কলকাতায় যাওয়ার আগে অনেক জায়গায় বেড়ানোর পরিকল্পনা ছিল। সেই অনুযায়ী চলছিল সব। কিন্তু এই পরিকল্পনার মধ্যে নতুনভাবে যুক্ত হলো একটি দোকান। ফেসবুকে নামটা দেখে খটকা লাগলো— ‘চা ও নচিকেতা’। এ আবার কেমন নাম! ছোটবেলায় পড়া ‘এ টি স্টল’ প্যারাগ্রাফের মতো তো মিলছে না। আবার চায়ের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে দুই বাংলার জনপ্রিয় গায়ক নচিকেতার নাম।
এত রহস্য উন্মোচন করতেই গত মাসের শুরুতে কলকাতার ভ্রমণের একরাতে রওনা দিলাম। রাত তখন সাড়ে ১০টা। নিউমার্কেট এলাকা থেকে যাচ্ছি আমরা পাঁচজন। আমার ভ্রমণসঙ্গী অপূর্ণ রুবেল, জয়দীপ সরকার, বাদল খান ও তার স্ত্রী শারমীন ভাবী। গুগল ম্যাপ ও ফেসবুকের সহযোগিতা নিয়ে জানা গেলো, ওই দুর্লভ চায়ের দোকান কলকাতা শহর ছাড়িয়ে একটু দূরে। যে জায়গাকে স্থানীয়রা ‘বাইপাস সড়ক’ নামে চেনে। ট্যাক্সিওয়ালার কাছে শুনলাম, ওই জায়গাটার নাম ‘পাটুলি’।
আমরা পাঁচজনই চা-খোর এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। এটাও ভাবার মানে নেই যে, কলকাতা শহরে ওই সময় কি কোনও চায়ের দোকান খোলা ছিল না? সবই ঠিক আছে। শুধু চায়ের দোকানটার সঙ্গে নচিকেতার নামটা জড়ানোতেই আমাদের কৌত‚হল জেগেছে।
ফেসবুক পেজ থেকে ফোন নম্বর নিয়ে জানতে পেরেছি, রাত ১২টা অবধি খোলা আছে দোকানটা। ফোন ধরলেন এর মালিক। তখনও তিনি দোকানেই ছিলেন। তবে বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে স্পষ্ট ভাষায় বললেন, ‘রাত যতই হোক, দাদা আসুন।’ বুঝে নিলাম, আন্তরিকতায় জড়িয়ে রাখা কলকাতা শহরে দাদা নিরাশ করবেন না।
লাল-নীল বাতি আর নিয়ম-শৃঙ্খলায় পরিপূর্ণ কলকাতা শহরের রাস্তা ধরে যখন ট্যাক্সি ছুটছিল নচিকেতার নামের সেই চায়ের দোকানের পথে, তখন বুঝতে পারলাম এ শহর টেনে নিয়েছে আমাদের। অবশেষে কয়েক কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে রাত ১২টা বাজার একটু আগে পৌঁছে গেলাম নচিকেতার ভক্তের চায়ের দোকানের সামনে। যাওয়ার সময় আমরা পাঁচজন বলাবলি করছিলাম, এই একটা ছোট চায়ের দোকানে এত রাতে না এলে কি হতো না!
ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে গেলো একটা পার্কের সামনে। যেখানে নামি, সেই জায়গাটা বেশ পরিপাটি। বড় সাইনবোর্ডে লেখা বিশ্ববাংলা পার্ক। বসার বেঞ্চি, তারপর লেক। তার ওপর নানান আলোকসজ্জা। একপাশে রবীন্দ্রসংগীত বাজছে। মনে হচ্ছে দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসছে সেই সুর। বসে থাকতেই যেন ভালো লাগে। আমাদের লক্ষ্য যখন ‘চা ও নচিকেতা’ নামের চায়ের আড্ডায় ঢু মারা, তখন বসে থাকার উপায় নেই। বিশ্ববাংলা পার্কের সুন্দর ফুটপাত দিয়ে একটু এগোতেই চোখে পড়ে নচিকেতার ছবিসহ একটা সাইনবোর্ড। সেখানে বড় অক্ষরে লেখা ‘চা ও নচিকেতা’।
দোকানের সামনে দাঁড়াতেই চোখে আটকে গেলো। দেয়ালজুড়ে নচিকেতার বিভিন্ন সময়ের ছবি। চলছে নচিকেতার গানের ভিডিও। আর দোকান নিয়ে লেখা সংবাদের কয়েকটি অংশ। নচিকেতা বরাবরই আমার প্রিয় শিল্পী। ফ্যান নেই, এসি নেই, তবে গা জুড়িয়ে যাওয়া ঠাণ্ডা হাওয়া আছে সেখানে। নচিকেতার ছবিযুক্ত টি-শার্ট গায়ে দেওয়া একটা ছেলে ও একটি মেয়ে চা-কফি তৈরিতে ব্যস্ত। মাটির ছোট্ট কাপে এসব খাবার পরিবেশন করা হয় এখানে। চা-কফির স্বাদ অসাধারণ। প্রতি কাপ চায়ের দাম ১৫ রুপি। কফি ২০ রুপি।
চা খেতে খেতে কথা হয় দোকানের মালিক গৌরব গুহর সঙ্গে। কথা শুরুর আগেই কয়েকটি তথ্য দিলেন লোকটি। তিনি নচিকেতার পাড় ভক্ত। তার হাতে নচিকেতার ট্যাটু পর্যন্ত করা আছে। জানালেন, একসময় নেশাগ্রস্ত জীবন কাটাতেন। গিয়েছিলেন পুনর্বাসন কেন্দ্রেও। সুস্থ হয়ে যখন কিছুই করার সুযোগ পাচ্ছিলেন না, চারপাশের মানুষ যখন অন্য চোখে তাকাচ্ছিল, চাকরি পাওয়া যখন কঠিন হয়ে যাচ্ছিল; তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নিজে কিছু করবেন। সেই ভাবনা থেকেই শুরুটা করেছিলেন যাদবপুরে। খুব ছোট্ট একটা দোকান নিয়ে। সেই দোকানেই একদিন হাজির হয়েছিলেন নচিকেতা। এমন পাড় ভক্তের কথা শুনে শিল্পী চুপচাপ বসে থাকতে পারেননি। সেই দোকান এখনও আছে।
নতুনভাবে আরেকটি শুরু করেছেন পাটুলিতে। এই দোকান উদ্বোধনের সময় পাশে পেয়েছিলেন নচিকেতাকে। বললেন, ‘দাদার মতো একজন মানুষের নাম আমার দোকানের সঙ্গে যুক্ত আছে। যেনতেন জিনিস কিন্তু আমি বিক্রি করতে পারি না। আমার এখানে এসে খারাপ বলেছে কেউ, এমনটা ঘটেনি।’
বছর কয়েক আগে বিয়ে করেছেন গৌরব গুহ। একটা বাচ্চাও আছে। স্ত্রী ও নিজে মিলে পুরো ব্যবসা দেখাশোনা করেন। তিনদফা চায়ে চুমুক দেওয়ার পর বিদায় নেওয়ার পালা। বললাম, বাংলাদেশে কিন্তু নচিকেতার অনেক ভক্ত আছে। হাসতে হাসতে বললেন, ‘তাদের আমার এখানে আসতে বলবেন। চায়ের স্বাদ কেমন দেখে যেতে বলবেন।’