X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১
ট্রাভেলগ

শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি

তাহির মুহাম্মদ তৌকির
২৭ অক্টোবর ২০১৮, ১৮:৩৮আপডেট : ২৭ অক্টোবর ২০১৮, ১৮:৪৪

ভোর সাড়ে ৫টায় একসঙ্গে বেজে উঠলো পাঁচটা মোবাইল ফোনের অ্যালার্ম। সহজে কারও ঘুম ভাঙে না বলে এই পন্থা। প্রচণ্ড ঘুমকাতুরে হওয়া সত্ত্বেও লাফিয়ে উঠলাম তিনজন। ঝটপট বেরোতে হবে আমাদের। সারাদিন বেশ ব্যস্ত শিডিউল। পাসপোর্ট সঙ্গে নিলাম। মনে রাখতে হবে, বিদেশ-বিভুঁইয়ে এটাই সবচেয়ে জরুরি বস্তু। 

নিচে নেমে দেখি হোটেলের লোকজন সব তখনও ঘুমোচ্ছে। ডেকে ডেকে ওঠালাম। তাদের একজনের ফোন থেকে কল দিলাম আগের দিন ঠিক করে রাখা ট্যাক্সিওয়ালা চাচাকে। জানা গেলো, পুলিশ বাজারে অপেক্ষা করছেন তিনি। হোটেল থেকে বেরিয়ে মাত্র মিনিট ছয়েকের পথ। শিলং শহর তখনও জেগে ওঠেনি। রাস্তাঘাট আর অলিগলি ফাঁকা। পুলিশ বাজারে পৌঁছাতেই দেখলাম ট্যাক্সি ড্রাইভার চাচা গাড়িতে হেলান দিয়ে সুখটান দিচ্ছেন! তার পুর্বপুরুষ বাংলাদেশি। বাংলা বলতে পারেন বেশ। নেত্রকোনায় বসবাস করতেন একসময়। মুক্তিযুদ্ধের সময় চলে যান ভারতে। আর ফেরেননি। স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে তার সংসার। সবাই চাকরিজীবী। সারাদিন ব্যস্ত, রাতে একই ছাদের নিচে সবার বসবাস।

শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি আমাদের ট্যাক্সি কপালটা বেশ ভালোই বলতে হয়। ট্যাক্সিটা পুরোপুরি নতুন। ট্যাক্সির বয়স নাকি কেবল মাত্র দু’মাস! চাচা প্রথমেই আমাদের শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে ঘোরালেন। পার্ক, চিফ জাস্টিসের বাসভবন, গির্জা দেখে গেলাম একটা মসজিদে। ট্যাক্সি ড্রাইভার চাচার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আপনাদের এখানে মসজিদ নেই? এর সূত্র ধরে তিনি নিয়ে গেলে লাবান মসজিদে। এর বেশিরভাগ অংশে সবুজ কাচের দেয়াল। মসজিদের সামনে বেশ খানিকটা ঘাসের চাদর বিছানো মাঠ। দেখে মনে হলো, এটি মাদ্রাসা হিসেবেও ব্যবহার হয়।

শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি মসজিদ থেকে বেরিয়ে এবার সোজা চেরাপুঞ্জির পথ ধরলাম। শুরু হলো পাহাড়ে ওঠা। একটা সময় আমরা গিয়ে থামলাম ল্যামডাং ভিউ পয়েন্টে। এখান থেকে শিলং শহর দেখা যায় বেশ। এখানে-সেখানে বিশাল অংশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে রংবেরঙের ঘর।

শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি ল্যামডং পয়েন্ট থেকে আবার চেপে বসলাম ট্যাক্সিতে। কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে গেলাম ফাঁকা রাস্তায়। বাঁ-দিকে পাহাড়ের বুকে ঝাউবন। দূরের পাহাড়গুলো দাঁড়িয়ে আছে ঠাঁয়। সবই সবুজে ঘেরা। অনেকক্ষণ পরপর অল্পকিছু বাসা-বাড়ির দেখা পাওয়া যায়। গাড়ি এগিয়ে চলছে আঁকাবাঁকা পথ ধরে। রাস্তার একপাশে গভীর খাদ। একটু এদিক-সেদিক হলেই সোজা চলে যাবো হাজার হাজার ফুট গভীরে!

শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি অনেকক্ষণ পর আমাদের ট্যাক্সি গিয়ে থামলো দুয়ান সিং সাইয়েম ব্রিজ ডি ভিউ পয়েন্ট। ট্যাক্সিওয়ালা চাচা বললেন, ভিউ পয়েন্ট থেকে সব দেখে বাঁ-দিকের ফটক দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে যেতে। সেখানে ঝরনা আছে। ভিউ পয়েন্ট থেকে যতদূর চোখ যায় শুধুই সবুজ। পাহাড়গুলো দুই পাশ থেকে নেমে এসেছে একটা জায়গায়। নিচের দিকে তাকালেই ভয়ে আঁতকে উঠতে হয়। ভয়ঙ্কর সুন্দর গভীর খাদ!

শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি ভিউ পয়েন্ট থেকে বাঁ-দিকে সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকলাম। অনেকক্ষণ নামার পরে কানে এলো ঝরনার শব্দ। হিম স্বচ্ছ জল আছড়ে পড়ছে পাথরের বুকে। পাহাড়ি বন থেকে ভেসে আসছে বহু অজানা পাখির ডাক। এখানে শুধুই প্রকৃতির বসবাস। যান্ত্রিকতা নেই বিন্দুমাত্র। বেশ কিছুক্ষণ ঝরনায় কাটিয়ে ফিরে এলাম ওপরে। সকালে শীতল আবহাওয়ায় গরম ধোয়া ওঠা নুডলস রীতিমতো কাড়াকাড়ি করে সাবাড় করলাম তিনজন। সকালের নাস্তা সেরে চেপে বসলাম ট্যাক্সিতে।

শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি আবারও পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে ছুটে চললো আমাদের ট্যাক্সি। অনেকক্ষণ পর গিয়ে থামলাম রাস্তার পাশে। সিঁড়িপথ বেয়ে উঠতে হবে ওপরে। পাহাড়ের ওপরে অনেক গাছ ও একটি লেকের দেখা পেলাম। এটি আশেপাশের সব জায়গা থেকে উঁচু। পেছনে পাথুরে পাহাড়, সামনে দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়। খুব কাছ দিয়েই ছুটে চলছে মেঘের দল। জায়গাটির নাম তায়াঙ্গাম মাসি ভিউ পয়েন্ট। এদিক-সেদিক ঘুরে ছবি তুলে নিচে নেমে আবারও উঠলাম ট্যাক্সিতে। পথিমধ্যে একটা জায়গায় দাঁড়ালাম। যেখানে দাঁড়িয়ে বহুদূর অবধি দেখা যায়। তবে জায়গাটি সবুজ নয়। পুরোটাই ধূসর বর্ণের। কিছু ছবি ও ভিডিও নিয়ে এবার চললাম ওহাকাবা ফলসের দিকে।

শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি সূর্যের তাপ বেশ ভোগাচ্ছিল। এর মধ্যে চোখে পড়লো ওহাকাবা ফলসের সাইনবোর্ড। ফলসে যেতে হলে আবারও সিঁড়িপথ বেয়ে অনেক নিচে নামতে হবে। আমাদের মধ্যে একজন নামতে না চাইলেও আমরা বাকি দু’জন নামা শুরু করলাম। যা আছে কপালে! প্রথমে অল্প একটু নামতেই ছোট্ট একটা ঝরনা দেখলাম। সেখান থেকে সিড়ি বেয়ে আরও নিচে নেমে পেলাম ওহাকাবা। সেখানে ভয়ানক শব্দ। কারণ এর পানি অনেক নিচে পাথরে আছড়ে পড়ে। ঝরনার নিচে যাওয়ার কোনও পথ নেই। ওপরের দিক থেকে রেলিং ধরেই দেখতে হয়। তবে ঝরনার ওপরের অংশে যাওয়ার সুযোগ আছে। বিশাল বিশাল পাথর সেখানে। স্বচ্ছ জল ছুটে আসছে। আমরা বেশ কিছুদূর এগিয়ে ঘুরে দেখে আবারও শুরু হলো যাত্রা।

শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি আমাদের এবারের গন্তব্য মাওসুমাই কেভ। এর আগে কখনও কোনও গুহায় যাওয়া হয়নি আমার। গুহা দর্শন এটাই প্রথম। টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম। প্রথমে কিছু গাছপালার মধ্য দিয়ে হেঁটে গিয়ে ঢুকতে হয় গুহায়। ভেতরে কর্তৃপক্ষ আলোর ব্যবস্থা রেখেছে। ভেতরটা বেশ স্যাঁতস্যাঁতে। পুরোপুরি নীরব। ভেতরের পাথরগুলো বিদঘুটে আকৃতির। গুহার ভেতর নানান জায়গা দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ছে গায়ে। শীতল জল। গুহার দুই-একটা জায়গা বেশ সরু। একটু মোটাসোটা হলেই পার হওয়া মুশকিল। কিছু জায়গায় মাথা নিচু করে চলতে হয়। গুহার একটা জায়গায় গিয়ে মাথার ওপরে গাছপালা আর আকাশের দেখা মিললো।

শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি গুহা থেকে বেরিয়ে দেখি আরেকটি গুহার প্রবেশমুখ। তবে সাইনবোর্ডে লেখা আছে, এটি শুধু বিশেষজ্ঞ তথা অভিজ্ঞদের জন্য। তাই সেখানে যাইনি। তবে গুহার বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই মাটির নিচে এতকিছু!

মাওসুমাই কেভ থেকে এবারের যাত্রা সেভেন সিস্টার্স ফলসের দিকে। সেখানে পাশাপাশি সাতটি ঝরনা দেখা যায়। এজন্যই হয়তো এর নামকরণ হয়েছে সেভেন সিস্টার্স ফলস। তবে পানি কমে যাওয়ার কারণে আমরা মাত্র চারটি ঝরনার দেখা পেয়েছিলাম।

শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি সেভেন সিস্টার্স ভিউ পয়েন্ট থেকে চললাম মাওসুমাই ইকোপার্কে। এই জায়গা থেকেই মূলত সেভেন সিস্টার্স ঝরনার শুরু বলা যায়। কেননা এখান থেকেই সেভেন সিস্টার্সের পানি গড়িয়ে পড়ে অনেক নিচে।

ঘুরতে ঘুরতে ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হওয়ার পথে। তাই পার্কেই মাছ আর সবজি দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সেরে নিলাম। দাম সাধ্যের মধ্যে। খাওয়ার পর আমাদের গন্তব্য ছিল নোকালিকাই ফলস। তবে পথিমধ্যে আমরা থেমেছিলাম রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে। তখন সেখানে ক্লাস চলছিল। স্কুলের দোতলায় দুটি জাদুঘর আছে। নিচতলায় একটি মন্দির। ঘুরে ঘুরে স্কুল দেখছিলাম। বারান্দা থেকে বহুদূর অবধি দেখা যায়। মেঘেরা ভেসে বেড়ায় দূর আকাশে।

শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি রামকৃষ্ণ মিশন থেকে বের হয়ে চললাম নোকালিকাইয়ের দিকে। পাহাড়ি আঁকাবাকা পথে এগিয়ে চললো আমাদের ট্যাক্সি। শেষ বিকালে গিয়ে পৌঁছালাম নোকালিকাই ফলসে। পর্যটক নেই বললেই চলে। নোকালিকাই ফলসকে দেখা অনেকটা ভাগ্যের ব্যাপার। কেননা এটি বেশ দূরে। প্রায়ই এই জায়গা ঢেকে যায় মেঘে। এই ফলসকে অনেকদূর থেকে দেখতে হয়। এর উচ্চতা অনেক বেশি। পানিগুলো নিচ অবধি পড়ার আগেই বাতাসের ধাক্কায় এলোমেলো হয়ে যায়!

শিলং পাহাড়ে লেখক পুরো বিকাল কাটিয়ে দিলাম নোকালিকাইয়ের দিকে তাকিয়ে। মন চেয়েছিল আরও বহু সময় বসে ঝরনার শব্দ শুনি। ততক্ষণে সূয্যিমামা পশ্চিম আকাশে ডুবে যাচ্ছে। বিদায় নিতে হবে আমাদের। সারাদিনের ছুটোছুটি শেষে ট্যাক্সিতে উঠেই গা এলিয়ে দিলাম। অন্ধকার ফাঁকা রাস্তা ধরে শিলংয়ের দিকে ছুটে চলছে ট্যাক্সি।

ছবি: লেখক

/জেএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী