প্যারিসের ঐতিহাসিক নটর ডেম গির্জার আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ফায়ার সার্ভিসের প্রায় ৪০০ কর্মীর চার ঘণ্টারও বেশি সময়ের প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। প্যারিস পুলিশের একজন মুখপাত্র সিএনএনকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। এদিকে স্থাপত্যটি পুনর্নির্মাণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ।
ঘটনাস্থলে পৌঁছে তিনি বলেন, নটর ডেম ক্যাথেড্রালের সঙ্গে পুরো ফরাসি জাতির আবেগ জড়িয়ে রয়েছে। সব ক্যাথলিক ও দেশবাসীর জন্য সমবেদনা। সবার মতো আমিও নিজেদের অস্তিত্বের একটি অংশকে এভাবে পুড়তে দেখে দুঃখ ভারাক্রান্ত। এটি পুনর্নির্মাণ করা হবে।
৮৫০ বছরের প্রাচীন ভবনটি পুরোপুরি তৈরি করতে সময় লেগেছিল দুই শতক। গির্জাটি দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতক ধরে নির্মাণ করা হয়। তবে অগ্নিকাণ্ডের পর মূল কাঠামো এবং দুটো বেল টাওয়ার রক্ষা করা গেছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
ভবনটি রক্ষায় অগ্নিনির্বাপণকর্মীদের তৎপরতার প্রশংসা করেছেন ম্যাক্রোঁ। তিনি বলেন, অগ্নিনির্বাপণকর্মীদের তৎপরতায় আরও খারাপ পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হয়েছে। তাদের সাহসিকতার জন্য ধন্যবাদ।
প্রাচীন গোথিক ভবনটিকে রক্ষার জন্য দমকল কর্মীরা ব্যাপক চেষ্টা চালালেও এর উঁচু মিনার এবং ছাদ ধসে পড়ে। অগ্নিকাণ্ডের কারণ এখনো পরিষ্কার নয়। তবে কর্মকর্তারা বলছেন, চলমান সংস্কার কাজের সাথে কোনও যোগসূত্র থাকতে পারে। জরাজীর্ণ ভবনটি রক্ষার জন্য গত বছর ফ্রান্সের ক্যাথলিক চার্চ তহবিল সংগ্রহের আহ্বান জানিয়েছিল।
যেভাবে আগুন ছড়িয়ে পড়ে
সোমবার বিকালে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হওয়ার পর দ্রুত তা ছাদে ছড়িয়ে পড়ে। ক্যাথিড্রালের ছাদে যখন আগুন জ্বলতে থাকে এবং ভবনের জানালা পুড়ে যায় তখন প্রকাণ্ড শব্দ শোনা যায়। উঁচু মিনার খসে পড়ার আগে তা কাঠের তৈরি কাঠামো ধ্বংস করে দেয়। একটি বেল টাওয়ার ধসের হাত থেকে রক্ষায় কাজ করেন ৫০০ অগ্নিনির্বাপণকর্মী।
চার ঘণ্টা পরে অগ্নিনির্বাপণ বাহিনীর প্রধান জ্যঁ-ক্লদে গ্যালেট বলেন, প্রধান কাঠামোটি পুরোপুরি ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষা করা গেছে এবং এটি সুরক্ষিত আছে।
ক্যাথেড্রালের শিল্পকর্ম সংরক্ষণ এবং এর উত্তরাংশে টাওয়ার রক্ষার জন্য রাতভর সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হয়। ভবনের আশেপাশের রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ জড়ো হন আগুনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করবার জন্য। অনেককে কাঁদতে দেখা যায়, একই সময়ে অন্যরা দুঃখ করছিলেন, কেউবা প্রার্থনা করছিলেন। রাজধানীর অনেক গির্জায় বেল বাজাতে শোনা যায়।
ইতিহাসবিদ কামিলি পাস্কাল ফরাসি গণমাধ্যম বিএফএমটিভিকে বলেন, আগুন ধ্বংস করে দিচ্ছে অমূল্য ঐতিহ্য। ৮০০ বছর ধরে এই ক্যাথেড্রাল প্যারিসে দাঁড়িয়েছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আনন্দ-বেদনায় নটর ডেমের ঘণ্টাধ্বনি তাকে স্মরণীয় করে রেখেছে।
প্যারিসের মেয়র অ্যানি হিদালগো বলেন, ভবনটির ভেতরে প্রচুরসংখ্যক শিল্পকর্ম রয়েছে...এটা একটা সত্যিকারের ট্রাজেডি। অগ্নিনির্বাপণকর্মীরা যে সীমানা বেষ্টনী তৈরি করে দিয়েছে নিরাপত্তার স্বার্থে লোকজন যেন তা মেনে চলে।
১২০০ শতক থেকে প্যারিসে দাঁড়িয়েছিল নটর ডেম। এই ক্যাথেড্রালটি সর্বশেষ বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হয়েছিল ফরাসি বিপ্লবের সময়।
নটর ডেম সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য:
- প্রতিবছর নটর ডেম ক্যাথেড্রাল দেখতে এক কোটি ৩০ লাখ দর্শনার্থী (১৩ মিলিয়ন) ফ্রান্স সফর করেন।
- এটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটিজে সাইট, যা ১২ এবং ১৩ শতকজুড়ে নির্মিত হয়েছিল।
- সংস্কার কাজের জন্য ঢোকার মুখে বেশ কয়েকটি প্রতিমা সরানো হয়েছিলো।
- ভবনের ছাদের বেশিরভাগই ছিল কাঠ দিয়ে তৈরি, যা পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে।
- দুই বিশ্বযুদ্ধের ধকল থেকেই এটি টিকে গিয়েছিল।
জাতির অটলতার প্রতিমূর্তি এভাবে পুড়তে এবং মিনার চোখের সামনে গুঁড়িয়ে যেতে দেখা যে কোনও ফরাসি নাগরিকের জন্যই এক বিশাল ধাক্কা।
প্রত্যক্ষদর্শী সামান্থা সিলভা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব দেশের বাইরে থাকে এবং যখনই তারা আসে প্রতিবার আমি তাদের বলি নটর ডেম বেরিয়ে এসো। অনেকবার আমি সেখানে গেছি, কিন্তু কখনোই এক রকম মনে হয়নি। এটা প্যারিসের সত্যিকারের প্রতীক।’
বিশ্বনেতাদের প্রতিক্রিয়া
ঐতিহাসিক এই গির্জায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দ্রুত আগুন নেভাতে উড়ন্ত জলকামান ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। জার্মান চ্যাঞ্চেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ফ্রান্সের জনগণের প্রতি তার সমর্থনের কথা জানিয়েছেন এবং নটর ডেমকে তিনি ‘ফ্রান্স এবং ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রতীক’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এক টুইটে লিখেছেন, ‘ফ্রান্সের জনগণের সঙ্গে এবং জরুরি পরিষেবাগুলোর সঙ্গে যারা নটর ডেম ক্যাথেড্রালে ভয়ানক অগ্নিকাণ্ডের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন তাদের প্রতি সমবেদনা।’
এই অগ্নিকাণ্ডের খবরে শোক জানিয়ে ফরাসি ফায়ার সার্ভিসের জন্য প্রার্থনার কথা জানিয়েছে ভ্যাটিকান। সূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, সিএনএন।