হংকংয়ে আশ্রয় নিয়ে থাকা সৌদি আরবের দুই তরুণী জানিয়েছেন, দেশে থাকাকালে তাদের অবস্থা ছিল আটক বন্দিদের মতো। মাসের পর মাস তারা ঘর থেকে বের হতে পারতেন না। পোশাক থেকে শুরু করে ঘুমাতে যাওয়ার সময় পর্যন্ত নির্ধারণ করে দিত পরিবারের পুরুষ সদস্যরা। বাবা-ভাইদের হাতে মারধরের শিকারও হতে হয়েছে তাদের। এমন কি ১০ বছর বয়সী ছোট ভাইকে মারধরে উৎসাহ দেওয়া হতো। বার্তা সংস্থা রয়টার্স লিখেছে, সৌদি আরব তাদের পাসপোর্ট বাতিল করে দিয়েছে। হংকংয়ে বৈধভাবে আশ্রয় নিয়ে থাকার সুযোগ শেষ হয়ে যাবে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি।
অন্য কোনও দেশে আশ্রয় নিতে সৌদি আরবের নারীদের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা আগেও ঘটেছে। দেশটির কঠোর ধর্মীয় আইন-কানুন এতে ভূমিকা রাখছে। গত সেপ্টেম্বর থেকে সংশ্লিষ্ট দুই সৌদি তরুণীর হংকংয়ে আটকে থাকার তথ্য নিশ্চিত করেছে হংকং পুলিশের একটি সূত্র। তবে সেখানে অবস্থিত সৌদি আরবের দূতাবাসে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তারা রয়টার্সকে এ বিষয়ে কোনও তথ্য দেয়নি।
দুই সৌদি তরুণী একজনের বয়স বয়স ১৮ বছর, অপরজনের ২০। গত সেপ্টেম্বরে তাদের পরিবার শ্রীলঙ্কায় বেড়াতে গিয়েছিল। সেখান থেকে তারা অস্ট্রেলিয়ায় পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু বিমান হংকংয়ে যাত্রাবিরতি করলে আটকে যেতে হয় তাদের। হংকংয়েই তাদের পাসপোর্ট বাতিল করে দেয় সৌদি আরব। তারা পালানোর পরিকল্পনা করছিল ২০১৬ সাল থেকে। একটু একটু করে তারা প্রায় ৫ হাজার ডলার জমিয়েছিল। ছোট বোন রাওয়ানের ১৮তম জন্মদিন উপলক্ষে তারা অস্ট্রেলিয়ার ভ্রমণভিসা সংগ্রহ করে। তাদের লক্ষ্য ছিল অস্ট্রেলিয়ায় আশ্রয় নেওয়া।
গত শনিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) রয়টার্স তাদের সঙ্গে কথা বলেছে। মৃদুভাষী দুই তরুণী বলেছেন, রিয়াদে পরিবারের সঙ্গে থাকার সময়টা খুবই নিপীড়নমূলক ও অসুখী সময় ছিল তাদের জন্য। প্রকৃত নাম প্রকাশ হয়ে গেলে তাদেরকে খুঁজে বের করা সহজ হবে, তাই তারা রিমা ও রাওয়ান ছদ্মনামে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। ছবি তুলতে দিতে রাজি হলেও মুখের ছবি প্রকাশ না করার অনুরোধ করেন তারা।
তরুণীদের অভিযোগ, সৌদি আরবে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা তাদের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত। তারা কোন পোশাক পরবেন, কেমনভাবে চুল বাঁধবেন, কখন ঘুম থেকে উঠবেন আর কখন ঘুমাতে যাবেন, এমন সবকিছু নির্ধারিত হতো পরিবারের পুরুষ সদস্যদের দ্বারা। তাদের দুই ভাই, যাদের একজনের বয়স ২৪ বছর এবং আরেকজনের ২৫। ছোট বোন ‘রাওয়ান’ বাবা-ভাইদের বিষয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘তারা যেন আমার জেলার। আর আমি তাদের বন্দিশালা বন্দি।’
অন্যদিকে বড় বোন ‘রিমা’ মন্তব্য করেছেন, ‘এটা যেন আধুনিককালের দাস ব্যবস্থা। সঙ্গে পরিবারের পুরুষ সদস্য না থাকলে ঘরের বাইরে যাওয়া যায় না। কখনও কখনও মাসের পর মাস আমরা সূর্যের মুখ দেখিনি, ঘরেই থাকতে হয়েছে। দুই বোন জানিয়েছেন, তাদের ১০ বছর বয়সী ছোট ভাইকেও মারধর করার জন্য উৎসাহিত করা হতো। ‘মগজ ধোলাইয়ের’ কারণে ছোট ভাইটাও বড় ভাইদের মতো হয়ে যাবে।
তাদের পাঁচ ও ১২ বছর বয়সী আরও দুই বোন আছে। তাদের ফেলে আসায় রিমা ও রাওয়ানের তীব্র দুঃখবোধ রয়েছে। অবশ্য তারা মনে করেন, তাদের পালিয়ে আসার মধ্য দিয়ে পরিবারটি একটি শিক্ষা পাবে। তাতে হয়তো তাদের ছোট বোনদের আরেকটু ভালোভাবে বাঁচার সুযোগ তৈরি হবে। দুই তরুণী রয়টার্সের কাছে ইসলাম ত্যাগের দাবি করেছেন। নিরাপত্তার স্বার্থে হংকংয়ে ১৩ বার তাদেরকে বাসস্থান বদল করতে হয়েছে। কখনও হোটেলে, কখনও স্থানীয়দের বাড়িতে। কোথাও কোথাও তারা একরাত থেকেই বেরিয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছেন।
দুই সৌদি তরুণীর আইনজীবী মাইকেল ভিডলার জানিয়েছেন, পাসপোর্ট বাতিল হয়ে যাওয়ায় তারা আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হংকংয়ে থাকতে পারবেন। তারা তৃতীয় একটি দেশে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন। তবে সৌদি আরব যাতে সেখানেও বাধা দিতে না পারে তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট দেশের নাম প্রকাশ করা হয়নি।