পরপর দুইবার ব্রিটেনের পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক। লন্ডনের একই আসন থেকে এবার তৃতীয়বারের মতো প্রার্থী হয়েছেন। তার সামনে এখন হ্যাটট্রিক জয়ের চ্যালেঞ্জ। ১২ ডিসেম্বরের নির্বাচনের প্রাধান্যের কেন্দ্রে রয়েছে ব্রেক্সিট ইস্যু। কোনও দল কিংবা প্রার্থীর চেয়ে ব্রেক্সিট প্রশ্নে ভোটারদের অবস্থানই ফল নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর বোন শেখ রেহানার দ্বিতীয় সন্তান টিউলিপ তার ব্যক্তিগত ইমেজের কারণে আবারও জয়ী হতে পারেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নিজ আসনের পূর্ব ইউরোপীয় ও মুসলিম ভোটারদের সমর্থন টিউলিপের জয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনের আর ২৩ দিন বাকী। নির্বাচনে যে পাঁচ-ছয়টি আসনের জয়-পরাজয় নিয়ে ভোটার ও ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের উন্মুখ দৃষ্টি; তার একটি হলো টিউলিপের হ্যামপস্টেড ও কিলবার্ন। লন্ডনের আসনগুলোর মধ্যে এবারও সেখানেই সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোটের লড়াই হবে। নব্বইয়ের দশক থেকে এ আসনটি ব্রিটেনের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আসনগুলোর তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে।
১৯৯২ সাল থেকে অস্কারজয়ী বরেণ্য অভিনেত্রী গ্ল্যান্ডা জ্যাকসন দীর্ঘ ২৩ বছর হ্যামপস্টেড ও কিলবার্ন আসন থেকে লেবার পার্টির প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০১০ সালের নির্বাচনে তিনি মাত্র ৪২ ভোটে জয় পান। তার পর এই আসনে প্রার্থী হন টিউলিপ। ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. শফিক সিদ্দিক ও শেখ রেহানা দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে টিউলিপ দ্বিতীয়। তার মা বাবার বিয়েও হয়েছিল এই কিলবার্নেই। ২০১৫ সালে এ আসন থেকে প্রথমবার নির্বাচিত হন টিউলিপ। ওই নির্বাচনে ২৩,৯৭৭ ভোট পান তিনি। ২০১৭ সালের নির্বাচনে তিনি ৩৪,৪৬৪ ভোট পেয়ে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হন। লন্ডনে জন্ম নেওয়া টিউলিপ ১৬ বছর বয়সে লেবার পার্টির সদস্য হয়ে যুক্ত হন ব্রিটিশ রাজনীতিতে। আইনপ্রণেতা হওয়ার আগে তিনি ক্যামডেনের কাউন্সিলর ছিলেন।
দুই দফায় আইনপ্রণেতা হওয়ার পর ব্রিটেনের নানা রাজনৈতিক ইস্যুতে পার্লামেন্টের ভেতরে-বাইরে রীতিমত ঝড় তুলতে সক্ষম হন টিউলিপ। সাড়ে চার বছরের কম সময় দায়িত্ব পালন করেই তিনি ব্রিটেনের রাজনীতি ও সংবাদমাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসেন। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজ আসনে প্রচার প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন টিউলিপ।
পূর্ব লন্ডনে যেমন বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের আধিপত্য রয়েছে, হ্যামপস্টেড ও কিলবার্নে তা নেই। এই আসনে জয়-পরাজয়ের অন্যতম নিয়ামক স্থানীয় ইহুদি সম্প্রদায়। তাদেরকে কাছে টানার চেষ্টায় রয়েছেন টিউলিপ। গত নির্বাচনে কনজারভেটিভ প্রার্থী ক্লারে লিউস এই আসন থেকে ১৮,৯০৪ ভোট পান, যা মোট ভোটের ৩২.৪ শতাংশ। আর টিউলিপ পান মোট ভোটের ৫৯ শতাংশ। এই আসনে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলের নতুন প্রার্থী জনি লুক। তবে এবার সেখানে লেবার পার্টির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী লিবারেল ডেমোক্রেট (লিবডেম)।
নির্বাচনি জরিপে লিবডেম প্রার্থী ম্যাথ স্যান্ডারর্স খানিকটা এগিয়ে থাকলেও তিন প্রার্থীর মধ্যে টিউলিপই সব থেকে পরিচিত মুখ। ব্যক্তি ইমেজের দিক থেকেও তিনি এগিয়ে রয়েছেন। লেবার পার্টির কর্মী বাহিনীর পাশাপাশি তার ব্যক্তিগত অনুরাগী-সমর্থকরাও লিফলেট আর হ্যান্ডবিল নিয়ে ছুটছেন ঘরে ঘরে। ধারণা করা হচ্ছে, দুইবার আইনপ্রণেতা হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় নিজ আসনের জনগণের প্রতি টিউলিপ যে সংবেদনশীল ও বিনয়ী আচরণ করেছেন, তা তাকে এবারের নির্বাচনে বাড়তি সুবিধা দেবে।
ভোটার ও সাধারণ মানুষের কাছে টিউলিপের ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও এবারের নির্বাচনে তা কতোটা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে, তা নিয়ে অবশ্য খানিকটা সংশয় রয়েছে। প্রভাবশালী জরিপ সংস্থা ইউগভ-এর সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, আগামী ১২ই ডিসেম্বরের আগাম নির্বাচনের ফলাফলের কোনও নির্ভরযোগ্য পূর্বাভাষ পাওয়া যাচ্ছে না৷ সমীক্ষা অনুযায়ী প্রায় ৮৬ শতাংশ ব্রিটিশ ভোটার এই মুহূর্তে মূলত ব্রেক্সিটের পক্ষে অথবা বিপক্ষে অবস্থান নিতে ব্যস্ত৷ কোনও নির্দিষ্ট দলের প্রতি আনুগত্য সে ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করছে না৷
ক্ষমতায় ফিরলে কনজারভেটিভ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন জানুয়ারি মাসের শেষে ব্রেক্সিট কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন৷ অন্যদিকে লেবার দলের নেতা জেরেমি করবিন ক্ষমতায় এলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে দর কষাকষি করে ব্রেক্সিট চুক্তিতে রদবদল করে দ্বিতীয় গণভোটের অঙ্গীকার করছেন৷ লেবার পার্টির শতাধিক প্রার্থীর সঙ্গে টিউলিপও ‘রিমেইন লেবার ক্যাম্পেইন প্লেডজ’ নামের এক কর্মসূচিতে রয়েছেন। এর আওতায় তারা অঙ্গীকার করেছেন, ‘আমরা আবার গণভোট আয়োজনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা চাই আপনারা আপনাদের চূড়ান্ত রায় দেওয়ার সুযোগ পান। আমি পুনরায় এমপি নির্বাচিত হলে, ইইউয়ে থাকার চেষ্টা করবো।’ ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যম ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতেও, জাতীয় ইস্যু হিসেবে এবার ব্রেক্সিটই নির্বাচনি আসনগুলোর জয়-পরাজয়ের প্রধান নিয়ামক হবে।
টিউলিপ সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘যেখানে আমি বেড়ে উঠেছি, পার্লামেন্টে সেই আসনের প্রতিনিধিত্ব করা আমার জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। আমি হ্যামপস্টেড ও কিলবার্নে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রতিনিধি নই, আমি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এই আসনের মানুষের প্রতিনিধি।’ ব্যয় সংকোচন ও অভিবাসীবিরোধী অবস্থানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি ভোটারদের উদ্দেশে বলেন, ভোট দেওয়া না দেওয়ার ক্ষেত্রে যেন আমার অতীত কাজগুলোকে বিবেচনায় নেওয়া হয়।
হ্যামপস্টেড ও কিলবার্নের ভোটার ব্রিটিশ বাংলাদেশি জুবেরা রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা এবারও টিউলিপকে ভোট দেব। আমাদের যে কোনও দরকারে, সুবিধা-অসুবিধায় তাকে সব সময় পাশে পাওয়া যায়। ভোট না দেওয়ার কোনও কারণই নেই।’
গত দুইবারের নির্বাচনে যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতাকর্মীরা লন্ডনের অন্যান্য স্থান থেকে হ্যামপস্টেড ও কিলবার্নে গিয়ে টিউলিপের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন। তবে কনজারভেটিভ ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ ক্যামডেনের চেয়ারম্যান ও পার্টির মনোনীত কাউন্সিলর প্রার্থী শাহীন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘যেহেতু টিউলিপ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এবং আমিও একজন ব্রিটিশ বাংলাদেশি, সে কারণে এবার আমি এই আসনে কনজারভেটিভ পার্টির পক্ষে প্রচারণায় না নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটা আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।’
ড. রেনু লুৎফা লেখক ও অধ্যাপক। চার দশক ধরে বসবাস করছেন লন্ডনে। আসন্ন নির্বাচনে টিউলিপ সিদ্দিকের জয়ের সম্ভাবনা কতটুকু এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এলাকার ভোটারদের কাছে তার জনপ্রিয়তা অনেক। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ব্রিটেনে আমন্ত্রণ জানানোর বিরোধিতা করে টিউলিপ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা পার্লামেন্টের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। তা ছাড়া কিলবার্নে বিপুল সংখ্যক মুসলিম ও পূর্ব ইউরোপীয় ভোটার রয়েছে। তাদের সমর্থন থাকবে টিউলিপের প্রতি।’