X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০
ট্রাভেলগ

শ্রীমঙ্গলের শীতসন্ধ্যা

সালমান তারেক শাকিল
২১ জানুয়ারি ২০১৯, ১১:০০আপডেট : ২১ জানুয়ারি ২০১৯, ১৪:৩৬

নূরজাহান টি গার্ডেনের ভেতর দিয়ে এই সড়কটি চলে গেছে মাধবপুর লেকে শ্রীমঙ্গলে সন্ধ্যা নামে খুব ধীরে-ধীরে। সূর্যাস্তের পরও ঝিমঝিম করে আলো সরে যায়। লাউয়াছড়া বনের ভেতর দিয়ে যে সড়কটি ভানুগাছ থেকে শ্রীমঙ্গল শহরের দিকে গেছে, এর বড় অংশজুড়ে লাউয়াছড়া বন। জানুয়ারির প্রথম ভাগে আমরা কয়েকজন বন্ধু শীত দেখতে শ্রীমঙ্গল যাই। বলা যায় ঘুরতে নয়, অবকাশে।

হামহাম ঝরনা, লাউয়াছড়া বন, বাইক্কা বিল, চা বাগান, লালটিলাসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে আমাদের যাওয়া হয়নি। বড় একটি কারণ, তীব্র শীত। আর শ্রীমঙ্গলের শীত একটু আলাদাই। আমরা যারা নগরে কাজের ব্যস্ততায় প্রতিদিনের হাঁসফাঁস করা রুটিন কাটাই, তাদের জন্য কম খরচে শ্রীমঙ্গলই ভালো হতে পারে। আমরা গিয়েছিলাম রাতের উপবনে। ঢাকা থেকে সিলেট, রাত ১০টার দিকে ছেড়ে পৌনে ৩টায় ট্রেন আমাদের পৌঁছে দেয় শ্রীমঙ্গল রেলস্টেশনে। সেদিন লাউয়াছড়া বনের ভেতর দিয়ে সন্ধ্যার চেহারা দেখতে-দেখতে ফিরছিলাম আমাদের হিমাচল রিসোর্টে। রাধানগরের হিমাচল।

জঙ্গলে সন্ধ্যার একটা নিজস্ব রূপ থাকে। অন্ধকারের রঙ কখনও কালো, কখনও নীল। নানান বন্যপ্রাণীর ডাকাডাকি আর উড়ে যাওয়ার শব্দ গাছের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের সিএনজির স্বাভাবিক শব্দ কিছুটা ব্যাঘাত ঘটালেও চালক শাহজাহান ভাই নিঃশব্দে বন দেখার সুযোগ দিলেন। তিনিই আমাদের গাইড। মাঝবরাবর একটি সেতুর ওপর সিএনজি দাঁড় করিয়ে আমরা কিছু সময় বন দেখি, গভীরতা শোনার চেষ্টা করি। লম্বা বাঁশগাছের ওপর দিয়ে উড়ে যায় কয়েকটি পাখি। সুন্দরের বর্ণনা শব্দে যতটা আসে, বাস্তবে কিন্তু তা নয়। পরিবেশ-প্রতিবেশ সুন্দরের প্রতিশব্দ হয়ে ওঠে কখনও-কখনও। বিশেষ করে আমরা যারা নগরে বসবাস করছি, তাদের কাছে।

শাপলা শোভিত মাধবপুর লেক এই চা বাগান তো খানিক পর সমতলে ধান বোনা। আধা কিলোমিটার এগোতে দেখি ধানকাটা ক্ষেতে ছেলেমেয়েরা দুলে দুলে খেলছে। উত্তরের দিকে মণিপুরী পাড়া, পূর্বে মাধবপুর লেক, পাশের মৌলভীবাজার জেলা শহরের সীমানা ছাড়ালে শ্রীমঙ্গলের দ্যোতনা ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়। আমাদের ঘোরাঘুরির কোনও নিয়ম ছিল না। ঘুমকে প্রাধান্য দিয়ে যতটা সম্ভব আরামে সময়টা কাটানো গেছে।

মণিপুরী পাড়ায় বাচ্চাদের খেলা হিমাচল রিসোর্টের আতিথেয়তায় খাবার নিয়ে দুশ্চিন্তা হয়নি। আমাদের বন্ধুদের জন্য আলাদা করে বোয়াল কিনে আনলেন রিসোর্টের অভিভাবক আশরাফুল আলম সোহেল। রাতে খালার হাতের হাঁসের ঝোল। কী দারুণ! খালা অপেক্ষায় থাকতেন, খাবারের একপর্যায়ে আমরা বলি কিনা রান্নাটা কেমন হলো। বাড়িতে আম্মা, আমার স্ত্রী বা বড়াপা বা ছোটাপার রান্না খেতে বসলে প্রশংসা শোনার যে প্রতীক্ষা, খাবারের সঙ্গে আপনজনদের এই প্রতীক্ষা দেখারও সৌভাগ্য লাগে।

মণিপুরী পাড়ায় কাপড়ের দোকান আমাদের শহরে তো এখন অতিথিপরায়ন ব্যবসা নেই। মানুষকে জিতিয়ে দেওয়ার যে ব্যবসা, আমরা দোকানে-দোকানে খাবো স্বাস্থ্যকর খাবার, স্বাদে জিভ-মুখ ভিজে থাকবে। কিন্তু তা আর কই! খাবারের ব্যবসায়ীরা যেন মানুষকে মেরেই ব্যবসা করবেন! এই লক্ষ্যের কোনও প্রতিবাদ হয় না। কখনও কখনও অপেক্ষা করাই সংগ্রামের অংশ। আমাদের খাবারের দোকানগুলোয় কী এই প্রতীক্ষা মেলে, শ্রীমঙ্গলের খালার মতো? চেয়ার থেকে উঠে এসে ম্যানেজারকে বলতে শোনেন, ‘খাবার কেমন হয়েছে? কোনও সমস্যা হয়নি তো?’ এমন?

শ্রীমঙ্গলের শীতসন্ধ্যা গাইড ও চালক শাজাহান ভাইয়ের চাপে মূলত আমাদের মণিপুরী পাড়া ও মাধবপুর লেক দেখা সম্ভব হয়েছে। সম্ভব হয়েছে মুড়ালি খাওয়ার, গরম জিলাপি আর মুকলেস মিয়ার কাঁচাপাতির চা। চায়ের গল্প বললে, সেরা চা খেয়েছি শ্রীমঙ্গল শহরে হানিফ বাস কাউন্টারের পাশে। নিরিবিলি কাটখাট্টা লম্বা মানুষটা শুধু চায়ের কাপে তাকিয়ে কথা বলেন। গম্ভীর এই লোকটার মুখে সুন্দর একটা হাসি ফোটে, যদি বলেন চা কেমন হয়েছে।

শ্রীমঙ্গলের শীতসন্ধ্যা শাজাহান ভাইয়ের বিশেষ উৎসাহে মণিপুরী পাড়ায় প্রথম ঘুরতে যাই। যেতে-যেতেও সন্ধ্যা। পঞ্চাশোর্ধ্ব একজন চাচির হাতে বানানো পেঁয়াজু, বেগুণি আর সালাদ খেয়ে শুরু মণিপুরী পাড়া দেখা। শ্রীমঙ্গলের রামনগর এলাকায় আদিবাসী এই জনগোষ্ঠীর বসবাসের এলাকা। গোছানো বাড়ি, সামনে দিয়ে পরিপাটি টিন বা ইট বা বেড়ার পর্দা। কোনও বাড়ির গেট দিয়ে লতিয়ে উঠেছে সিম গাছ। কারও বাড়ির সামনেই বড়ই গাছ। আধাপাকা বড়ইয়ে আমাদের মুখেও এসেছে তৃপ্তি।

শ্রীমঙ্গলের শীতসন্ধ্যা সন্ধ্যার আগে-আগে মণিপুরী শিশুদের হাততোলা খেলা নতুন করে শৈশবের আমেজ পেয়ে ফুরিয়ে গেছে অনেক সময়। এখানে নিজেদের শৈশবের স্মৃতিমুগ্ধ সময়ে ডুবেছি। শাজাহান ভাই, রাস্তায় স্থানীয় এমপির উদ্বোধনের নামফলক দেখিয়ে বলেন, ‘এই এমপি তো এলাকাতেই আসে না, প্রতিটি রাস্তার ওপর তার নামই দেখা যায়।’

শ্রীমঙ্গলের শীতসন্ধ্যা শাজাহান ভাইয়ের কথায় রস ছিল। শ্রীমঙ্গলে অবশ্য খেজুরের রস খুঁজেছি, কিন্তু হতাশ হতে হলো। সোহেল ভাই জানালেন, শ্রীমঙ্গল এলাকায় খেজুরের গাছ প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু আমাদের দেখা হয়েছে রাবার বাগান। স্থানীয় রাবার শ্রমিকদের রাবার গাছের তলায় মূর্তি রেখে রাবার সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখেছি। কর্মস্থলে নিজের বিশ্বাসের প্রতিফলন আমাদের বাঙালিদের মধ্যে প্রবল।

মণিপুরী পাড়ায় আমরা চা খেয়েছি চন্দ্রজিৎ সিংহের দোকানে। খুব ছোট দোকানের ভেতরে চন্দ্রজিৎ তার বন্ধুর সঙ্গে বসে আমাদের চা বানিয়ে খাওয়ান। ছাকনির ভেতরে চা পাতা রেখে গরম পানি খুব ধীরে-ধীরে ঢেলে চা বানিয়েছেন। তার দোকানে দুধ চা নেই, লাল চা। এই চায়ের স্বাদ আমার ভ্রমণসঙ্গী বন্ধু ভুলতে পারেনি।

রাধানগরের স্থানীয় বাজার চায়ে চুমুক দিয়ে মণিপুরী বাচ্চাদের খেলা দেখতে চলে আসি। রাজীব সিংহ, চৈতি সিংহরা ১০-১২ জন মিলে হাততোলা খেলছে। এই খেলাটা আমাদের হবিগঞ্জ এলাকায়ও আছে, নাম ভুলে গেছি।

মণিপুরী পাড়ার আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, স্থানীয়দের কাপড়ের দোকান। তাঁতের কাপড়ের এসব দোকানে ক্রেতাদের আনাগোনা নিয়মিত। অলক মণিপুরী হ্যান্ডক্রাফটের মালিক অনিতা দেবী জানান, বেচাকেনা ভালো। কাপড়ের মূল্য নির্ভর করে ডিজাইন ও মানের ওপর। তারা নিজেরাই ঘরে দোকানের সব কাপড় বোনেন।

মণিপুরী পাড়া বাচ্চাদের খেলা যে মাঠে চলছিল, ওই মাঠের কোণেই আবার পলিথিনসহ বর্জ্যের ভাগাড় দেখলাম। এই ময়লা বা প্লাস্টিকের বর্জ্য কে ফেলে রাখে, তার কোনও জবাব আমরা না পেলেও মাধবপুর লেকে কারা ময়লা ফেলে রাখে, তার উত্তর আমরা পেয়েছি। লেকের পাশে হাঁটার রাস্তায় বা চা বাগানের পাদদেশে চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিকের পানির বোতল বা বিস্কুটের খালি প্যাকেট দেখে আমরা বুঝতে পারি, আমাদের মতোই পর্যটকরা উদরের ফুর্তি করে বর্জ্যগুলো ফেলে রেখে গেছেন। কিন্তু কেন? আমি এগুলো রাস্তাঘাটে ফেলি না, তাই বলতে পারবো না— কেন বা কারা ফেলে রেখে গেছে। কিন্তু এই ফেলে রাখার মধ্য দিয়ে চা শ্রমিকদের কাছে নিজেদের কী পরিচয় দিয়ে আসি, তা বলাই অবান্তর।

মাধবপুর লেক দেখানোর দায়িত্ব ছিল ১২-১৪ বছরের অন্তরের। স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি সে পর্যটকদের লেক ঘুরিয়ে দেখায়। দেখিয়ে দেয়, কীভাবে কোন পাহাড়ে উঠে লেক দেখাটা বেশি সুন্দরের। লেকের জলে শরীর ভিজিয়ে নেওয়ার একটা লোভ জাগলেও গাইড অন্তরের কঠোর বার্তা— এখানে গোসল করা নিষেধ। স্বচ্ছ ও সতেজ পানির লেকের পাড়ে বসে অবশ্য মাছ ধরা যায় ছিপে। কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে বড়শি পাতা যায়। অন্তর জানায়, গঠনে অনেক বড় বড় মাছও পাওয়া গেছে এই লেকে। উঁচু পাহাড়ের মাঝখানে ছায়াশোভিত স্বচ্ছ পানির লেক আমাদের প্রশান্তি দেয়।

মণিপুরী পাড়া সৌন্দর্যের কথা বললে শুধু মাধবপুর লেক নয়, পুরো শ্রীমঙ্গলই দেখার জায়গা। পাহাড়, সমতল, ধানক্ষেত, পাহাড়ি লেবু, আনারস ক্ষেত ইত্যাদি। শ্রীমঙ্গল শহরে আমরা একটি পাখির সংগ্রহশালা দেখেছি। রঙ-বেরঙয়ের টিয়া পাখি, ময়ূরপঙ্খী, বানর, হরিণ, উটপাখিসহ নানান প্রজাতির প্রাণী রয়েছে।

চা বাগান, লেক, মণিপুরী পাড়া, লাউয়াছড়া বনের গন্ধে মিশে থাকা শ্রীমঙ্গলের অবিরাম সৌন্দর্য পুরো এলাকায়। বিশেষ করে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে তীব্র শীত আর সুনসান নীরবতা নেমে আসে। রাত বাড়তে থাকলে এই নীরবতা আলাদা সৌন্দর্যে রূপ নেয়। পাহাড়ের সড়ক ধরে রাতপ্রহরীর হেঁটে চলা, নীল প্যান্টের পকেটে থাকা মোবাইল ফোনে বাজতে থাকা পুরনো দিনের গান শুনেছি হিমাচল রিসোর্টে বসে।

মাধবপুর লেক পাড়ে লেখক ছবি: স্বচ্ছ, মহান, আদর্শ ও স্বদেশ

/জেএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা