X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১
ট্রাভেলগ

ঢাকা টু শান্তিনিকেতন: বোলপুরের শরীরে আশ্চর্য দুপুর

আশিক মুস্তাফা
০৬ আগস্ট ২০১৮, ২২:১১আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০১৮, ২৩:১০

বোলপুর স্টেশন থেকে শান্তিনিকেতন প্রবেশমুখে বিশ্বকবির কবিতায় লেখা তোরণ জেট এয়ারওয়েজের বিমান। একটু পরেই উড়াল দেবে। এই প্রথম বিমানে। বিজনেস ক্লাসে আমরা ছয়জন যাত্রী। শিশুসাহিত্যিক আমীরুল ইসলাম ও প্রাবন্ধিক আহমাদ মাযহার ছাড়া বাকি তিনজন অপরিচিত। আমীরুল ইসলাম আমাকে জানালার পাশে দিয়ে বললেন, ‘প্রথম বিমান ট্যুর তোর। জানালায় বস। কাজে দেবে।’ বিমান উড়াল দিলো। এয়ার হোস্টেস গরম তোয়ালে দিয়ে গেলেন। কার লেখায় যেন পড়েছিলাম— গরম তোয়ালের জন্য একজীবনের সব অর্থ ব্যয় করে দিলাম। আহা, এমন তোয়ালের জন্য টাকা ব্যয় করে যথার্থই করেছেন তিনি!

ঢাকার আকাশ ছেড়ে যেতে না যেতেই জুস, নন-ভেজ স্যান্ডউইচসহ রাজ্যের খাবার। বিমান উড়ছে। ৩৪ হাজার ফুট ওপরে চলে এলো। হয়তো আরও ওপরে উঠবে! মেঘের গায়ে চোখ আটকে যায়। চোখে লেপ্টে থাকে পেঁজা মেঘ! হঠাৎ চোখে পড়ে মেঘের নদী। অনেকটা ডাগর মেয়ের বেণী করা চুলের মতো। যেন তিনটি বেণি দৌড়ে চলে যাচ্ছে কোথায়!

অনেক আগে একবার নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলাম। বড় ভাই, বিজ্ঞানবক্তা আসিফের সঙ্গে। শীতলক্ষ্যা নদীতে আমরা নৌকা ভাড়া করে ঘুরেছি শেষ বিকেলের কনে দেখা আলোয়। অদ্ভুত সে আলোয় দেখেছিলাম তিন খালের মোহনা। স্থানীয়দের কাছে জায়গাটা ‘তিরিবিনি খাল’ নামে পরিচিত।

তালধ্বজ যা দেখে মনে পড়ে গেলো ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে’। এর বিপরীত প্রান্তে রয়েছে পুরাতন পৌষমেলার মাঠ, এটি শুরু করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিমান বসে মেঘের এই নদীটাকে দেখে তিরিবিনি খালের কথা মনে পড়লো। খাল নয়; এ যেন পেঁজা মেঘের তিরিবিনি নদী। এই নদী হয়তো চলে গেছে আরেকটা গ্রহের দিকে! যে গ্রহে থাকে আমাদের মতো অন্য কেউ। জানালায় যারা বসেছেন তাদের সবার চোখ কি মেঘের দিকে? জানি না। দেখার উপায়ও নেই। এই প্রথম দেখি সাদার বাহাদুরি! সাদারও যে কতো রঙ হতে পারে তা ৩৪ হাজার ফুট ওপরে না এলে হয়তো বোঝা হতো না।

রঙিন কাঁচ দিয়ে নান্দনিক নকশায় নির্মিত উপাসনা গৃহ বা ব্রাহ্ম মন্দির। স্থানীয়দের কাছে এটি কাচের মন্দির নামেও পরিচিত। নানান রঙের সাদা। বক সাদা, তুলো সাদা, কাশফুল সাদা, চুন সাদা, দই সাদা, দুধ সাদা, কাগজ সাদাসহ কত্তো কত্তো সাদা! সূর্যের আলো গেয়ে মেখে সাদারা রঙ বদলায়। এই এত্তো এত্তো সাদার ভেতর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে বিমান। থেকে থেকে সাদা মেঘের সঙ্গে ধাক্কা খায়। একদিকে আলতো করে হেলে পড়ে। মনের ভেতর থেকে বোবা চিৎকার দিয়ে উঠি। ওপরে ওঠার সময় বা কখনও ভয় পেতে গেলেই জোরে চিৎকার দিতে হয়। এতে ভয় চলে যায়। এই প্রথম এতো ওপরে উঠলাম। কোথায় মেঘ-টেঘ দেখে উদাস হবো। গান-কবিতা লিখবো মনে মনে; তা না। বরং খাবার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো বিমান।

দেহলী নাক বোঁচা পুতুলের মতো এক এয়ার হোস্টেস কুর্নিশ করে ফের একটা গরম তোয়ালে দিলেন। গরম তোয়ালে দিয়ে হাত আর মুখ মুছে নিই। পুতুল এয়ার হোস্টেস আবার আসে। জুসের একটা গ্লাস বাড়িয়ে দেয়। ছি! জুসের এমন ছিরি! আমীরুল ভাই বলেন, ‘বিমান যতো ওপরে ওঠে ততো খাবারের স্বাদ নষ্ট হয়; বুচ্ছিস? খা, খেয়ে নে।’ ডকডক করে খাই আর নিচের দিকে তাকাই। দেখি— চার তলা, ছয় তলা বাড়িগুলো ম্যাচবক্সের মতো স্থির হয়ে আছে। ছোট ছোট অসংখ্য গাড়ি। পিঁপড়ের মতো ছুটছে। আর মানুষগুলোকে তো মাথার উঁকুনের চেয়েও ছোট মনে হচ্ছে। এর ভেতর ম্যাচবক্সগুলো বড় হয়ে আসে।

কেবিন ক্রু ঘোষণা করে, ‘একটু পরেই আমরা নামতে যাচ্ছি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে।’ ধীরে ধীরে বিমান রানওয়ে ছুঁইছুঁই করে। ছুঁয়েও ফেলে। শেষ হয় না আকাশবালিকার দেওয়া স্যান্ডউইচের স্বাদ। টারমাকে বসে থাকে বিমান। ভাবি তিরিবিনি নদীর কথা। আর ডাক শুনি শান্তিনিকেতনের।

আম্রকুঞ্জ নয়টার ট্রেন কয়টায়?
অনেকের মতো এমন একটা ধারণা আমারও ছিল। কিন্তু না। হাওড়া স্টেশন থেকে ঠিক ১০টা ১০ মিনিটে ছাড়লো শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস। কলকাতা শহরে একরাত থেকে ভোরে উঠেই হাওড়ার পথ ধরলাম। রাতে অনলাইনে খোঁজ নিয়েছি টিকিটের। কিন্তু স্টেশনে এসে কম দামে টিকিট কেটেছি। মাত্র ৫৩ টাকায়। অনলাইনে চড়া দামে টিকিট বিক্রি করে। হাওড়া থেকে বোলপুরের দূরত্ব ২৬১ কিলোমিটার। শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে আড়াই ঘণ্টায় এই দূরত্ব পাড়ি দেওয়া যায়। অনেক ট্রেন যায় বোলপুর হয়ে। সময় নেয় তিন থেকে চার ঘণ্টা। কেবল শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসই দ্রুত নিয়ে আসে গন্তব্যে।

ঘণ্টাতলা বোলপুর স্টেশনে পা রাখতেই নাকে এসে লাগে শান্তিনিকেতনের ঘ্রাণ। মনে পড়ে ১৯৪১ সালের কথা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর ঠিক ১৩ দিন আগে এই বোলপুর স্টেশন থেকেই তাকে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেদিন রবীন্দ্রনাথ যেতে চাননি শান্তিনিকেতন ছেড়ে। এখানে যেই মায়া খুঁজে পেয়েছিলেন তা আর কোথাও মিলবে না। আর এখানে ফিরে আসতে পারবেন না; এটা বুঝে গিয়েছিলেন তিনি। তবুও যেতে হয়েছিল। আর তার আশঙ্কাই সত্যি হয়েছিল।

তিনপাহাড়। সেখানে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কোপাই নদীর তীর থেকে বটগাছের চারা এনে রোপণ করেন) জোছনা গায়ে মেখে সকালের পথে...
বিশ্বভারতীর ক্যান্টিনে রাতের খাবার খেয়ে শান্তিনিকেতনেই থেকে গেলাম বন্ধু কৌশিকের সঙ্গে। রাতের জোছনা গায়ে মেখে দেখলাম চীনা ভবন, পাঠভবন, বেনু কুঞ্জ, বিদ্যাভবন, মাধবী ছাত্রী নিবাস, খেলার মাঠ আর শান্তিনেকতন আশ্রম হয়ে ছাতিমতলা। এই ছাতিমতলায় বসলে অন্যরকম এক ভালোলাগা কাজ করে মনে। চোখ বন্ধ করলে যেন রবীন্দ্রনাথের স্পর্শ পাওয়া যায়! সেই স্পর্শ নিয়ে রাত পার করে ভোর নামিয়ে এনেছিলাম। আলো ফোঁটার পর আশ্রম সরব হয়ে উঠে। ছাত্রছাত্রীদের কোলাহল। অবারিত মাঠে গাছের নিচে উন্মুক্ত শ্রেণিগুলোও প্রাণ পেতে থাকে। মনে পড়ে, ১৯২১ সালে সুইডিশ একাডেমিতে দেওয়া রবীন্দ্রনাথের নোবেল বক্তৃতারও একটা বড় অংশজুড়ে ছিল এই শিক্ষাকেন্দ্রের জন্য তার চিন্তাভাবনা। এই শিক্ষাকেন্দ্রের মধ্য দিয়ে শিক্ষা ও চৈতন্যের বিকাশের এক নতুনধারা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন কবিগুরু।

নতুন বাড়ি ঝরাপাতার গান
সকালের কলকাকলি মাথায় নিয়ে খোয়াই বনের পথ ধরি। ধুলো উড়া লাল পথ। ঝরা পাতারা প্রতিনিয়ত যেন গান গায় পায়ের কাছে এসে। চোখ বুঁজলেই মনের কানে এসে লাগে প্রকৃতির গান। বকুলতলা, ছুটে চলা কাঠবিড়ালি, গাছের কোটর থেকে মুখ বের করে থাকা ছোট্ট পাখির ছানা, হাতিপুকুরের শান্ত জল, শালবীথির শান্ত নির্জন পথ অন্যরকম এক সংগীত রচনা করে মনে।

শালবীথি বালক রবীর প্রথম দেখা
সেই ১৮৬৩ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রায়পুরের জমিদারের কাছ থেকে ২০ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করার পর নির্জনে ঈশ্বরের উপাসনা করবেন বলে বোলপুরে যে দোতলা বাড়িটি তৈরি করেছিলেন, তা বর্তমানে ঐতিহ্য ভবন বা হেরিটেজ বিল্ডিং হিসেবে ঘোষিত। এই বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ প্রথম এসেছিলেন ১২ বছর বয়সে। এই ভবনের দক্ষিণে অনেক আমগাছ, তার তলায় একটি বড় বেদী। এটাই সেই বিখ্যাত আম্রকুঞ্জ। এই বেদীতে বিশ্বভারতীর সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর এই আম্রকুঞ্জে কবিগুরুকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। ১৯৪০ সালে গান্ধীজি যখন শান্তিনিকেতনে আসেন, তখনও এখানেই কবি তার জন্য সংবর্ধনার আয়োজন করেন।

ছাতিমতলার পূর্ব দিক (দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রায়পুরের জমিদারবাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসে এই ছাতিমতলায় বিশ্রাম নিয়েছিলেন) শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র জাদুঘরে সাজিয়ে রাখা বইখাতা, চিঠিপত্র, পাণ্ডুলিপি, ব্যবহৃত তৈজসপত্র আর দেয়ালে টাঙানো ছবির চেয়ে বিশ্বকবিকে বেশি খুঁজে পাওয়া যায়। এসবের বাইরে যে লাল নুড়ি বিছানো পথ চলে গেছে উদয়ন, কোনার্ক, শ্যামলী, পুনশ্চ আর উদীচী ছাড়িয়ে আরও দূরে, গ্রামছাড়া ওই রাঙামাটির পথে। তাতে। কবির নিজহাতে লাগানো নিমগাছের ছায়ায় আর মনকেমন করা উতলা বাতাসে রবীন্দ্রনাথকে অনেক বেশি করে পাওয়া যায়।

বোলপুর স্টেশনে লেখক বোলপুরের শরীরে আশ্চর্য দুপুর
শান্তিনিকেতন আর আশপাশের গ্রাম সাইকেলেই ঘুরেছি আমরা। তিন দিন পর দুপুররোদে সাইকেলের প্যাডেল চাপলাম স্টেশনের দিকে। ট্রেনের জন্য অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বোলপুরের শরীরজুড়ে আশ্চর্য এক দুপুর নেমে আসে। সেই দুপুর রোদে রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিলাম। স্টেশন ধরে হেঁটে চলে যাচ্ছেন তিনি। এই তো আনন্দ!
ছবি: সংগৃহীত

/জেএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অ্যাম্বাসেডর বোল্ট
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অ্যাম্বাসেডর বোল্ট
রানার্সআপ হয়ে প্রিমিয়ার লিগে ওয়ান্ডারার্স 
রানার্সআপ হয়ে প্রিমিয়ার লিগে ওয়ান্ডারার্স 
ঘামে ভেজা ত্বকের যত্নে...
ঘামে ভেজা ত্বকের যত্নে...
চট্টগ্রামে ক্রিকেটারদের ‘ক্লোজড ডোর’ অনুশীলন
চট্টগ্রামে ক্রিকেটারদের ‘ক্লোজড ডোর’ অনুশীলন
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের গল্প বাংলাদেশের পর্দায়
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের গল্প বাংলাদেশের পর্দায়
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
তাপপ্রবাহের গেটওয়ে যশোর-চুয়াডাঙ্গা
তাপপ্রবাহের গেটওয়ে যশোর-চুয়াডাঙ্গা