X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০
ট্রাভেলগ

কালের সাক্ষী বিউটি বোর্ডিং

নাকিবুল আহসান নিশাদ
০৩ নভেম্বর ২০১৮, ২২:৩২আপডেট : ০৩ নভেম্বর ২০১৮, ২৩:১৭

কালের সাক্ষী বিউটি বোর্ডিং পুরান ঢাকার বংশাল মোড়ের যানজট পেরিয়ে খানিকটা এগোলেই ভিক্টোরিয়া পার্ক। এর পাশের সড়ক ধরে কিছুদূর সামনে গেলে পড়বে শ্রীশ দাস লেন। এই লেনের এক নম্বর বাড়ির নাম ‘বিউটি বোর্ডিং’। পুরান ঢাকার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এখান থেকেই মোড় ঘুরে গিয়েছিল একটি দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির। আড্ডাবাজ একদল মানুষের হাত ধরে সৃষ্টি হয়েছিল অন্য এক জাতিসত্ত্বা।
ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্পী, সাহিত্যিকদের আড্ডার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বহু সুনাম রয়েছে এই ঐতিহাসিক স্থানের। তাদের মধ্যে উল্লেখেযোগ্য শামসুর রহমান, জিয়া আনসারী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুণ্ড, সমুদ্র গুপ্ত, সন্তোষ গুপ্ত, ফজল শাহাবুদ্দিন, কবি ইমরুল চৌধুরী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, ফয়েজ আহমদসহ অনেকে। টিভি ব্যক্তিত্ব ফজলে লোহানী, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, জাদুশিল্পী জুয়েল আইচকেও দেখা যেতো বিউটি বোর্ডিংয়ের আড্ডায়।

কালের সাক্ষী বিউটি বোর্ডিং রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে আড্ডা দিতে আসতেন গাজীউল হক, কমরেড আ. মতিন, অলি আহাদ, সাইফুদ্দীন মানিক প্রমুখ। চলচ্চিত্র শিল্পের কিংবদন্তি আব্দুল জব্বার খান বিউটি বোর্ডিংয়ে বসেই লেখেন বাংলার প্রথম সবাক ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’-এর চিত্রনাট্য। প্রখ্যাত সুরকার সমর দাস বহু কালজয়ী বাংলা গানের সুর সৃষ্টি করেছিলেন এখানে আড্ডা দেওয়ার ফাঁকে। বুলবুল চৌধুরী তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘অতলের কথকতা’য় তার বন্ধু সম্পর্কে লিখেছেন, ‘কায়েস আহমেদই আমাকে নিয়ে গিয়েছিল বিউটি বোর্ডিংয়ে জড়ো হওয়া কয়েকজন তরুণ সাহিত্যিকের সামনে। বিউটি বোর্ডিংয়ে সমবেত হতে পারার মাধ্যমে দেশের অনেক নবীন-প্রবীণ সাহিত্যিকের কাছাকাছি হতে পেরেছিলাম।’

কালের সাক্ষী বিউটি বোর্ডিং বাংলার ইতিহাসের সঙ্গে শত বছর ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিউটি বোর্ডিং। এর সাইনবোর্ড দেখে ভেতরে ঢুকতেই সামনে পড়বে একটুকরো বাগান। সেখানে ফুটে আছে নানান রঙের ফুল। বাগান থেকে চোখ ফেরাতেই দেখা যাবে হলুদ রঙা বিরাট একটি বাড়ি। এটি অনেকটা ‘এল’ আকৃতির। পুরোপুরি আড্ডার উপযোগী জায়গা। পাশে শোবার ঘর। পেছনে সিঁড়িঘর। সবই পুরনো বাড়ির রূপকথার গল্পের মতো সাজানো।
ভবনের নিচতলার একটি অংশে খাবার ঘর। সেখানে ছোট ছোট টেবিল আর চেয়ার পাতা। একসময় এই জায়গায় পিঁড়িতে বসে মেঝেতে থালা রেখে খাওয়ানো হতো। এখানে থালা, গ্লাস, জগ, বাটিসহ সব বাসন স্টিলের।

বিউটি বোর্ডিংয়ে বিভিন্ন রকমের সবজি বিক্রি হয়। এখানে প্রতিদিনকার মেন্যুতে থাকে বেগুন ভাজি, করলা ভাজি, কচু শাক, লাল শাক, কলা ভর্তা, শিম ভর্তা আর ধনেপাতার ভর্তা। সকালে একসময় আটার রুটির রেওয়াজ ছিল। এখন সকালের রুটির জায়গা নিয়েছে ভাত, আলু ভর্তা, ডিম ভাজি আর ডাল। রাতের রান্না সীমিত আকারের। এক পদের মাছ, সবজি আর ডাল। তবে দধি এখানে তিন বেলাই পাওয়া যায়। বিউটি বোর্ডিংয়ের দধির খুব চাহিদা। সব খাবারই বেশ তৃপ্তিদায়ক। সেই তুলনায় বিল যে খুব বেশি আসবে তা নয়।

কালের সাক্ষী বিউটি বোর্ডিং বিউটি বোর্ডিংয়ে বসে ইলিশের স্বাদ নিতে চাইলে খরচ করতে হবে ১৮০ টাকা। মুরগি ও খাসির মাংস ১০০ টাকা, খিচুড়ি প্রতি প্লেট ৪০ টাকা, পোলাও ৫০ টাকা, সবজি ৩০ টাকা, বড়া ১০ টাকা, চচ্চড়ি ৩০ টাকা আর একবাটি মুড়িঘণ্ট মিলবে ৭০ টাকায়, ভাজি ২০ টাকা। এখানে বিভিন্ন ধরনের ভর্তার দাম পড়বে ১৫-২০ টাকার মধ্যে।

বিউটি বোর্ডিংয়ের বর্তমান দুই মালিকের মধ্যে একজন তারক সাহা। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তার বাবা প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা ও চাচা নলিনী কান্ত সাহা মিলে বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ আরও কয়েকজনের সঙ্গে শহীদ হন প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা। শহীদদের স্মরণে এখানে ১৯৯৬ সালের ৬ ডিসেম্বর স্মৃতিফলক উন্মোচন করেন কবি শামসুর রাহমান। 
কালের সাক্ষী বিউটি বোর্ডিং তারক সাহা বলেন, ‘এই জায়গা ছিল বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির গুণী মানুষদের আড্ডার প্রাণকেন্দ্র। সমমনা মানুষদের নির্জলা আড্ডা চলতো দিনরাত। পঞ্চাশ, ষাট আর সত্তরের দশক ছিল বিউটি বোর্ডিংয়ের যৌবনকাল। তখন আড্ডা দিতে আসতেন সেই সময়ের প্রথিতযশা সাহিত্যিকেরা।’

১৯৭২ সালে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে এলে দুই ছেলে তারক সাহা ও সমর সাহাকে নিয়ে ফিরে আসেন প্রহ্লাদ সাহার সহধর্মিণী প্রতিভা সাহা। আবারও নতুন উদ্যমে শুরু হয় বোর্ডিংয়ের কার্যক্রম। এখনও তাদের পরিচালনায় চলছে এটি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখানে আড্ডা জমানোর জন্য প্রথম পদক্ষেপ নেন কবি বেলাল চৌধুরী ও শহীদ কাদরী। এরপর একে একে আসেন আরও অনেকে। বিউটি বোর্ডিংকে কেন্দ্র করেই দেশের শিল্প-সংস্কৃতির রেনেসাঁ ঘটে। এখন অবশ্য পুরনো দিনের মতো আর আড্ডা বসে না বিউটি বোর্ডিংয়ে। 

কালের সাক্ষী বিউটি বোর্ডিং যেভাবে যাবেন
ঢাকার বাইরে থেকে বাস,ট্রেন,লঞ্চ যেকোনও বাহনে আসা যাবে। বাসে এলে মহাখালী থেকে আজমেরী পরিবহন ও স্কাই লাইন বাস জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আসে। সেখান থেকে রিকশায় চড়ে যাওয়া যায়। গাবতলী থেকে ৭ নম্বর ও সাভার পরিবহন বাস আসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। তারপর রিকশায় চড়ে যেতে হবে। সায়দাবাদ থেকে বেছে নিতে পারেন রিকশা বা উবার। ট্রেনে এলে কমলাপুর থেকে উবার বা রিকশা করে যাওয়া যায়। লঞ্চে এলে সদরঘাট টার্মিনাল থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে বিউটি বোর্ডিং।

যেখানে থাকবেন
বিউটি বোর্ডিংয়ে চাইলে থাকা যাবে। এখানে সব মিলিয়ে ২৭টি থাকার ঘর আছে। এর মধ্যে ১৭টি সিঙ্গেল বেড ও ১০টি ডাবল বেড। সিঙ্গেল রুমের ভাড়া ২০০ টাকা আর ডাবল রুম ৪০০ টাকা। বিউটি বোর্ডিং ছাড়াও পুরান ঢাকার অলিগলিতে বিভিন্ন মানের অসংখ্য হোটেল রয়েছে। এগুলোতে মিলবে এসি ও নন-এসি সিঙ্গেল আর ডাবল রুম। উন্নত হোটেলের রুমে পরিপাটি সজ্জা, টেবিল-চেয়ার, ইন্টারকম, টেলিফোন, টেলিভিশন আর বাথরুমে তোয়ালে, সাবান, শ্যাম্পু, গিজার, টুথব্রাশ ও পেস্ট প্রভৃতি পাওয়া যাবে। তবে সাধারণ হোটেলের রুমে থাকে শুধু বিছানা, চেয়ার-টেবিল, ফ্যান ও লাইট। এসব হোটেলে নগদ প্রদানের পাশাপাশি ক্রেডিট কার্ডে বিল পরিশোধের ব্যবস্থা রয়েছে।

/জেএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা