X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাবরি মসজিদের স্থলে মন্দির নির্মাণের রায় স্ববিরোধী?

বিদেশ ডেস্ক
১০ নভেম্বর ২০১৯, ১৫:২৭আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০১৯, ১৭:৫৫
image

ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ মামলার রায়কে বিতর্কিত মনে করছেন অনেকেই। শনিবার ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া রায়ে বিরোধপূর্ণ ওই ভূমিতে হিন্দুদের জন্য মন্দির নির্মাণের নির্দেশ দেওয়া হয় এবং সেটা তদারকির জন্য একটি ট্রাস্ট গঠনের কথা বলা হয়। এর পরিবর্তে মুসলিমদের মসজিদ নির্মাণের জন্য অযোধ্যারই অন্য কোনও স্থানে ৫ একর ভূমি বরাদ্দ দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। রায় বিশ্লেষণ করে এ নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছেন সাংবাদিক শ্রুতিসাগর ইয়ামুনান। এই রায়ে স্ববিরোধিতা পেয়েছেন সে দেশের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায়। হায়দরাবাদের নালসার আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফয়জান মুস্তাফাও রায়টিকে বিতর্কিত আখ্যা দিয়েছেন।

বাবরি মসজিদের স্থলে মন্দির নির্মাণের রায় স্ববিরোধী?

দীর্ঘ শুনানির পর ২০১০ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্টের তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত প্যানেল বাবরি মসজিদের ভূমি তিন ভাগে ভাগ করে বণ্টনের আদেশ দেয়। আদালত মুসলিম ওয়াকফ বোর্ড, নির্মোহী আখড়া আর রামনালা পার্টিকে সেখানকার ২ দশমিক ৭ একর জমি সমানভাগে ভাগ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। হিন্দু-মুসলিম দুই পক্ষই সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে আপিল করেছিল। সেই আপিল নিষ্পত্তি করতে গিয়ে শনিবার সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছেন, সমভাবে ভূমি-বণ্টন করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল।

সাংবাদিক শ্রুতিসাগর ইয়ামুনান স্ক্রল ইনে লিখেছেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অসঙ্গতি রয়েছে। সেখানে মুসলিম ও হিন্দুদের ক্ষেত্রে সমতা নিশ্চিত করা হয়নি। সুপ্রিম কোর্ট যাকে আইনের লঙ্ঘন বলার পরও হিন্দুদের মন্দির নির্মাণের জন্য জমি বরাদ্দ করা হয়েছে।  

১৯৪৯ সালের মূর্তি

১৯৪৯ সাল পর্যন্ত বাবরি মসজিদকে বৈধভাবে মসজিদই বিবেচনা করা হতো। হিন্দুরাও এর দেয়ালের বাইরে গিয়ে পুজা করতো।  শ্রুতিসাগর ইয়ামুনান লিখেছেন, সে বছর ২৩ ডিসেম্বর ঘটলো অন্যরকম এক ঘটনা। হঠাৎ করেই মসজিদের ভেতরে দেখা মিলল রামের মূর্তির। তখনই যেন এটা মন্দিরে রুপ নেয়। দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে যায় যে বিষয়টা হিন্দু মহাসভার ষড়যন্ত্র ছিলো। আর তখন স্থানীয় প্রশাসনও এই বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ নেয়নি।

আদালতের রায়ে বলা হয়েছে,  ‘১৯৪৯ সালের ২২-২৩ ডিসেম্বর মুসলিমদের মসজিদ থেকে বিতাড়িত করে হিন্দু মূর্তি রাখা হয়েছিলো। মুসলিমদের এই সরিয়ে দেওয়ার কাজটি কোনও বৈধ কর্তৃপক্ষ করেনি বরং তা আদতে মুসলিমদের তাদের উপসনালয় থেকে বঞ্চিত করার পরিকল্পিত পদক্ষেপ ছিলো।  এই পবিত্রতা লঙ্ঘন অবৈধ ছিলো এবং সংকট তৈরি করেছিলো।’ শ্রুতিসাগর ইয়ামুনান বলছেন, ‘আদালত মেনে নিয়েছে যে এটা অবৈধ ছিলো-একজন উপাসনালয়ে মূর্তি রেখে আইন ভঙ্গ করেছে। কিন্তু সেখানে আদালত সিদ্ধান্ত দিলো এই স্থান হিন্দুদের দিয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু কাজটা তো সেই একই হলো। ’

সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, ‘১৯৩৪ সালের দাঙ্গার ধারবাহিকতায় ১৯৪৯ সালের ২২-২৩ ডিসেম্বর ওই ঘটনা তীব্র প্রতিযোগিতার জন্ম দেয় যা দুইপক্ষকেই সহিংস করে তোলে এবং মুসলিমদের ভেতরের প্রাঙ্গনে দখল ছিলো না। প্রাপ্ত নথি থেকে এটা বলা যায় না যে মুসলিমরা বিরোধপূর্ণ ওই অঞ্চলের পূর্ণাঙ্গ অংশে তাদের স্থাপনা তৈরি করতে সক্ষম ছিলো।’ শ্রুতিসাগরের মতে, আদালত বলতে চেয়েছে, হিন্দুদের অবৈধ ওই কাজটিই আসলে প্রমাণ যে মসজিদের জায়গাটি হিন্দুদেরই ছিলো তাই এটিই রায়ের প্রামাণ্য।

১৯৯২ সালে ভেঙে ফেলা

১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপি নেতাদের জানার পরও রাষ্ট্রীয় সমাজসেবক সংঘের একদল উগ্র হিন্দু বাবরি মসজিদের নিরাপত্তা প্রাচীর ভেঙে ভেতরে ঢুকে যায় এবং লোহার রড কুড়াল দিয় দেয়াল ভাঙতে থাকে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় পুরো ভবন। মারাত্মক এই গর্হিত কাজটি দিনের আলোতেই ঘটেছিলো। কর্তৃপক্ষ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। আদালত এই ঘটনাকেও অবৈধ বলে ঘোষণা দিয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, ‘১৯৯২ সালের ৫ ডিসেম্বর মসজিদের ভবন ভেঙে ফেলা হয় ও ধ্বংস করা হয়। এটি স্থিতিশীলতা নষ্ট করে। মসজিদ ধ্বংস করা ও ইসলামি স্থাপনা ভেঙে ফেলাটি আইনের গর্হিত লঙ্ঘন।  মুসলিমরা যে তাদের উপাসনার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে সেটা স্বীকার না করলেও কোনোভাবেই ন্যায়বিচার হয় না। ধর্মনিরেপক্ষ দেশে আইনের এমন লঙ্ঘন হওয়া উচিত হয়নি। ’

শ্রুতিসাগর বলছেন, ‘এই রায় দিয়ে মুসলিমদের জন্য অন্যত্র একটি মসজিদ স্থাপনার জন্য জমি দেওয়া হয়। এখন প্রশ্ন থেকে যায়, ওই স্থানে যদি মসজিদটি আজ দাঁড়িয়ে থাকতো তাহলেও কি আদালত এই রায় দিতো?  তার মতে, সুপ্রিম কোর্টের জন্য দুটি বিষয়ই অবৈধ ছিলো। এর ওপর ভিত্তি করেই সুপ্রিম কোর্ট চূড়ান্ত রায় দেয়। আর সেটা হিন্দুদের পক্ষেই গেল। বিরোধপূর্ণ ওই অঞ্চলেই মন্দির বানানোর অনুমতি পেল তারা।’

অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায় আনন্দবাজার পত্রিকায় লিখেছেন, ‘চারশো-পাঁচশো বছর ধরে একটা মসজিদ একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল। সেই মসজিদকে আজ থেকে ২৭ বছর আগে ভেঙে দেওয়া হলো বর্বরদের মতো আক্রমণ চালিয়ে। আর আজ দেশের সর্বোচ্চ আদালত বলল, ওখানে এবার মন্দির হবে। সাংবিধানিক নৈতিকতা বলে তো একটা বিষয় রয়েছে! এমন কোনও কাজ করা উচিত নয়, যাতে দেশের সংবিধানের উপর থেকে কারও ভরসা উঠে যায়। আজ অযোধ্যার ক্ষেত্রে যে রায় হলো, সেই রায়কে হাতিয়ার করে ভবিষ্যতে এই রকম কাণ্ড আরও ঘটানো হবে না, সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবেন? শুধু অযোধ্যায় নয়, মথুরা এবং কাশীতেও একই ঘটনা ঘটবে— এ কথা আগেই বলা হতো। যাঁরা গুন্ডামি করে বাবরি মসজিদ ভেঙেছিলেন, তাঁরাই বলতেন। এখন আবার সেই কথা বলা শুরু হচ্ছে। যদি সত্যিই মথুরা বা কাশীতে কোনও অঘটন ঘটানো হয় এবং তার পরে মামলা-মোকদ্দমা শুরু হয়, তা হলে কী হবে? সেখানেও তো এই রায়কেই তুলে ধরে দাবি করা হবে যে, মন্দিরের পক্ষেই রায় দিতে হবে বা বিশ্বাসের পক্ষেই রায় দিতে হবে।’

তিনি আরও লিখেছেন, অযোধ্যা মামলা এর আগেও সুপ্রিম কোর্টে উঠেছে। তখনই আদালত স্বীকার করে নিয়েছিল যে, বিতর্কিত জমিতে মসজিদ ছিল। যেখানে বছরের পর বছর ধরে নামাজ পড়া হচ্ছে, সেই স্থানকে মসজিদ হিসেবে মান্যতা দেওয়া উচিত, এ কথা আদালত মেনে নিয়েছিল। তা হলে আজ এই নির্দেশ এল কিভাবে? যেখানে একটা মসজিদ ছিল বলে সুপ্রিম কোর্ট নিজেই মেনেছে, সেখানে আজ মন্দির বানানোর নির্দেশ সেই সুপ্রিম কোর্টই দিচ্ছে কোন যুক্তিতে? তার মতে, ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ করা তো আদালতের কাজ নয়। আদালত সিদ্ধান্তে পৌঁছায় অকাট্য প্রমাণ এবং প্রামাণ্য নথিপত্রের ভিত্তিতে। বাবরি মসজিদ যেখানে ছিল, সেই জমিতে মন্দির তৈরির নির্দেশ সুপ্রিম কোর্ট কোন অকাট্য প্রমাণ ও প্রামাণ্য নথির ভিত্তিতে দিলো, সেটা বুঝতে আমার অসুবিধা হয়েছে। বাবরি মসজিদ যে ওখানে ছিল, পাঁচ শতাব্দী ধরে ছিল, সে আমরা সবাই জানি। বাবরি মসজিদ যে গুন্ডামি করে ভেঙে দেওয়া হলো, সেটাও আমরা দেখেছি। এমনকি সুপ্রিম কোর্ট এ দিনের রায়েও মেনে নিয়েছে যে, অন্যায়ভাবে মসজিদটা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৫২৮ সালের আগে ওখানে রাম মন্দির ছিল কি না, আমরা কেউ কি নিশ্চিতভাবে জানি? রাম মন্দির ভেঙেই বাবরি মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল, এমন কোনও অকাট্য প্রমাণ কি কেউ দাখিল করতে পেরেছিলেন? পারেননি। তা সত্ত্বেও যে নির্দেশটা শীর্ষ আদালত থেকে এলো, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকা স্বাভাবিক নয় কি?

এদিকে ‘ধর্ম ও বিশ্বাস নয়, আইন অনুযায়ী তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে’ রায় দেওয়া হয়েছে দাবি করলেও এটিকে বিতর্কিত মনে করছেন হায়দরাবাদের নালসার আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফয়জান মুস্তাফা। তিনি কাতারভিত্তিক আলজাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ভারসাম্য রক্ষার জন্য বিচারকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আইনের শাসনের উপর ধর্মের খড়গ পড়েছে। কারণ বিচারকরা বলেছেন, হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস নিয়ে তাদের কিছু করার নেই এবং যদি তারা বিশ্বাস এখানে রাম জন্ম গ্রহণ করেছেন... তাহলে আমাদের তা মেনে নিতে হবে। ধর্মের ক্ষেত্রে বিশ্বাস গুরুত্বপূর্ণ।’ তার প্রশ্ন, ‘যখন ভূমির বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয় তখন তা কি ভিত্তি হতে পারে?’

/এমএইচ/বিএ/
সম্পর্কিত
জলপাইগুড়িতে বিজেপির ইস্যু বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া করিডর
ইডি হেফাজতে আরও ৪ দিন কেজরিওয়াল
সরকার ক্ষমতায় থাকতে ভোটের ওপর নির্ভর করে না: সাকি
সর্বশেষ খবর
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি