X
বুধবার, ০৮ মে ২০২৪
২৫ বৈশাখ ১৪৩১

পুরান ঢাকার অলিগলিতে: খান মোহাম্মদ মির্জা মসজিদ ও আজিমপুর দায়রা শরীফ

সোহেলী তাহমিনা
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০৭আপডেট : ২৬ মার্চ ২০১৯, ২০:১৫

সুলতানি, মোগল, নবাবি, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলের পর আমাদের প্রাণের ঢাকা শহর ৪০০ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে এসেছে। ইতিহাসের কিছু কিছু অংশের প্রভাব কোথাও খুব বেশি, কোথাওবা একেবারেই নেই। ইতিহাস ও আধুনিকতাকে একসঙ্গে বয়ে চলেছে এই শহরের বিশেষ অংশ পুরান ঢাকা। এখানে ইতিহাস এখনও কথা বলে, ঐতিহ্য সগৌরবে মাথা উঁচু করে চলে। এই পুরান ঢাকার ঐতিহ্য, ঐতিহাসিক স্থান, সংস্কৃতি খাবার নিয়ে জার্নির ধারাবাহিক আয়োজন।

পুরান ঢাকা মানেই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অনন্য সমন্বয়। খান মোহাম্মদ মির্জা মসজিদ ও আজিমপুর দায়রা শরীফ পুরান ঢাকার ইতিহাসের দুটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এগুলোর রয়েছে স্বকীয় ইতিহাস ও স্থাপত্যশৈলী।

খান মোহাম্মদ মির্জা মসজিদ খান মোহাম্মদ মির্জা মসজিদ
পুরান ঢাকার অন্যতম নিদর্শন লালবাগ কেল্লার পশ্চিম দিকে আধা কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে অবস্থিত খান মোহাম্মদ মির্জা মসজিদটি নির্মাণ হয় ১৭০৪-০৫ খ্রিষ্টাব্দে। মসজিদ প্রাঙ্গণে অবস্থিত দুটি পারস্য দেশীয় ফলকলিপি থেকে এর নির্মাণ সম্পর্কে জানা যায়। ঢাকার তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর ফারুখ সিয়ারের সময়কালে কাজী ইবাদুল্লাহর আদেশক্রমে এটি তৈরি হয়।

খান মোহাম্মদ মির্জা মসজিদের মূল প্রার্থনা স্থানের প্রবেশপথ ধারণা করা হয়, এই মসজিদের স্থপতি ছিলেন খান মোহাম্মদ মির্জা। অন্যান্য মসজিদের সঙ্গে এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হলো প্রধান প্রার্থনা স্থান। মূল মসজিদটি ভূমি থেকে প্রায় ১৬ ফুট ৬ ইঞ্চি উঁচু। এর কারণ মসজিদের তাহখানাটি ভূগর্ভের পরিবর্তে ভূ-পৃষ্ঠে অবস্থিত। তাহখানার ঘরগুলো বসবাসের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই তাহখানার ছাদই মূল মসজিদের প্রধান প্রাঙ্গণ ও প্রার্থনা স্থান। প্রাঙ্গণটি চারপাশ থেকে উন্মুক্ত থাকায় এখানে বাতাসের প্রবাহ অব্যাহত থাকে।

খান মোহাম্মদ মির্জা মসজিদের মূল প্রার্থনা স্থানের প্রবেশপথ নামাজের জন্য ইমাম ও অন্যান্য মুসল্লিদের ব্যবহৃত মূল অংশটি তিনটি গম্বুজ বিশিষ্ট। ভূমি থেকে ২৫ ধাপ সিঁড়ি অতিক্রম করে তবেই মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রবেশ করা যায়। প্রবেশপথটি মসজিদ প্রাঙ্গণের পূর্ব দিকে অবস্থিত। মসজিদ প্রাঙ্গণের তুলনায় মূল মসজিদের আয়তন বেশ কম। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপে মির্জার তৈরি এই মসজিদকে একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বর্তমানে সরকারি তত্ত্বাবধানে পরিচালিতে হচ্ছে এটি। তবে দায়িত্বরতদের মন্তব্য, মসজিদটির রক্ষণাবেক্ষণে সরকারের আরও সহযোগিতা প্রয়োজন।

আজিমপুর দায়রা শরীফ
১৭৬৬ খ্রিষ্টাব্দে হযরত শাহ সুফী সৈয়দ মুহাম্মদ দায়েম (র.) এই দায়রা শরীফ প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে তার দশম প্রজন্ম এর তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত রয়েছে। সুফি বংশটিকে ‘গদ্দিনাসীন’ নামেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। ১৯৯৮ সাল থেকে দশম গদ্দিনাসীন হিসেবে দায়রা শরীফের সার্বিক তত্ত্বাবধান ও এর বিভিন্ন কার্যাবলী পরিচালনা করে আসছেন হযরত শাহ সুফি সৈয়দ আহমদুল্লাহ জোবায়ের। বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকাসহ বইয়ের মাধ্যমে এই দায়রা শরীফের ইতিহাস, উদ্দেশ্য ও কার্যাবলী সম্পর্কে তরুণ প্রজন্মকে জানানোর চেষ্টা করেছেন তিনি, এখনও করে যাচ্ছেন।

আজিমপুর দায়রা শরীফের ভেতরের মসজিদ বর্তমানে এই বংশের তরুণ প্রজন্মের বেশ কয়েকজন দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর প্রিয় কন্যা হযরত ফাতেমার (রা.) উত্তরসূরি ছিলেন প্রসিদ্ধ ওয়ালিউল্লাহ হযরত শাহ সুফি সৈয়দ বখতিয়ার মহিস্বর (র.)। তার উত্তরসূরি ছিলেন হযরত দায়েম (র.)।

কথিত আছে, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে হযরত মহিস্বরে (র.) নেতৃত্বে ১২ জন মুসলিম দরবেশ বিশালাকার মাছের পিঠে চড়ে দুর্গম সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে সুদূর ইরাকের বাগদাদ শহর থেকে বাংলাদেশে আসেন ও চট্টগ্রামের অন্তর্গত সন্দীপে অবস্থান নেন। পরবর্তী সময়ে অষ্টাদশ শতাব্দীতে হযরত দায়েম (র.), হযরত শাহ সুফি মোনেম পাকবাজের (র.) আদেশ পেয়ে ইসলাম ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে রাতের আঁধারে ভারতের বিহার প্রদেশের মিথুনঘাটে অবস্থিত দরবার শরীফ থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেন। হযরত পাকবাজের (র.) আদেশ অনুযায়ী তিনি তৎকালীন ওই অঞ্চলের ঝোপ-জঙ্গল পরিষ্কার করে আজিমপুরে অবস্থিত দায়রা শরীফটি প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন সময়ে এর স্থাপনায় বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন ও প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্ধনের কাজ সম্পাদিত হয়েছে। বর্তমানে এখানে মসজিদ, মাজার ও গোরস্থান রয়েছে।

আজিমপুর দায়রা শরীফের ভেতরে ওজুখানা ১৩০১ হিজরি সনে (১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে) আলহাজ হযরত মাওলানা শাহ সুফি সৈয়দ খলিলুল্লাহ (র.) এই দায়রা শরীফের দায়িত্ব লাভ করেন। তার সময়কালেই দরবার ভবন ও এর আশেপাশে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য কাজ সম্পাদিত হয়। দায়রা শরীফের তিন তলা বিশিষ্ট প্রধান ফটকটি হিজরি ১৩০৫ সনে (১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে) বাংলার তৎকালীন নবাবের তত্ত্বাবধানে তুর্কি স্থাপত্যশৈলীর ধারায় নির্মাণ করা হয়। হযরত খলিলুল্লাহর (র.) সময়ে বর্তমানে কংক্রিটে তৈরি ওজুখানা ও মসজিদ ভবনের প্রথম পরিবর্ধনের কাজ করা হয়। এই সময়কালেই দায়রা শরীফ ও সংলগ্ন স্থানগুলোকে সরকারিভাবে ওয়াকফ স্টেটের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

(বাঁয়ে) আজিমপুর দায়রা শরীফের মূল প্রবেশপথ, (ডানে) খান মোহাম্মদ মির্জা মসজিদের তাহখানার প্রবেশপথ ১৩২২ হিজরি সনে (১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে) পবিত্র মক্কা শরীফে হজ পালন শেষে দেশে প্রত্যাবর্তনের পরে হযরত খলিলুল্লাহ (র.) মসজিদের মিনার নির্মাণ করেন। একই সময়ে মসজিদের মেঝে মার্বেল পাথর দিয়ে ঢেকে দেন। সেই সঙ্গে মাজার শরীফের গম্বুজগুলোও তখনই নির্মাণ করা হয়।

কয়েকশ’ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী ও ঐতিহ্যের ধারক-বাহক এই দুটি স্থাপনা যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন দুর্যোগ ও যুদ্ধ-বিগ্রহের ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েও আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তবে এসব স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণে সরকারের সহায়তা অত্যাবশ্যক বলে মনে করেন পুরান ঢাকার বাসিন্দারা।

* আগামী কিস্তিতে থাকবে নবাবগঞ্জ রোডের মুখরোচক খাবারের কথা।

ছবি: লেখক

আরও পড়ুন-

পুরান ঢাকার অলিগলিতে: লালবাগ রোডের খানাপিনা
পুরান ঢাকার অলিগলিতে: লালবাগ রোডের চা আর আড্ডা

পুরান ঢাকার অলিগলিতে: নবাবগঞ্জ বাজার রোডে পেটপূজা

 

/জেএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কবিগুরুর  ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী: গঠিত হলো সোসাইটি, দেশজুড়ে বর্ণিল আয়োজন
কবিগুরুর ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী: গঠিত হলো সোসাইটি, দেশজুড়ে বর্ণিল আয়োজন
প্রথম ধাপে ১৩৯ উপজেলায় ভোটগ্রহণ শুরু
প্রথম ধাপে ১৩৯ উপজেলায় ভোটগ্রহণ শুরু
পিএসজিকে হারিয়ে ফাইনালে ডর্টমুন্ড
চ্যাম্পিয়নস লিগপিএসজিকে হারিয়ে ফাইনালে ডর্টমুন্ড
রাজস্থানকে হারিয়ে প্লে অফের আশা বাঁচিয়ে রাখলো দিল্লি
রাজস্থানকে হারিয়ে প্লে অফের আশা বাঁচিয়ে রাখলো দিল্লি
সর্বাধিক পঠিত
ব্যারিস্টার সুমনকে একহাত নিলেন চুন্নু
ব্যারিস্টার সুমনকে একহাত নিলেন চুন্নু
ছুড়ে দেওয়া সব তীর সাদরে গ্রহণ করলাম: ভাবনা
ছুড়ে দেওয়া সব তীর সাদরে গ্রহণ করলাম: ভাবনা
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি, বিএনপির প্রস্তুতি কী?
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি, বিএনপির প্রস্তুতি কী?
শেখ হাসিনাই হচ্ছেন ভারতে নতুন সরকারের প্রথম বিদেশি অতিথি
শেখ হাসিনাই হচ্ছেন ভারতে নতুন সরকারের প্রথম বিদেশি অতিথি
শনিবার স্কুল খোলা রাখার প্রতিবাদে শিক্ষকদের কর্মবিরতি ঘোষণা
শনিবার স্কুল খোলা রাখার প্রতিবাদে শিক্ষকদের কর্মবিরতি ঘোষণা