X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘বিশ্বাসী’ থেকে বাগদাদির স্বঘোষিত ‘খলিফা ইব্রাহিম’ হয়ে ওঠা

বিদেশ ডেস্ক
২৮ অক্টোবর ২০১৯, ১৭:৩৭আপডেট : ২৯ অক্টোবর ২০১৯, ২৩:৪৫

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মার্কিন কমান্ডোদের এক অভিযানে নিহত হয়েছেন জিহাদি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা আবু বকর আল-বাগদাদি। ট্রাম্পের দাবি অনুসারে তাকে হত্যার পর ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাগদাদির উত্থান নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে তার কিশোর বয়স থেকে আইএসের ‘খলিফা ইব্রাহিম’ হয়ে ওঠার কথা উঠে এসেছে।

বাগদাদির আসল নাম ইব্রাহিম আওয়াদ ইব্রাহিম আল-বাদরি

স্বঘোষিত ‘খলিফা ইব্রাহিম’-এর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা ২৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছে। পাঁচ বছর পূর্বে আইএসের উত্থানের সময় থেকেই এই পুরস্কার বহাল ছিল।

উত্থানের চূড়ান্ত সময়ে আইএস সিরিয়ার পশ্চিমাঞ্চল ও ইরাকের পূর্বাঞ্চল মিলিয়ে প্রায় ৮৮ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতো। দখলকৃত এলাকায় থাকা ৮০ লাখ মানুষের ওপর নির্মম ও নৃশংস শাসন জারি করে। তেল বিক্রি, চাঁদাবাজী ও অপহরণ বাণিজ্যের মাধ্যমে হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি ডলার। কিন্তু দখলকৃত অঞ্চল থেকে উচ্ছেদ হলেও জঙ্গি গোষ্ঠীটির নেতা ও সদস্যরা সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে যুদ্ধ পিপাসু রয়েছে এবং পরাজয় মেনে নিতে রাজি না।

‘বিশ্বাসী’

বাগদাদির আসল নাম ইব্রাহিম আওয়াদ ইব্রাহিম আল-বাদরি। মধ্য ইরাকের সামারা এলাকায় ১৯৭১ সালে তার জন্ম।

বাগদাদির সুন্নি আরব পরিবারের দাবি, তারা মুহাম্মদ (সা.) এর কোরাইশ জাতির বংশধর। খলিফা হওয়ার জন্য এট গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা বলে আধুনিক সুন্নি ধর্মবিদরা সাধারণভাবে মনে করেন।

শৈশবে তাকে আত্মীয়রা বিশ্বাসী বলে ডাকতেন। কারণ ওই সময় বাগদাদি স্থানীয় মসজিদে কোরআন তেলাওয়াত শিখতেন এবং ইসলামি আইন ও শরিয়া মেনে চলতেন।

আইএস প্রকাশিত বাগদাদির জীবন বৃত্তান্ত অনুসারে, ১৯৯০ দশকের শুরুর দিকে স্কুলের অধ্যয়ন শেষে রাজধানী বাগদাদে আসেন তিনি। ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব বাগদাদ থেকে ইসলামি শিক্ষায় মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রিও লাভ করেন।

ছাত্র জীবনে তিনি বাগদাদের উত্তর-পশ্চিমের তোবচি জেলার একটি সুন্নি মসজিদের কাছে বাস করতেন। বলা হয়েছে, তিনি সব সময় চুপচাপ থাকতেন। ব্যতিক্রম ছিল কোরআন তেলাওয়াত শেখানো এবং মসজিদের ক্লাবের হয়ে ফুটবল খেলার সময়। ওই সময় বাগদাদি সালাফিবাদ ও জিহাদিবাদে বিশ্বাসী হয়ে পড়েন বলে ধারণা করা হয়।

এই ক্যাম্প বুক্কাতে ১০ মাস বন্দি ছিলেন বাগদাদি

‘জিহাদি বিশ্ববিদ্যালয়’

২০০৩ সালে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন অভিযানের পর বাগদাদি জামায়াত জয়েশ আহল আল-সুন্নাহ ওয়াল জামাহ নামের একটি ইসলামি বিদ্রোহী গোষ্ঠী গড়ে তুলতে সহযোগিতা করেন। এই গোষ্ঠীটি যুক্তরাষ্ট্রের সেনা ও তাদের মিত্রদের ওপর হামলা চালায়। গোষ্ঠীটির শরিয়া কমিটির প্রধান ছিলেন বাগদাদি।

২০০৪ সালের শুরুর দিকে বাগদাদিকে পশ্চিম বাগদাদের ফালুজা শহর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা গ্রেফতার করে। পরে তাকে দক্ষিণের ক্যাম্প বুক্কার আটককেন্দ্রে নেওয়া হয়। বলা হয়ে থাকে এই ক্যাম্প বুক্কাকে আইএসের ভবিষ্যৎ নেতা ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করতেন। এখানে তিনি বন্দিদের জঙ্গি মতাদর্শে রূপান্তর এবং গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ ও নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন।

জানা গেছে, বাগদাদি আটককেন্দ্রে নামাজে ইমামতি করতেন, খুৎবা দিতেন এবং ধর্মীয় বিষয় শেখাতেন। মাঝে মধ্যেই তাকে যুক্তরাষ্ট্রের কারা প্রশাসকরা মধ্যস্থতার জন্য ডাকতেন। ওই সময় তাকে খুব বেশি হুমকি মনে করেনি যুক্তরাষ্ট্র। দশমাস পর তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।

২০১৪ সালে এক পেন্টাগন কর্মকর্তা নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছিলেন, ২০০৪ সালে আমরা যখন তাকে গ্রেফতার করি তখন সে বড় কোনও কিছু ছিল না। তখন আমাদের পক্ষে ধারণা করা মুশকিল ছিল যে, একদিন সে আইএস প্রধান হয়ে যাবে।

২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন অভিযানের পর আল-কায়েদায় যোগ দেন তিনি

ইরাকে আল-কায়েদা পুনর্গঠন

ক্যাম্প বুক্কা ছেড়ে যাওয়ার পর বাগদাদি নতুন করে গঠিক আল-কায়েদা ইরাকের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলেন বলে ধারণা করা হয়। জর্ডানি আবু মুসাব আল-জারকাউয়ির নেতৃত্বে এই গোষ্ঠীটি ইরাকে গুরুত্বপূর্ণ সশস্ত্র সংগঠনে পরিণত হয়। শিরশ্ছেদসহ নৃশংসতার জন্য কুখ্যাতি অর্জন করে।

২০০৬ সালের শুরুর দিকে আল-কায়েদা ইরাক মুজাহিদিন শুরা কাউন্সিল নামের একটি জিহাদি সংগঠন গড়ে তুলে। এই গোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে যোগ দেন বাগদাদি। ওই বছরের শেষের দিকে জারকাউয়ি যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলায় নিহত হলে সংগঠনটি নিজেদের নাম পরিবর্তন করে রাখে ইসলামিক স্টেট অব ইরাক (আইএসআই)। বাগদাদি আইএসআই’র শরিয়া কমিটির তদারকি করতে এবং শুরা কাউন্সিলে যোগ দেন। ২০১০ সালে আইএসআই নেতা আবু উমর আল-বাগদাদি তার উপ-প্রধান আবু আইয়ুব আল-মাসরিসহ নিহত হলে নতুন প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন আবু বকর আল-বাগদাদি।

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কর্মকর্তাদের ধারণা, বাগদাদি এমন একটি সংগঠনের দায়িত্ব নেন যা কৌশলগতভাবে ভেঙে পড়ার পর্যায়ে ছিল। কিন্তু সাদ্দাম যুগের কয়েকজন সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা, যারা ক্যাম্প বুক্কাতে তার সঙ্গে বন্দি ছিল, তাদের সহযোগিতায় ধীরে ধীরে আইএসআইকে পুনর্গঠন করেন।

মসুলের একটি মসজিদে খুৎবা দিচ্ছেন বাগদাদি

খলিফা ইব্রাহিম

২০১৩ সালের শুরুর দিকে ইরাকে এক মাসে বেশ কয়েকটি হামলা চালায় সংগঠনটি। একই সময়ে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদবিরোধী বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেয় তারা। ইরাক থেকে সিরীয় যোদ্ধাদের পাঠিয়ে আল-কায়েদার সহযোগী হিসেবে গড়ে তোলা হয় আল-নুসরা ফ্রন্ট। সেখানে তারা অস্ত্রের ভাণ্ডার পেয়ে যায়।

এপ্রিলে বাগদাদি ইরাক ও সিরিয়ায় তার যোদ্ধাদের একীভূত করার ঘোষণা দেন ‘ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ত’ বা আএস গঠনের মধ্য দিয়ে। আল-নুসরা ও আল-কায়েদা বাগদাদির এই ঘোষণা মেনে নেয়নি। তবে বাগদাদির প্রতি অনুগতরা আল-নুসরা থেকে বের হয়ে সিরিয়ায় আইএসকে সহযোগিতা করে।

২০১৩ সালের শেষ দিকে আইএস সিরিয়া থেকে নিজেদের মনোযোগ ইরাকে কেন্দ্রীভূত করে। ওই সময় শিয়া নেতৃত্বাধীন সরকার ও সংখ্যালঘু সুন্নি আরব সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক অচলাবস্থার সুযোগ নেয় তারা। আদিবাসী ও সাদ্দাম হোসেনের অনুগতদের সহযোগিতায় তারা ফালুজার দখল নিতে সক্ষম হয়।

২০১৪ সালের জুন মাসে কয়েকশ আইএস জঙ্গি মসুল থেকে ইরাকি সেনাদের হটিয়ে দখল নেয়। এরপর বাগদাদের দিকে এগুতে থাকে। এই অভিযানে তারা শত্রুদের ব্যাপক আকারে হত্যা করে এবং অনেক আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদ ও হত্যার হুমকি দেয়।

রাক্কাতে আইএস সদস্যদের উদযাপন

ওই মাসের শেষ দিকে বেশ কয়েকটি ইরাকি শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর আইএস নিজেদের খিলাফত ঘোষণা করে। তারা এটিকে ইসলামিক স্টেট হিসেবে নামকরণ করে। তাদের দাবি অনুসারে, এই খিলাফত পরিচালিত হতো পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলিফা দ্বারা শরিয়া মোতাবেক। আইএস বাগদাদিকে ‘খলিফা ইব্রাহিম’ হিসেবে হাজির করে এবং মুসলিম বিশ্বকে তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশের দাবি জানায়।

পাঁচদিন পর প্রথমবারের মতো বাগদাদির একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, মসুলের আল-মসজিদে খুৎবা দিচ্ছেন তিনি। ওই বক্তৃতায় বিশ্বের মুসলিমদের তাদের দখলকৃত এলাকায় যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। একইসঙ্গে তিনি অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আহ্বান জানান। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে কয়েক হাজার বিদেশি যোদ্ধা আইএসে যোগ দেয়।

এক মাসের মাথায় আইএস জঙ্গিরা ইরাকের কুর্দি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় অগ্রসর হয়। অভিযানে তারা কয়েক হাজার ইয়াজিদি ও কুর্দিকে বন্দি করে। এরপর ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট বিমান হামলা চালায়। সেপ্টেম্বরে বেশ কয়েকজন পশ্চিমা বন্দির শিরশ্ছেদের পর সিরিয়া হামলা শুরু করে জোট।   

/এএ/
সম্পর্কিত
ইসরায়েলের আকরে শহরে হামলার দাবি করলো হিজবুল্লাহ
গাজার হাসপাতালে গণকবর, আতঙ্কিত জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধান
ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে গিয়ে অন্তত ৫ অভিবাসী নিহত
সর্বশেষ খবর
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা