কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে মঙ্গলবার (১২ ফেব্রুয়ারি) শুরু হয়েছে ৪০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী কুড়িখাই মেলা। স্থানীয়দের পাশাপাশি সপ্তাহব্যাপী এই আয়োজনকে ঘিরে উৎসবে মেতে উঠেছে আশেপাশের এলাকার মানুষ। কুড়িখাইসহ কাছের গ্রামগুলোতে এখন ঈদের আমেজ। ইতোমধ্যে বাড়িতে বাড়িতে শুরু হয়ে গেছে পিঠা বানানোর উৎসব।
মেলা উপলক্ষে গ্রামের জামাইদের দাওয়াত দিয়ে আদর-আপ্যায়ন করা এখানকার রীতি। সেই সঙ্গে বাবার বাড়িতে নাইওরে আসে গ্রামের মেয়েরা। মেলার অন্যতম আকর্ষণ মাছের হাটে দাওয়াতি জামাইরাই মূল ক্রেতা। মেলা থেকে মাছ কিনে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যাওয়া এখানকার পুরনো রীতি।
বড় বড় বিভিন্ন জাতের মাছ উঠেছে মেলায়। চড়া দামে বিক্রিও হচ্ছে এসব। লোকজনের বিশ্বাস, মেলার বোয়াল মাছ খেলে বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তাই মেলায় বোয়াল মাছের চাহিদা একটু বেশি। ময়মনসিংহ থেকে বেশকিছু বড় বোয়াল মাছ বিক্রির জন্য এনেছেন আবদুর রহমান। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, অন্তত ৩০ হাজার থেকে অর্ধলক্ষ টাকায় একেকটি মাছ বিক্রি করতে পারবেন। তার একটি মাছ ৩১ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. ইসমাইল মিয়া কয়েকজন বন্ধুকে উপহার দেওয়ার জন্য মেলায় মাছ কিনতে এসেছেন। তার এলাকায় মেলা হয় বলে অনেক বন্ধু প্রতি বছর বেড়াতে আসে। বন্ধুরা মিলে বড় মাছ কিনে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আছে নেত্রকোনা থেকে মেলা দেখতে আসা রাজিব হাসানের। তার চোখে, ‘অত্যন্ত চমৎকার একটি গ্রামীণ মেলা এটি। এখানে আসার ইচ্ছে ছিল অনেকদিনের। পাঁচ বন্ধু মিলে মেলায় এসেছি।’
প্রতি বছর মাঘ মাসের শেষ মঙ্গলবার কুড়িখাই গ্রামে শুরু হয় মেলা। এটি জেলার সবচেয়ে বড় গ্রামীণ মেলা হিসেবে পরিচিত। শুধু কটিয়াদী নয়, জেলার বিভিন্ন এলাকার উৎসুক মানুষদের সমাগম হয় মেলায়। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে এই মেলা। মাজার প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় ধর্মীয় অনুষ্ঠান।
মেলায় বন্ধুদের নিয়ে বেড়াতে এসেছেন সোমা ইসলাম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বললেন, ‘প্রতি বছর এ মেলার জন্য আমরা অপেক্ষা করে থাকি। ঈদের মতো বন্ধুরা মিলে আমরা আনন্দ করি। এবারও খুব ভালো লাগছে।’
কিশোরগঞ্জ থেকে মেলা দেখতে এসেছেন মামুন, শফিক ও রাজিব। তাদের মধ্যে রাজিব বেশ কয়েকবার এই মেলায় এসেছেন। তার মন্তব্য, ‘এমন গ্রামীণ মেলা এখন খুব কম হয়। সবাই মিলে গরম জিলাপি কিনে খেয়েছি। মোটরসাইকেল রেসসহ অনেক কিছু দেখার মতো আছে মেলায়। এছাড়া রাতে নাচ-গান হয়।’
মেলার দোকান বরাদ্দ থেকে আয়কৃত অর্থ মাজার ও মসজিদের উন্নয়ন কাজে ব্যবহার হয়। এবার কুড়িখাই গ্রামের এক থেকে দেড় কিলোমিটার এলাকায় বসেছে বিভিন্ন দোকানপাট। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মেলার সরঞ্জাম নিয়ে এসেছেন অনেকে। এর মধ্যে আছে কাঠের আসবাবপত্র, শিশুদের খেলনা, দৈনন্দিন পণ্যসামগ্রী, মেয়েদের সাজগোজের জিনিস থেকে শুরু করে মুড়ি, মিষ্টি, খৈ ইত্যাদি। শিশুদের জন্য আছে পুতুলনাচ, সার্কাস, মোটরসাইকেল রেস নাগরদোলাসহ বেশকিছু আয়োজন।
মেলার আরেক আকর্ষণ, শেষ দু’দিনের বউমেলা। ওই দু’দিন নারীরা মেলায় গিয়ে কেনাকাটা ও আনন্দ করেন। আগামী ১৭ ফেব্রুয়ারি আখেরি মোনাজাতের পর শেষ হবে মেলা।
ইসলাম ধর্ম প্রচারক শাহ শামসুদ্দিন বুখারির (রহ.) মাজারের ওরশকে ঘিরে বসে এই আয়োজন। মুসলমানদের উৎসব হলেও এতে অংশ নেয় সব ধর্মের লোকজন। কথিত আছে— শাহ শামসুদ্দিন বুখারি (রহ.) তিনজন সঙ্গী নিয়ে কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার মুমুরদিয়া ইউনিয়নের কুড়িখাই এলাকায় ইসলাম ধর্মের প্রচার শুরু করেন। তিনিই এই অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রথম প্রচারক। তার মৃত্যুর পর ভক্তরা মাজারকে ঘিরে কুড়িখাই মেলার প্রবর্তন করে।
মেলা কমিটির সদস্যরা বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, প্রায় ৪০০ বছর ধরে কুড়িখাই মেলা হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে এটি সর্বজনীন উৎসব ও ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে। মেলার আগের রাতে বাউলদের ভক্তিমূলক গান আর ফিরনি বিতরণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় আনুষ্ঠানিকতা। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি।
কুড়িখাই মেলা উদযাপন কমিটির সদস্য আলী আকবর শাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রশাসনের সহযোগিতায় মেলায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দর্শনার্থীসহ দোকানদারদের যেন কোনও অসুবিধা না হয় সেদিকে আমরা সজাগ আছি। শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক পালাক্রমে কাজ করছে। ঐতিহ্যবাহী কুড়িখাই মেলা এবারও শান্তিপূর্ণ আর উৎসবমুখর পরিবেশে শেষ হবে।’