকীয় পররাষ্ট্র নীতির পুনর্জন্ম’ আখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন, ‘লাতিন আমেরিকায় কোনও সরকারকে ভালো না লাগলে আমরা [যুক্তরাষ্ট্র] তাকে ক্ষমতাচ্যুত করি থাকি।’
মার্কিন হুমকির মুখে ভেনেজুয়েলার পাশে দাঁড়িয়েছে রাশিয়া, চীন ও কিউবা। চীন ও রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলার মাদুরো সরকারকে ঋণ দিয়েছে। রাশিয়া তো দেশটিতে একটি বিমান ঘাঁটি স্থাপনেরও পরিকল্পনা করেছে। অন্যদিকে কিউবা নিয়মিত তার দেশের সেনা কর্মকর্তাদের ভেনেজুয়েলায় পাঠায় পরামর্শ দেওয়ার জন্য। কারাকাসের কাছ থেকে শত শত কোটি ডলার মূল্যের তেল পেয়েছে হাভানা।
মার্কিন ক্ষমতাচক্রের সমাজতন্ত্র ভীতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লাতিন আমেরিকার ক্ষমতায় যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট স্মরণ করিয়ে দিয়েছে সিএনএন। ১৮২৩ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেমস মোনরো নামে পরিচিতি পায় যুক্তরাষ্ট্রের লাতিন আমেরিকা বিষয়ক পররাষ্ট্রনীতি ‘মোনরো মতবাদ’ (মোনরো ডক্ট্রিন)। সেই সময় থেকে ‘যথেষ্ঠ’ পরিমাণে বন্ধুত্বপূর্ণ নয় এমন সব লাতিন আমেরিকান সরকারকে হয় সামরিক হুমকি দেওয়া হতো, নয়তো অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করা হতো। স্নায়ুযুদ্ধের সময় ‘মোনরো ডক্ট্রিনের’ চর্চা আরও বেড়ে গিয়েছিল। কারণ মার্কিন ক্ষমতাচক্রের ধারণা ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের ৯০ মাইলের মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করতে চায় রাশিয়া। আর তার জন্য তারা বেছে নিয়েছে কিউবাকে। সে সময় তাদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছিল, ‘লাল পতাকার চেয়ে মরণ ভালো’ স্লোগান।
সিএনএন-এর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রবেশ ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে সমর্থন করা শুরু করে গণবিরোধী একনায়কদের, যাদের নির্যাতন-নিপীড়নের কারণে ঘরছাড়া হতে হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে। ১৯৯১ সালে ইউরোপে দুই জার্মানির পুনর্মিলন হয়ে গেলে, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাচক্র লাতিন আমেরিকায় তাদের সমর্থিত একনায়কদের মানবাধিকার হরণের বিষয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে। বিশ্লেষক লিওগ্রান্দে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, হস্তক্ষেপের দীর্ঘ ইতিহাসের কারণেই লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মানুষ ভেনেজুয়েলায় নতুন করে কোনও মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ দেখতে চায় না। যুক্তরাষ্ট্র যদি আবারও লাতিন আমেরিকায় অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলের খেলা শুরু হলে লাতিন আমেরিকা নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠতে পারে। আবারও সেখানে শোনা যেতে পারে, ‘ইয়াঙ্কি গো হোম’ স্লোগান।

/এএমএ/বিএ/
সম্পর্কিত
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রধান বিচারপতির সাক্ষাৎ
তাইওয়ানে সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রের
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
সর্বশেষ খবর
কাপ্তাই হ্রদে পানি স্বল্পতায় কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন
কাপ্তাই হ্রদে পানি স্বল্পতায় কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
মৌলভীবাজারে ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা মর্মান্তিক: মানবাধিকার কমিশন
মৌলভীবাজারে ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা মর্মান্তিক: মানবাধিকার কমিশন
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি