বিখ্যাত ব্যক্তি থেকে কুখ্যাত অপরাধীদের বসবাস ছিল যেসব কারাগারে, সেগুলোর মধ্যে ১০টি এখন পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। দক্ষিণ আফ্রিকার অবিস্মরণীয় নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে বন্দি রাখা রোবেন দ্বীপও আছে এই তালিকায়। তিনি যেখানে ১৮ বছর কাটিয়েছেন তা দেখার সাধ আছে অনেকেরই। কারাগার বিলুপ্ত ঘোষণার পর সংস্কারের মাধ্যমে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
অ্যালকাট্রাজ, যুক্তরাষ্ট্র
স্প্যানিশ ভ্রমণপিপাসু হুয়ান ম্যানুয়েল ডি আয়ালা ১৭৭৫ সালে এই জায়গার নাম রেখেছেন ‘ইজেল অব দ্য পেলিক্যানস’। বর্তমানে এটি অ্যালকাট্রাজ দ্বীপ নামেই বেশি পরিচিত। দূর থেকে সবার আগে সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ার চোখে পড়লেই বোঝা যাবে সেখানে ছিল কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টিত কারাগার। সেখানে বন্দি ছিলেন আমেরিকান গ্যাংস্টার আল ক্যাপোন, ব্যাংক ডাকাত জর্জ মেশিন গান কেলি, খুনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত রবার্ট ফ্রাঙ্কলিন স্ট্রাউড। তাদের মধ্যে রবার্ট পরিচিত ছিলেন ‘বার্ডম্যান অব অ্যালকাট্রাজ’ নামে। তারা কেউই বেঁচে নেই।
আমেরিকান গ্যাংস্টার আল ক্যাপোন ছিলেন ১৮১ নম্বর সেলে। তার নম্বর ছিল ৮৫। অপহরণ ও ডাকাতির কারণে অ্যালকাট্রাজে জেল খেটেছেন এমন আরেক কয়েদি জিম কুইলেন। তিনি জানিয়ে গেছেন, বন্দিদের শুধু একটি করে নম্বর থাকে জেলে। কোনও নাম নেই কারও। নিজের নামের চেয়েও এটিই তখন বড় পরিচয়! সেখানে আমি জিম কুইলেন ছিলাম না। আমার নম্বর ছিল ৫৮৬।’
ক্যালিফোর্নিয়ার এই কারাগারের সেল ও ব্যায়ামের স্থান ঘুরে দেখার সময় দর্শনার্থীরা অডিওতে বন্দি জীবনের ইতিহাস শুনবেন। একইসঙ্গে জানতে পারবেন অন্যরকম ইতিহাস। দ্বীপের একটি অংশ ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ভারতীয় বংশোদ্ভূত ৮৯ জন আমেরিকানের দখলে ছিল। ওই আন্দোলনকে বলা হয় ‘ওকুপেশন অব অ্যালকাট্রাজ’।
রোবেন আইল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা
দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন শহরের উপকূলে অবস্থিত রোবেন দ্বীপ নিপীড়ন ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের বিজয় ও স্বাধীনতার সাক্ষী। তাই এটি স্থান পেয়েছে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকায়। সেখানকার কারাগারে ছিল চূড়ান্ত নিরাপত্তা। রাজনৈতিক বন্দি, বিশেষ করে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনকারীদের পাঠানো হতো সেখানে।
তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত নেলসন ম্যান্ডেলা। ২৭ বছর কারাজীবনের ১৮ বছরই রোবেন দ্বীপে কেটেছে তার। পরবর্তী সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হন তিনি। তার বন্দিজীবনের বর্ণনা ছিল এমন, ‘কোনও সন্দেহ নেই, দক্ষিণ আফ্রিকান বিচার ব্যবস্থার সবচেয়ে কঠোর দিক এই কারাগার।’
কারাগারে ম্যান্ডেলার বন্ধু ছিলেন রোবেন দ্বীপের সাবেক বন্দি আহমেদ কাত্রাদা। রোবেন দ্বীপে সাড়ে তিন ঘণ্টার ট্যুর দেওয়া যায়। এরমধ্যে আছে ফেরি ভ্রমণ। গাইড হিসেবে পাবেন সাবেক রাজনৈতিক একজন বন্দিকে।
ওল্ড মেলবোর্ন গাওল, অস্ট্রেলিয়া
অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি অস্ট্রেলিয়ায় স্বর্ণের সন্ধান পাওয়ার পর শুরু হয় অরাজকতা। অপরাধ বেড়ে যেতে থাকে আশঙ্কাজনক হারে। তখন কুখ্যাত অপরাধীদের পাশাপাশি গৃহহীন ও মানসিক ভারসাম্যহীনরা বন্দি ছিল ওল্ড মেলবোর্ন গাওল কারাগারে। মোট ১৩৩ কয়েদির ফাঁসির সাক্ষী এই জায়গা।
তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যার দায়ে ১৮৮০ সালে নেড কেলির ফাঁসিও হয়েছে সেখানে। তার মুখের ছাঁচ প্রদর্শন করা হয় ওল্ড মেলবোর্ন গাওলে। ১৯২৯ সালে এই কারাগার বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭২ সালে এটি অধিগ্রহণ করে ন্যাশনাল ট্রাস্ট। বন্দি জীবন কেমন ছিল তা দেখতে পর্যটকদের জন্য এই কারাগার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
ডেভিল’স আইল্যান্ড, ফ্রেঞ্চ গিয়ানা
দক্ষিণ আমেরিকায় ফ্রেঞ্চ গিয়ানার উপকূলে জনহীন আইল্যান্ড অব স্যালভেশনে ফরাসি উপনিবেশ ছিল ১৮৫২ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত। এখন রয়েল আইল্যান্ডে ওয়ার্ডেন ও কর্মীরা থাকেন। ফলে কেবল সেখানেই পর্যটকদের যাওয়ার সুযোগ আছে। এই জায়গায় কয়েকটি কারাকক্ষ আছে। এখন অবশ্য তা হোটেল ও রেস্তোরাঁয় রূপ নিয়েছে। নির্জন কারাবাসের জায়গা দেখতে জার্নি লাতিন আমেরিকা ট্যুরে স্পিডবোটে চড়ে সেন্ট-জোসেফ আইল্যান্ডে যেতে পারেন। এখন এটি পরিণত হয়েছে জঙ্গলে।
আরেকটি দ্বীপ হলো ডেভিল’স আইল্যান্ড। রাজনৈতিক কয়েদি ক্যাপ্টেন আলফ্রেড ড্রেফাসকে বন্দি রাখা হয়েছিল সেখানেই। হলিউডে এই কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়ার বিষয় নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘প্যাপিলন’ নামের একটি ছবি। চারপাশে হাঙর উপদ্রুত ও বৈদ্যুতিক জলপ্রবাহের কারণে সেখানে যাওয়ার কোনও অনুমতি নেই। তবে নৌকায় চড়ে রয়েল আইল্যান্ড থেকে ২০০ মিটার দূরে কারাগার স্পষ্ট দেখা যায়।
অক্সফোর্ড ক্যাসেল, ইংল্যান্ড
ইংলিশ গৃহযুদ্ধের সময় বিদ্রোহীদের বন্দি রাখতে ১০৭১ সালে শীর্ষ সামন্তদের দিয়ে অক্সফোর্ড ক্যাসেল গড়ে তোলেন রাজা চার্লস। মূলত বিদ্রোহী সংসদ সদস্যদর সেখানে রেখে অত্যাচার করা হতো। দীর্ঘ ১০০ বছর কারাগার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এই জায়গা। ১৯৯৬ সালে এর কার্যক্রম শেষ হয়। ২০০৪ সালে এই জায়গা সংস্কারের মাধ্যমে অট্টালিকা, রেস্তোরাঁ, একটি আর্ট গ্যালারিসহ, রেস্তোরাঁ, গ্যালারি স্থাপন করা হয়। তবে কারাগারের মূল অংশ সংরক্ষিত আছে।
এখন পর্যটকদের জন্য অক্সফোর্ড ক্যাসেল-আনলকড নামের একটি গাইড ট্যুরস প্যাকেজ রয়েছে। এর মাধ্যমে ৯০০ বছরের পুরনো ভূগর্ভস্থ দুঃসহ পরিবেশের অভিজ্ঞতা পাওয়া যাবে। এছাড়া স্যাক্সন সেন্ট জর্জের টাওয়ার থেকে অক্সফোর্ডের ঐতিহাসিক শহরের চারপাশ দেখা যায়।
হরসেনস স্টেট প্রিজন, ডেনমার্ক
দীর্ঘ ১৫৩ বছর কারাগার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার পর সবশেষ ২০০৬ সালে হরসেনস স্টেট প্রিজন, ফটক বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে মনোরম ভবনটি সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট হিসেবে চালাচ্ছে একটি ফাউন্ডেশন। সেখানে আছে কারা জাদুঘর। এছাড়া বিভিন্ন সম্মেলন ও ব্যবসায়িক কাজ হয় এই জায়গায়। বড়সড় কনসার্টও অনুষ্ঠিত হয়েছে হরসেনস স্টেট প্রিজনে।
এই কারাগার ঘুরে দেখার সময় পর্যটকদের কানে বাজবে কয়েদি জেনস নিয়েলেসেনের কণ্ঠে বিভিন্ন গল্প। এক প্রহরীকে তিনবার খুনের চেষ্টা ও মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামি ছিলেন তিনি। ১৮৯২ সালে শিরচ্ছেদের মাধ্যমে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর বরা হয়। ডেনমার্কের ইতিহাসে এমন ঘটনা এরপর আর দেখা যায়নি। কারাগারটি এখনও দর্শনীয়।
ইস্টার্ন স্টেট পেনিটেঞ্চোরি, যুক্তরাষ্ট্র
১৮২৯ সালে ফিলাডেলফিয়ায় গড়ে তোলা হয় এই কারাগার। তবে শুরু থেকে সেখানকার কারাবাসের পদ্ধতি অনেক বিতর্কিত ছিল। ১৮৪২ সালে ইংরেজ সাহিত্যিক চার্লস ডিকেন্স জায়গাটি পরিদর্শনের পর লিখেছিলেন, ‘এর পদ্ধতি বাঁধা-ধরা, কঠিন ও হতাশাজনক। আমার কাছে এটি নির্মম ও ভুল পদ্ধতি।’
১৯৭০ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া এই কারাগার এখন পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। ১৯৯৪ সাল থেকে ভ্রমণপিপাসুদের পা পড়ছে সেখানে। দুর্গের মতো কারাগারে ঢুকতেই রেকর্ডারে বেজে ওঠে মার্কিন অভিনেতা স্টিভ বুশেমির কণ্ঠে কঠোরতার গা ছমছমে বর্ণনা। একইসঙ্গে মিলবে সাবেক প্রহরী ও ছোটখাটো কয়েদিদের অভিজ্ঞতা।
কিলমেইনহাম গাওল, আয়ারল্যান্ড
আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে ১৭৯৬ সালে চালুর পর কিলমেইনহাম গাওল ছিল সাধারণ বন্দিদের আবাসন। তাদের মধ্যে চার হাজার কয়েদিকে পরে অস্ট্রেলিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আইরিশ জাতীয়তাবাদের প্রতীক এই কারাগার। তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা অসংখ্য মানুষকে বন্দি করা হয়েছিল সেখানে। অনেকের মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর করা হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন ১৯১৬, ১৯১৯-১৯২১ ও ১৯২২-১৯২৪ সাল পর্যন্ত সংঘটিত যুদ্ধ ও বিপ্লবে অংশহগ্রহণকারীরা। ১৯২৪ সালে কারাগার বন্ধ ঘোষণার সময় ছাড়া পাওয়া সবশেষ ব্যক্তি ইয়ামন ডি ভ্যালেরা পরে আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিলমেইনহাম গাওলে বেড়ানোর জন্য গাইড ট্যুর পাওয়া যায়। এছাড়া আছে অডিওভিজ্যুয়াল শো। এতে তুলে ধরা হয়েছে রাজনৈতিক ও সাজা আর কারাগার সংস্কারের ইতিহাস।
পোর্ট আর্থার, অস্ট্রেলিয়া
ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকায় আছে পোর্ট আর্থার। তাসমানিয়ার দ্বীপে ১৮৩০ থেকে ১৮৭৭ সাল পর্যন্ত ঔপনিবেশিক শাসনামলের কারাগার হিসেবে ব্যবহার হতো এই জায়গা। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া ভবন মনে করিয়ে দেয় সেখানকার অপরাধীদের কঠোর জীবনযাপন। বর্তমানে এটি পর্যটকের মূল আকর্ষণ। নৌকা বা স্পিডবোটে চড়ে তারা সেখানে যান। ১ হাজার ৬৪৬ জনের সমাধির মধ্যে কেবল ১৮০টির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় এখন। এগুলো কারাগারের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সামরিক কর্মকর্তাদের। লণ্ঠনের আলোয় সেখানে ঘোরাঘুরি বেশ জনপ্রিয়। এছাড়া প্রাপ্তবয়স্করা ভৌতিক অভিজ্ঞতা তদন্তের জন্য বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষা চালাতে পারেন। ফলে সত্যিই ভূত বা অন্যান্য অস্বাভাবিক কিছুর উপস্থিতি কিছু আছে কিনা তা শনাক্ত করার সুযোগ নেওয়া যায়।
হোস্টেল সেলিকা, স্লোভেনিয়া
সংস্কারের ফলে পৃথিবীর অনেক কারাগারের বিচিত্র ও ভীতিকর পরিবেশ বদলেছে। স্লোভেনিয়ার লিবিয়ানায় একসময়ের সামরিক কারাগার যেমন হয়ে উঠেছে রঙচঙে হোস্টেল সেলিকা। এর মধ্যে ২০টি সেল ভ্রমণকারীদের জন্য বিশেষভাবে আঁকাআঁকি করে সাজানো হয়েছে নতুনভাবে। হোস্টেলিং ইন্টারন্যাশনালের দুটি হোটেল আছে সেখানে। এই জায়গায় গেলে ভবনটির প্রকৃত ইতিহাস জানা যাবে। চাইলে থাকতে পারবেন একটি সেলে। সঙ্গে দেওয়া হবে চাবি।
এদিকে সুইডেনের স্টকহোমে ল্যাংহোলমেন হোস্টেল হলো একসময়ের ক্রাউন রিমান্ড কারাগার। আর কানাডায় রয়েছে কার্লটন কাউন্টি জেল। এখন এর নাম অট্টাওয়া জেল হোস্টেল।