বিহারে কানহাইয়া কুমার যখন নিজের প্রার্থিতা ঘোষণা করেন তখন তা সংবাদমাধ্যমে আলোড়ন তুলে। ‘মাটির ছেলে’ ভোটের ময়দানে আনকোরা নতুন হলেও তার মনোনয়ন বিজেপিকে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করে। প্রবীণ বিজেপি নেতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিংকে নাভাদা থেকে বিহারে আসতে বাধ্য করে। তাকে প্রার্থী করা হয় কানহাইয়া কুমারের বিরুদ্ধে বেগুসরাই আসনে। শুরুতে এখানে প্রচারণা চালাতেই অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন গিরিরাজ। তবে বৃহস্পতিবারের ফলাফলে স্পষ্ট হয়েছে যে, বিজেপির কৌশল সঠিক ছিল। প্রায় চার লাখ ভোটের ব্যবধানে গিরিরাজের কাছে হেরে গেছেন কানহাইয়া।
ভারতের জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) ছাত্র সংগঠনের সাবেক সভাপতি কানহাইয়া কুমার। তাকে চিনতো জেএনইউ ক্যাম্পাস। বিহার ভোটে তাকে কিছুটা চিনেছিল বেগুসরাই। কিন্তু ক্রমে তিনি জাতীয় রাজনীতির নতুন তারকায় পরিণত হন। ২০১৬ সালের মার্চে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে তিন সপ্তাহ তিহার জেলে কাটিয়েছেন। দিল্লি হাইকোর্টের আদেশে অন্তর্বর্তী জামিনপেয়ে মুক্ত হয়ে তিনি জাতীয় নেতায় পরিণত হন। জেএনইউ ক্যাম্পাসে বক্তৃতা করে গোটা দেশকে মাতিয়ে তোলা কানহাইয়ার নাম এখন সকল ভারতীয়’র মুখে মুখে। সংবাদমাধ্যমে ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তার বক্তৃতা ভাইরাল হয়ে ঘুরছে। তবে ভোটের লড়াইয়ে খুব একটা সুবিধে করতে পারেননি শেষ পর্যন্ত।
ভোটের ময়দানে শুরু থেকেই প্রতিকূলতার মুখে ছিলেন কানহাইয়া। ২০১৪ সালে বেগুসরাই আসনে জিতেছিল বিজেপি। জাতীয় পর্যায়ের দলগুলোর মতো তার ছিল না পেশি শক্তি ও অর্থ। এছাড়া রাজ্যটিতে তার দল সিপিআই’র উপস্থিতিও খুব একটা উল্লেখযোগ্য না। তবে হিন্দি ও ইংরেজি ভাষাভাষী তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা এবং আসনটির সঙ্গে নাড়ির সম্পর্কের কারণে ধারণা করা হচ্ছিল তিনি উতরে যেতে পারেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।
এই না হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ও প্রধান কারণ হলো সেক্যুলার ভোট কানহাইয়া ও আরজেডি প্রার্থী তানভীর হাসানের মধ্যে ভাগ হয়ে যাওয়া। এই আসনের মোট ১২ লাখ ১৭ হাজার ভোটের মধ্যে গিরিরাজ পেয়েছেন ৬ লাখ ৮৮ হাজার, কানহাইয়া পেয়েছেন ২ লাখ ৬৮ হাজার এবং তানভীর হাসান পেয়েছেন ১ লাখ ৯৭ হাজার ভোট। কানহাইয়া হেরেছেন প্রায় চার লাখ ভোটে।
বেগুসরাইতে গিরিরাজের প্রার্থী হওয়া না হওয়া নিয়ে বিজেপি নেতারা সংশয়ে ছিলেন তখন কানহাইয়া আসনটির প্রতিটি এলাকায় প্রচারণা চালিয়েছেন।
কানহাইয়ার ঘনিষ্ঠ সহযোগী বরুণ চাভান হাফিংটন পোস্ট ইন্ডিয়াকে বলেছেন, তানভীরের প্রার্থিতার কারণে ১১০ ভাগ ক্ষতি হয়েছে। পুরো দেশেই এভাবে ভোট ভাগ হয়ে যাচ্ছে।
আগে থেকেই আরজেডি নেতা ও লালু প্রাসাদ যাদবের ছেলে তেজস্বী যাদব বেগুসরাই আসনে কানহাইয়ার উত্থান নিয়ে ভীত ছিলেন। তারা এখানে কোনও ছাড় দিতে রাজি ছিলেন না। বিজেপিবিরোধী হিসেবে কানহাইয়াকে সমর্থন করা থেকে বিরত থাকে দলটি। সিপিআই নেতা সত্যনারায়ণ সিং প্রকাশ্যেই যাদবকে ‘অনির্ভরযোগ্য’ বলেছেন।
দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীর আরেক ঘনিষ্ঠ সহযোগী দাবি করেছেন, বামদের প্রতি মানুষের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া কানহাইয়ার পরাজয়ে ভূমিকা রেখেছে। অপর এক সহযোগীর কথায়, এক ব্যক্তি পুরো দলকে পুনর্জাগরিত করে ফেলবে- এমনটা প্রত্যাশা কেউ করতে পারে না। বামদলগুলো হিন্দি বলয়ে ঘুমাচ্ছে।
হাফিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, উৎসাহী ও কানহাইয়ার প্রচারণা টিমের লোকেরা তাদের সমাবেশে প্রচুর জনসমাবেশ ঘটাতে পারলেও তারা দেশের নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের প্রতি নজর রাখতে পারেননি। কানহাইয়ার দল বুথ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা দেখিয়েছে। এমনকি তারা একটি বুথে ন্যুনতম প্রয়োজনী সংখ্যক এজেন্ট দিতে পারেনি। দলের কর্মীরা কতটা কার্যকরভাবে বুথ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা দেখাচ্ছে তা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভোটের দিন কেন্দ্রে ভোটাররা উপস্থিত হওয়ার পর জনমত নিজেদের দিকে টেনে আনার দায় বর্তায় বুথ কর্মীদের ঘাড়েই। কানহাইয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় তুলতে পারেন, দিতে পারেন জ্বালাময়ী ভাষণ। কিন্তু তিনি যে মঞ্চ প্রস্তুত করলেন তা ধারণ করার মতো মাঠে কেউ ছিল না।
বিহারের অধিকাংশ ভোটার ভূমিহার জনগোষ্ঠী। তারা বিজেপিকেই সমর্থন দিয়েছে। আর দলিত-মুসলিমদের ভোট ভাগ হয়েগেছে কানহাইয়া ও তানভীরের মধ্যে।
অবশ্য বিজেপির বেগুসরাইয়ের নেতা রাজনিশ সিংয়ের দাবি, মোদির সরকারের উন্নয়নের কারণেই আসনের ফল তাদের পক্ষে গেছে। তিনি বলেন, বেগুসরাইয়ের মানুষ হিন্দু-মুসলিম বিভাজনে বিশ্বাস করেন না। গত নির্বাচনে ভোলা সিং নির্বাচিত হওয়ার পর এলাকায় অনেক উন্নয়ন হয়েছে। বেগুসরাইয়ের মানুষ উন্নয়নের পক্ষে ভোট দিয়েছে।
কানহাইয়ার সহযোগীদের ইভিএম কারচুপির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এই বিজেপি নেতা।