জাদুঘর হলো সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞান আর শিল্পকর্মের উৎস। প্রতি বছর ভ্রমণপিপাসুদের মধ্যে বিশ্বের কিছু জাদুঘর নিয়ে আগ্রহ বেড়ে চলেছে। দেশ-বিদেশের বিচিত্র জাদুঘরে শত-সহস্র বছরের প্রাচীন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। এগুলো একেকটি ইতিহাসের সাক্ষী।
গত বছর সবচেয়ে বেশি ঘুরে দেখা হয়েছে এমন ২০টি জাদুঘরে দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল ১০ কোটি ৭০ লাখ দর্শনার্থী। এই সংখ্যা ২০১৬ সালের তুলনায় বেড়েছে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ। এর মধ্যে শীর্ষ দশে স্থান পাওয়া জাদুঘর নিয়ে এই রচনা।
১. দ্য লুভর, প্যারিস
বিশ্বের বৃহৎ শিল্পকর্ম নির্ভর জাদুঘরের মধ্যে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অবস্থিত দ্য লুভর অন্যতম। ২০১৭ সালে সেখানে গিয়েছিলেন ৮৬ লাখ দর্শনার্থী। এই সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ৯ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি। একসময় এটি ছিল ফরাসি রাজাদের প্রাচীন দুর্গ। ১১৯০ খ্রিস্টাব্দে রাজা ফিলিপ অগাস্টাস এই ভবন গড়ে তোলেন। জাদুঘর হিসেবে এটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় ১৭৯৩ সালের ৮ নভেম্বর। লুভরে ১ লাখ ৯৫ হাজার বর্গমিটার জায়গা আছে। এর মধ্যে প্রদর্শনীর জন্য বরাদ্দ ৬০ হাজার ৬০০ বর্গমিটার। জাদুঘরটিতে প্রদর্শনী সাতটি বড় অংশে বিভক্ত। প্রাচীন সভ্যতা থেকে শুরু ইসলামি শিল্প, সবই রয়েছে এখানে। বিশ্বের খ্যাতিমান বেশিরভাগ চিত্রকরের আঁকা হাজারেরও বেশি সৃষ্টিকর্ম আছে লুভরে। এ তালিকায় আছেন বেলজিয়ান শিল্পী পিটার পল রুবেনস, ডাচ চিত্রকর রেমব্র্যান্ডট ও জোহানেস ভারমির, ইতালিয়ান চিত্রশিল্পী তিতিয়ানসহ অনেকে। লুভরে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা ‘মোনালিসা’। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকর্মের মধ্যে রয়েছে ‘কোড অব হামমুরাবি’ কিংবা ফরাসি শিল্পী ইউজিন দ্যুলাকোঁয়ার আঁকা চিত্রকর্ম ‘লিবার্টি লিডি দ্য পিপল’।
২. ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব চায়না, বেইজিং
গণপ্রজাতন্ত্র চীনের প্রতিষ্ঠার দশম বার্ষিকীতে ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব চায়নার নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ ও আধুনিক জাদুঘরের মধ্যে এটি অন্যতম। ২০১৭ সালে এতে ঢুকেছিলেন ৮০ লাখেরও বেশি দর্শনার্থী, যা আগের বছরের চেয়ে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। ২০০৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এর উদ্বোধন হয়। তবে সংস্কার ও পুনর্নির্মাণের জন্য চার বছর পর বন্ধ করা হয়েছিল চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের এই জাদুঘর। ২০১১ সালের ১ মার্চ এটি আবারও চালু হয়। সেখানে মোট ৪৮টি প্রদর্শনীর হলরুম রয়েছে। প্রাচীন চীন ও ‘রোড টু রেজুভেনেশন’ হলো মূল আকর্ষণ। ১৭ লাখ বছর আগেকার চীনের ইতিহাস থেকে শুরু দেশটির শেষ রাজবংশের সময়কার অনেক কিছুই রয়েছে এখানে। এছাড়া পরবর্তী সময়ে চীনে সাম্যবাদের উত্থানের ইতিহাসও জানা যাবে এই জাদুঘরে। বিশ্বের সবচেয়ে ভারী তামার বস্তুও দেখা যায় সেখানে।
৩. ন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়াম, ওয়াশিংটন, ডি.সি
ন্যাশনাল এয়ার মিউজিয়াম নামে ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এই জাদুঘর। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন, ডি.সি’র এই স্থানের নাম এখন ‘ন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়াম’। ২০১৭ সালে সেখানে ৭০ লাখ দর্শনার্থী ঘুরেছে। যদিও এই সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ৬ দশমিক ৭ শতাংশ কম। আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় জাদুঘর এটাই। ন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়ামকে বলা যেতে পারে আকাশযান ও নভোযানের ঐতিহাসিক বিজ্ঞানের গবেষণাগার। সেখানে প্রায় ৬০ হাজার উড়োজাহাজের মূল নমুনা রয়েছে। এগুলোর অবয়বেই তৈরি করা হতো প্রতিটি উড়োজাহাজ। এই জাদুঘর দুটি ভবনে বিভক্ত। এর একটি ওয়াশিংটন ডি.সি মলে, অন্যটি ওয়াশিংটন ডুলেস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশে উডভার-হ্যাজি সেন্টারে। জাদুঘরটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হলো অ্যাপোলো ইলেভেন ও ফ্রেন্ডশিপ সেভেনের নমুনা আর এক পাখার বিমান ‘স্পিরিট অব সেন্ট লুইস’ ও বিশ্বের প্রথম বিমান আবিষ্কারক অরভিল ও উইলবুর রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের আকাশযান।
৪. দ্য মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট, নিউ ইয়র্ক সিটি
অনেকেই হয়তো নিউ ইয়র্ক সিটির ফিফটি সেভেন্থ স্ট্রিট ও ফিফথ এভিনিউতে অবস্থিত মিউজিয়াম মাইলের কথা শুনেছেন। ওই শহরেই যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বৃহৎ ও সেরা জাদুঘর মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট। ২০১৭ সালে সেখানে যাওয়া দর্শনার্থীর সংখ্যা ৭০ লাখ। যা আগের বছরের তুলনায় ৪ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি। এই জাদুঘরে প্রস্তরযুগের প্রায় সব শিল্পকর্ম থেকে শুরু করে পপ আর্টের উদাহরণ মিলবে। আফ্রিকা, ওশেনিয়ান ও মধ্যপ্রাচ্যের শিল্পকলার সংগ্রহশালা আছে এই জাদুঘরে। এর মিলনায়তনের বিশেষত্ব হলো, সাত শতাব্দীর পাঁচ মহাদেশের অধিবাসীদের পরা পোশাকের সম্মিলন। বিভিন্ন দেশের শিল্পকর্ম ও স্থাপত্যের পাশাপাশি মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্টে আছে বাদ্যযন্ত্র। অবশ্য আমেরিকার শিল্পকর্মই এর মূল আকর্ষণ।
৫. দ্য ভ্যাটিকান মিউজিয়াম, রোম
বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাদুঘর ‘দ্য ভ্যাটিকান মিউজিয়াম’। ইতালির রাজধানী রোমে ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস স্থাপিত জাদুঘর কমপ্লেক্সের অংশ এটি। সেখানে ২০১৭ সালে ঘুরেছেন ৬৪ লাখ দর্শনার্থী, এই সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ৫ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি। ভ্যাটিকান মিউজিয়ামে আছে ১ হাজার ৪০০টি হল ও ৫০ হাজার নিদর্শন। এর পুরোটা ঘুরে দেখতে হলে হাঁটতে হবে ৭ কিলোমিটারেরও বেশি। এই জাদুঘরের কাঠামো বেশ অদ্ভুত। এখানকার মূল মূল আকর্ষণ সিস্তিনে চাপেল।
৬. সাংহাই সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি মিউজিয়াম, সাংহাই
২০০১ সালের ডিসেম্বরে চীনের সাংহাই শহরে সাংহাই সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি মিউজিয়ামের উদ্বোধন হয়। ২০১৭ সালে এই জায়গায় গেছে ৬৪ লাখ দর্শনার্থী, এই সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ১ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি। এটাকে বলা হয়ে থাকে চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। প্রকৃতি, মানবজাতি ও প্রযুক্তি থিম নিয়ে মতাদর্শগত অগ্রগতি ও আধুনিক বিজ্ঞানের প্রচারণা হয় সেখানে। ১৪টি প্রদর্শনী কক্ষের পাশাপাশি ৪টি বিজ্ঞানভিত্তিক সিনেমা হল রয়েছে এই জাদুঘরে। স্মরণীয় প্রদর্শনীর তালিকায় আছে স্পেক্ট্রাম অব লাইফ, লাইট অব উইশডম, ওয়ার্ল্ড অব রোবটস ও স্পেস নেভিগেশন। জাদুঘরটি দুটি শাখায় বিভক্ত। একটিতে প্রাকৃতিক জীবন ও বিভিন্ন প্রজাতিসহ অনেক কিছু আছে। অন্যটি কম্পিউটিং, রোবোটিক্স ও মহাশূন্যে ভ্রমণ বিষয়ক ইন্টারেক্টিভ প্রদর্শনী।
৭. ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি, ওয়াশিংটন, ডি.সি
যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন, ডি.সি’তে ১৯১০ সালে চালু হয় ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি। বিশ্বের বৃহত্তম প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘরগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। ২০১৭ সালে সেখানে ঘুরেছেন ৬০ লাখ দর্শনার্থী, যা আগের বছরের তুলনায় ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি। প্রাণীকূল, উদ্ভিদ জগত, ফসিলস, উল্কাপিণ্ড ও মানবসম্পদ নিয়ে এতে রয়েছে ১২ কোটি ৬০ লাখেরও বেশি শিল্পকর্ম। জীববৈচিত্র্যের এই জাদুঘরের সঙ্গে যুক্ত আছেন ১৮৫ জন পেশাদার বিজ্ঞানী। মূল ভবনের আয়তন ১ লাখ ৪০ হাজার ২০০ বর্গমিটার। এর মধ্যে প্রদর্শনীর জন্য বরাদ্দ ৩০ হাজার ২০০ বর্গমিটার। সেখানকার জনপ্রিয় জিনিসের মধ্যে রয়েছে বিশাল তিমির রেপ্লিকা, কীট চিড়িয়াখানায় বিষাক্ত মাকড়সা ও স্যান্ট ওশান হৈলের বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী।
৮. ব্রিটিশ মিউজিয়াম, লন্ডন
যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে সরকারি উদ্যোগে ব্রিটিশ মিউজিয়াম স্থাপিত হয় ১৭৫৩ সালের ৭ জুন। তবে জনসাধারণের জন্য এটি উন্মুক্ত হয়েছে ১৭৫৯ সালের ১৫ জানুয়ারি। ২০১৭ সালে এই জাদুঘরে ৫৯ লাখ দর্শনার্থীর পা পড়েছে। এই সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ৮ শতাংশ কম। এই জাদুঘরের আরেক নাম ‘মিউজিয়াম অব স্টোলেন মাস্টারপিসেস’ ও ‘মিউজিক অব অল সিভিলাইজেশনস’। অর্থাৎ চুরি হওয়া অমূল্য জিনিসের জাদুঘর ও সব সভ্যতার জাদুঘর। এর কারণ সেখানকার ভাণ্ডার সৎ উপায়ে আসেনি। যেমন, মিসরে নেপোলিয়নের সৈন্যদের কাছ থেকে ডাকাতি করে নেওয়া হয়েছে রোসেট্টা পাথর।
৯. টেট মডার্ন, লন্ডন
২০০০ সালে গড়ে ওঠা ‘টেট মডার্ন’ হলো যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক আধুনিক শিল্পকলার জাতীয় চিত্রশালা। ২০১৭ সালে এই জায়গায় গেছে ৫৬ লাখ দর্শনার্থী। যদিও তা আগের বছরের তুলনায় ৩ দশমিক ১ শতাংশ কম। জাদুঘর হলেও ‘টেট মডার্ন’ মূলত চিত্রশালা। ঊনিশ শতক থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ের ব্রিটিশ ও আন্তর্জাতিক চিত্রকর্ম রয়েছে সেখানে। বিশ্বব্যাপী আধুনিক ও সমকালীন শিল্পকলার সবচেয়ে বড় জাদুঘরের মধ্যে এটি অন্যতম। এতে থিম ও বিষয়ভেদে নামযুক্ত আটটি স্থান রয়েছে। একসময় টারবাইন হলে সমকালীন চিত্রশিল্পীদের অস্থায়ী প্রদর্শনী হতো। স্প্যানিশ চিত্রকর পাবলো পিকাসো, ফরাসি শিল্পী অঁরি মাতিজ, স্প্যানিশ নকশাকর সালভাদর দালি ও জার্মান চিত্রকর ম্যাক্স আর্নস্টের গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টিকর্ম রয়েছে এই জাদুঘর। আমেরিকান শিল্পী অ্যান্ডি ওয়ারহল ও রয় লিশটেনস্টেইনের পপ আর্টও স্থান পেয়েছে এতে।
১০. ন্যাশনাল গ্যালারি অব আর্ট, ওয়াশিংটন, ডি.সি.
তালিকার সবশেষে আছে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন, ডি.সি’র ন্যাশনাল গ্যালারি অব আর্ট। ২০১৭ সালে এই জাদুঘরে ৫২ লাখ দর্শনার্থীর পা পড়েছে। এই সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ২২ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। ১৯৩৭ সালে ন্যাশনাল গ্যালারি অব আর্ট গড়ে তোলে তৎকালীন মার্কিন সরকারের দ্বিপাক্ষিক আইন পরিষদ ইউএস কংগ্রেস। আমেরিকার সংগ্রাহক পল মেলন ও স্যামুয়েল হেনরিসহ অনেকের দান করা জিনিসই সেখানে বেশি। মধ্যযুগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পশ্চিমা শিল্পকলার বিবর্তনের সাক্ষী এই জাদুঘর। আমেরিকায় বসে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা একমাত্র ছবিটিও আছে এর মধ্যে। সব মিলিয়ে মোট ১ লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি চিত্রকর্ম, ড্রয়িং ও ভাস্কর্য রয়েছে ন্যাশনাল গ্যালারি অব আর্টে।
সূত্র: ট্যুরিজম-রিভিউ