X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

শঙ্খের পাথুরে বনে

রিয়াসাদ সানভী
০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৮:১৫আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ২১:৩৩

স্থানীয় মানুষের কাছে পবিত্র এ পাথর থানচির ব্রিজের ওপর দাঁড়ালেই টের পাওয়া যায় পাহাড়ের গুনগুনানি। শঙ্খের হাঁটুজল তোলপাড় করে ইঞ্জিনের সরু নৌকাগুলো ছুটছে দুরন্ত বেগে। সবার গন্তব্যই রেমাক্রি। অনেকে এই জায়গাকে বাংলাদেশের অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের রাজধানী ভাবেন। সেখান থেকে কত পাহাড় চূড়ার পথে চলে গেছে কত পথ তার ইয়ত্তা নেই। আমাদেরও লক্ষ্য রেমাক্রি। তারপর স্রেফ হারিয়ে যাবো!

এদিকে বন্দোবস্ত সারতে হবে। ভ্রমণসঙ্গী প্রকাশ নিজেও আছে ভয়ে! সে আমাদের শুধু থানচি বাজার পার করে দেবে। এমনিতে নিরাপত্তার অজুহাতে রেমাক্রি বাজার থেকে নাফাকুমের পরে যাওয়া নিষেধ। এ অবস্থা চলছে বছরের পর বছর।

এসব পাথরের গায়ে আল্পনা এঁকে অনেকে টাকা-পয়সাও রেখে যায় প্রকাশকে নিয়ে থানচি থানায় গেলাম। নাফাকুম পর্যন্ত নিবন্ধন করে আগেই ঠিক করে রাখা বোটে চড়ে বসলাম। থানচির বোটঘাটায় চলে আরেক ধরনের ডাকাতি! রেমাক্রি বাজার পর্যন্ত স্থানীয়রা যেতে পারে ২০০ টাকায়। কিন্তু ঢাকা থেকে আসার অপরাধে (!) অন্য পর্যটকদের গুনতে হয় চার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। কিন্তু দেখার যেন কেউ নেই। এই যাত্রায় আমরা কিছুটা ভাগ্যবান। এত টাকা আক্কেলসেলামি দিতে হলো না অন্য দুই সহযাত্রীর তৎপরতায়। আড়াই হাজার টাকার চুক্তি। বোট পৌঁছে দেবে রেমাক্রি বাজার পর্যন্ত। ফেরার সময় আসবো লোকাল ভাড়ায়। প্রকাশ আমাদের জন্য নিজের বাড়ি থেকে খাবার তৈরি করে এনেছে। নৌকা ছাড়তেই অন্নগ্রহণের আবদার তার। এত ভালোবাসা রাখি কোথায়!

তিন্দু বাজারের ঠিক পরেই এ পাথুরে বন আমার মুখে অবশ্য খাবার রুচলো না। স্বাদ নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। কিন্তু চিরকালের প্রিয় জলধারা শঙ্খের প্রতি বিশেষ মনোযোগ। কোনোরকম খেয়ে নিলাম পুকুরে জাল ফেলে ধরা মাছভাজা, শুকনো মরিচসহ সবজি। এই শঙ্খ যদি হাজার মাইল দীর্ঘও হয়, নৌকায় সেই দূরত্বও বোধহয় পাড়ি দিতে পারবো অনায়াসে। একটুও ক্লান্ত হবো না। ভালোবাসার সব অনুষঙ্গের আস্বাদ একসঙ্গে আর কোথায় নিতে পারবো এ দেশে?

শুকনো মৌসুমে দেখা যায় এর পরিপূর্ণ সৌন্দর্য স্রোতস্বিনীর উজান ঠেলে দূর পাহাড়ের দেশে চলেছি। ‘নদীর বাঁকে বাঁকে জীবন’ কথাটি যেন শঙ্খের বেলায় দারুণ খাটে। স্থানীয়দের জীবিকার উৎস এ নদী। ফলে তাদের দেখা পাওয়া কোনও দুর্লভ ঘটনা নয়। কেউ হয়তো দুপুরের স্নান সেরে নিচ্ছেন। কেউ ব্যস্ত কাপড় কাচতে। কেউ হাঁটু জলে কাকড়া কিংবা শামুক খুঁজে বেড়াচ্ছেন। মজার ব্যাপার হলো, প্রায় সব দলের সঙ্গে তাদের পোষা কুকুরগুলো আছে। এটি সেই নদী যার ওপর অধিকার শুধু বাংলাদেশের। এর উৎপত্তি ও বিস্তার সবই এ দেশে। জীবনের এই আয়োজন দেখতে আমরা বড়পাথর এলাকায় চলে এলাম। এখানকার পাথরগুলোই এ পথের বড় আকর্ষণ। এর মধ্যে রাজাপাথরকে ঘিরে আছে উজির, নাজির, আমির, অমর্ত্যরা।

সাঙ্গু আপার ভ্যালির সঙ্গে থানচি উপজেলা সদরের নৌ যোগাযোগের প্রধান পথ এটি স্থানীয়রা বেশ ভক্তি করেন এসব পাথরকে। অনেকে টাকা রেখে যায়। সিঁদুর লেপেও যাওয়া যায়। এর পেছনে আছে এক রূপকথা। সেই কোন যুগে এখানে রাজত্ব করতো তিন্দু ও দোতং নামে দুই রাজা। কর্তৃত্ব নিয়ে দুই রাজার মধ্যে বাঁধে ভীষণ যুদ্ধ। তাতে পরাজিত হন তিন্দু রাজা। তিনি ঠিক করলেন, নিজ রাজ্য ছেড়ে পালাবেন না। কিন্তু কীভাবে নিজ রাজ্যে থাকবেন? ভেবে বের করলেন এক বুদ্ধি। সে বড় ভয়ানক। পরিবার-পরিজন, মন্ত্রী, উজির, সৈন্যসামন্ত নিয়ে প্রমত্তা শঙ্খের জলে দিলেন ঝাঁপ। সেই থেকে পাথুরে ফসিল হয়ে নিজ রাজ্যেই বহাল তবিয়তে আছেন তিন্দু রাজ। শঙ্খ সেই সাম্রাজ্যের ভেতর দিয়েই এঁকেবেঁকে চলে গেছে।
নৌ-চলাচলের জন্য এ জায়গা খুব ঝুঁকিপূর্ণ এখানকার পানি পুরোপুরি স্বচ্ছ। সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত এই পাথুরে সাম্রাজ্য। মিথের আঙিনা ছাড়িয়ে পাথরগুলো এ নদীর প্রাণবৈচিত্র্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটাকে কেন্দ্র করেও বাঁচে অনেক প্রাণ। তবে বর্ষায় এ এলাকা পার হতে হয় সাবধানে। কারণ বেশকিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে।

এ পাথরের যেন প্রাণ আছে রাজাপাথরের পর কিছুটা অংশ আমাদের হেঁটে যেতে হলো। পানি এই অংশে নেই বললেই চলে। এর মাঝেও নৌকা স্রেফ হাওয়ায় উড়ে চলে গেলো যেন। সেখানে রীতিমতো খাওয়ার হোটেল বসে গেছে। পানি কম থাকায় রেমাক্রি মুখের কাছেও দোকানপাট বসেছে। আমরা রেমাক্রি বাজারে পৌঁছালাম বিকাল ৪টার দিকে। এবার অনেকদিন পর আসা। সেই ত্লাংময় অভিযানের পর এদিকে আর আসা হয়নি। শুনেছি রেমাক্রি কিছুটা বদলেছে। আজকাল সেখানে প্রচুর পর্যটকের আনাগোনা থাকে। সপ্তাহের মাঝামাঝি হওয়ায় সেই পঙ্গপালের দেখা পাওয়া গেলো না। এবার আমাদের যেতে হবে দলিয়ান পাড়ার দিকে।

এসব পাথর বিভিন্ন প্রাণের আশ্রয়স্থল মনে রাখবেন
থানচি বাজার থেকে নৌকায় চড়ে সরাসরি চলে যাওয়া যায় রাজাপাথর এলাকায়। এর ঠিক আগেই অসাধারণ সৌন্দর্যমণ্ডিত তিন্দু বাজার। সেখান থেকে চিন্মুক রেঞ্জ খুব ভালোভাবে দেখা যায়। হালে বেশ নিয়মকানুন চালু হয়েছে। বলিপাড় ও থানচির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাম্পে নিজের সচিত্র পরিচয়পত্র জমা দিতে হবে। তাই পর্যাপ্ত কাগজপত্র সঙ্গে রাখুন। যদি শুধু রাজাপাথরই দেখতে চান তাহলে থানচি বাজার থেকে সেভাবেই নৌকা ভাড়া করতে হবে। খরচ পড়বে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। রাজাপাথর দেখার সবচেয়ে ভালো সময় শীতকাল।

রাজাপাথরের পর আর ঘণ্টাদেড়েক গেলেই রেমাক্রি বাজার ছবি: মোহাম্মদ ইমতিয়াজ

/জেএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা