পানামা পেপারস-এ বিশ্বের প্রভাবশালীদের কর জালিয়াতি নিয়ে দুনিয়াজুড়ে যখন হইচই চলছে, তখন বাংলাদেশেও একটি প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসছে। এই তালিকায় এখানকার কেউ কি নেই? জবাব হচ্ছে, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কারও নাম প্রকাশ করা হয়নি। তবে পানামা পেপারস-এ প্রকাশিত তালিকা পূর্ণাঙ্গ নয়। পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ হলে জানা যাবে, বাংলাদেশের কারও নাম আছে কি নেই।
তবে ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস আইসিআইজে-এর দেশভিত্তিক তালিকা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশি ৩৪ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাগুজে বা ভুয়া কোম্পানি আছে। তবে বাংলা ট্রিবিউনের পক্ষ থেকে ওই ৩৪ ব্যক্তির কয়েকজনকে টেলিফোন করলেও এ ব্যাপারে কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি তাদের অফিসেও। ২০১৩ সালে ওইসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ করে আইসিআইজে। এরপর আর কোনও নতুন তথ্য যোগ হয়নি। পানামা পেপারস এবার যে তালিকা প্রকাশ করে তার সূত্রও আইসিআইজে।
২০১৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে অফশোর কোম্পানির এক গোপন নথি ফাঁস করে, ব্রিটিশ ভার্জিনিয়া আইল্যান্ডসভিত্তিক কমনওয়েলথ ট্রাস্ট এবং সিঙ্গাপুরভিত্তিক পোর্টকিউলিস ট্রাস্টনেট নামক দুটি আইনি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ২৫০ গিগাবাইট তথ্য ফাঁস করে। এতে প্রায় ১৭০টি দেশের মানুষের নাম সামনে আসে। প্রকাশিত তালিকায় স্থান পায় বাংলাদেশের ৩৪ প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।
তালিকায় থাকা বাংলাদেশের ৩৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান
১. এ এস এম মহিউদ্দিন মোমেন
২. এ এফ এম রহমতুল বারী
৩. আসমা মোমেন
৪. আজমত মুঈন
৫. বাংলা ট্র্যাক লিমিটেড
৬. বিবিটিএল
৭. ক্যাপ্টেন এম এ জাউল
৮. দিলীপ কুমার মোদি
৯. দিলীপ কুমার মোদি
১০. এফ এম জুবাইদুল হক
১১. এফ এম জুবাইদুল হক এবং সালমা হক
১২. জাফর উমেদ খান
১৩. কাজী রায়হান জাফর
১৪. খাজা শাহাদাত উল্লাহ
১৫. মাহতাবুদ্দিন চৌধুরী
১৬. মীর্জা এম ইয়াহিয়া
১৭. মোহাম্মদ আমিনুল হক
১৮. মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম
১৯. মোহাম্মদ শহীদ মাসুদ
২০. মোহাম্মদ শহীদ মাসুদ
২১. মোহাম্মদ ফয়সল করিম খান
২২. নজরুল ইসলাম
২৩. নাজিম আসাদুল হক
২৪. নিলুফার জাফরুল্লাহ
২৫. সালমা হক
২৬. সৈয়দ সিরাজুল হক
২৭. সৈয়দা সামিনা মীর্জা
২৮. তারিক ইকরামুল হক
২৯. উম্মেহ রুবানা
৩০. জাফরুল্লাহ কাজী
৩১. জাফরুল্লাহ কাজী এবং জাফরুল্লাহ নিলুফার
৩২. জাফরুল্লাহ নিলুফার
৩৩. খাজা শাহাদাত উল্লাহ
৩৪. জুলফিকার হায়দার
তালিকার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিস্তারিত
ওই তালিকায় রয়েছে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ, তার স্ত্রী নিলুফার জাফর এমপি-র নাম। তারা ২০০৬ সালের ২৭ জুলাই ব্রিটিশ ভার্জিনিয়া আইল্যান্ডসে শেল বা মেকি কোম্পানি হাসনিয়াটিক লিমিটেড গঠন করেন। কাজী জাফরুল্লাহ, তার স্ত্রী নিলুফার জাফর ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। একইদিনে তারা পাথফাইন্ডার ফাইন্যান্স নামক আরেকটি কাগুজে কোম্পানিও গঠন করেন। সুইস ব্যাংকের সিঙ্গাপুর ব্রাঞ্চের মাধ্যমে ব্রিটিশ ভার্জিনিয়া আইল্যান্ডসে অর্থপাচার করেন বলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। ২০০৮ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন কাজী জাফরুল্লাহ, তার স্ত্রী নিলুফার জাফর এবং তাদের দুই পুত্রের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। এর মধ্যে একটি মামলায় কাজী জাফরুল্লাহকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
এ ছাড়া ওই তালিকায় সামিট ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড মার্কেন্টাইল করপোরেশন-এর মালিকপক্ষের নামও রয়েছে। সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ৫ জন ডাইরেক্টর অফশোর কোম্পানির সঙ্গে জড়িত। তারা হলেন কোম্পানির চেয়ারম্যান আজিজ খান, তার স্ত্রী আঞ্জুমান আজিজ খান, তাদের কন্যা আয়েশা আজিজ খান, চেয়ারম্যানের ভাই জাফর উমেদ খান ও আজিজ খানের ভাজিতা মো. ফয়সল করিম খান। এর মধ্যে জাফর উমেদ খান ও মো. ফয়সাল করিম খান বাদে বাকিরা ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসের কোম্পানি নিবন্ধন করিয়েছেন সিঙ্গাপুরের ঠিকানায়।
তালিকায় আরও রয়েছেন ইউনাইটেড গ্রুপের হাসান মাহমুদ রাজা, খন্দকার মইনুল আহসান, আহমেদ ইসমাইল হোসেন ও আখতার মাহমুদ। এছাড়া রয়েছেন ওস্টোর্ন মেরিনের পরিচালক সোহেল হাসান, বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি এ এম এম খান। মোমিন টি-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজমল মইন ও পাট ব্যবসায়ী দিলিপ কুমার মোদির নামও রয়েছে ওই তালিকায়। তারা দুইজনই ২০০৫ সালের মার্চে রাইটস্টার প্রাইভেটের পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার হন।
সি পার্ল লাইন্সের চেয়ারম্যান ড. সৈয়দ সিরাজুল হকের নামও রয়েছে এতে। তাকে সভরিন ক্যাপিটল প্রাইভেটের ডাইরেক্টর বা শেয়ারহোল্ডার হিসেবে দেখানো হয়। এটা নিবন্ধিত হয়েছে ২০১০ সালে। ওই তালিকায় বাংলা ট্র্যাক লিমিটেডের মো. আমিনুল হক, নাজিম আসাদুল হক ও তারিক একরামুল হকের নামও রয়েছে। তাদের অফশোর কোম্পানিকে অর্থয়ন করেছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ক্রেডিট সুজি-র সিঙ্গাপুর ব্রাঞ্চ। ওই তালিকায় আরও নাম রয়েছে মাসকট গ্রুপের চেয়ারম্যান এফ এম জুবাইদুল হকের। তিনি তার স্ত্রী সালমাসহ অফশোর কোম্পানি শোর ইন্টারন্যাশনালের ডাইরেক্টর বা শেয়ারহোল্ডার হন ২০০৭ সালের মে-তে। তালিকায় আরও নাম রয়েছে সেতু করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহতাবুদ্দিন চৌধুরীর। স্ত্রী উম্মেহর সঙ্গে তিনি ২০০৭ সালের আগস্টে তালাভেরা ওয়ার্ল্ডওয়াইডের ডাইরেক্টর বা শেয়ারহোল্ডার হন। অমনিকেম লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইফতেখারুল আলম এবং তার পুত্রবধূ ফৌজিয়া নাজও রয়েছেন তালিকায়।
আবদুল মোনেম লিমিটেডের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম মহিউদ্দিন আহমেদ ও তার স্ত্রী আসমা মোনেমের নামও রয়েছে ওই তালিকায়। তারা ২০০৮ সালের জুনে অফশোর কোম্পানি ম্যাগনিফিসেন্ট ম্যাগনিটিউডের ডাইরেক্টর বা শেয়ারহোল্ডার হয়েছেন। তালিকায় আরও নাম রয়েছে অনন্ত গ্রুপের শরিফ জাহিরের। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি সিপিএটি (সিঙ্গাপুর) প্রাইভেট লিমিটেডের ডাইরেক্টর হন।
ওই তথ্য ফাঁস এবং অফশোর কোম্পানিকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালে বাংলাদেশের ইংরেজি সংবাদমাধ্যম নিউ এজ-এ প্রখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানের লেখা বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ১৪ জুলাই ২০১৩ তারিখে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশি বিজনেসমেনস লিঙ্ক টু অফসোর কোম্পানিজ রিভিলড’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি তখন ব্যাপক সাড়া ফেলে।
কাগুজে বা ভুয়া কোম্পানি থাকার ব্যাপারে ওই ৩৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাউকে কাউকে টেলিফোন করা হয় বাংলা ট্রিবিউনের তরফ থেকে। তবে এ ব্যাপারে তাদের কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রচলিত আইনানুসারে (ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট ১৯৪৭), কোনও বাংলাদেশি নাগরিক অফশোর কোম্পানি স্থাপন করতে পারবেন না। তবে দেশের বাইরে কোনও শাখা খুলতে পারবেন। অর্থাৎ অফশোর কোম্পানি স্থাপন করাটা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে প্রাপ্ত তথ্যমতে, তালিকা প্রকাশের পর ওই ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সূত্র: আইসিআইজে।
/এসএ/বিএ/