X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০
কোন জেলার নামকরণ কীভাবে

সুবেদার শায়েস্তা খাঁর বাহিনীর ধর্মগুরুর নামে টাঙ্গাইল

জার্নি রিপোর্ট
২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২২:০০আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২২:৩৪

ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল আয়তনের বাংলাদেশের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি, দৃষ্টিনন্দন জীবনাচার মন কাড়ে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ঐতিহাসিক মসজিদ ও মিনার, নদী, পাহাড়, অরণ্যসহ হাজারও সুন্দরের রেশ ছড়িয়ে আছে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত।

দেশের আট বিভাগে (ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট ও ময়মনসিংহ) ৬৪ জেলা। পণ্য, খাবার, পর্যটন আকর্ষণ কিংবা সাংস্কৃতিক বা লোকজ ঐতিহ্যে বাংলাদেশের জেলাগুলো স্বতন্ত্রমণ্ডিত। প্রতিটি জেলার নামকরণের সঙ্গে রয়েছে ঐতিহ্যপূর্ণ ইতিহাস। প্রতিটি স্থানের নামকরণের ক্ষেত্রে কিছু জনশ্রুতি রয়েছে। এসব ঘটনা ভ্রমণপিপাসু উৎসুক মনকে আকর্ষণ করে। তাই বাংলা ট্রিবিউন জার্নিতে ধারাবাহিকভাবে জানানো হচ্ছে বাংলাদেশের ৬৪ জেলার নামকরণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

২০১ গম্বুজবিশিষ্ট গোপালপুরের মসজিদ (ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স) টাঙ্গাইল জেলা
টাঙ্গাইল একটি ঐতিহ্যবাহী জনপদ। বর্তমান টাঙ্গাইল জেলা অতীতে যমুনা নদীর বুকে নতুন জেগে ওঠা চর এলাকার সমষ্টি। ‘চমচম, টমটম ও শাড়ি, এই তিনে টাঙ্গাইলের বাড়ি’— এই প্রবাদ প্রবচনে জেলার তিনটি লোক-ঐতিহ্যের কথা উঠে এসেছে। টাঙ্গাইলের তৈরি চমচম আর তাঁতের শাড়ি প্রসিদ্ধ। টমটম গাড়ি একসময় ছিল এখানকার উল্লেখযোগ্য যানবাহন। টাঙ্গাইলের লোক-ঐতিহ্যের দুটি প্রধান নিদর্শন হলো মাটির মৃৎপাত্রের ফলক ও নক্শীকাঁথা। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল মহকুমা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ১৯তম জেলা হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে।

টাঙ্গাইলের নামকরণ বিষয়ে রয়েছে বহু জনশ্রুতি। টাঙ্গাইলের ইতিহাস প্রণেতা খন্দকার আব্দুর রহিম সাহেবের মতে, ইংরেজ আমলে এদেশের লোকেরা উঁচু শব্দের পরিবর্তে ‘টান’ শব্দ ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল। এখনও টাঙ্গাইল অঞ্চলে ‘টান’ শব্দের প্রচলন আছে। এর সঙ্গে ‘আইল’ শব্দটি যুক্ত হয়ে হয়েছিল ‘টান আইল’। সেটি রূপান্তরিত হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘টাঙ্গাইল’। জেলার ভূ-প্রকৃতি অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবে এর ভূমি উঁচু ও ঢালু। স্থানীয়ভাবে যার সমার্থক শব্দ হলো টান। তাই ভূমিরূপের কারণেই এই অঞ্চলকে হয়তো ‘টান আইল’ বলা হতো। যা পরিবর্তিত হয়ে রূপ নিয়েছে টাঙ্গাইল। কারও মতে, ব্রিটিশ আমলে ‘টান’ ও ‘ইল’ নামক দুই ইংরেজ সাহেব থানার স্থান নির্বাচনের জন্য সন্তোষ জমিদারিতে এসেছিলেন। তাদের নামানুসারে অঞ্চলটির নাম হয়েছে টাঙ্গাইল।

আরেক জনশ্রুতি অনুযায়ী নীলকর টেংগু সাহেবের গল্পই সবচেয়ে প্রচলিত। ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকে আকুরটাকুর ও শাহবালিয়া মৌজার মধ্যবর্তী এলাকায় টেংগু সাহেবের নীল চাষ ও নীলের কারখানা ছিল। ওই দুটি মৌজার সীমানা বরাবর যাতায়াতের জন্য উঁচু মেঠোপথ বা আইল তৈরি করেছিলেন তিনি। সাধারণ মানুষ এটাকে ‘টেংগু সাহেবের আইল’ হিসেবে উল্লেখ করতো। এজন্য ধারণা করা হয়, টাঙ্গাইল শব্দটি টেংগু সাহেবের আইল নামের অপভ্রংশ। জনশ্রুতিতে আছে, ব্রিটিশ আমলে নীল ব্যবসার চরম উন্নতির সময়ে বর্তমান টাঙ্গাইল শহরে অসংখ্য টাংগা গাড়ির ভিড় লেগে থাকতো। তা থেকেই আঞ্চলিক নাম টাঙ্গাইলের উৎপত্তি।

করটিয়া জমিদার বাড়ি (ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স) টাঙ্গাইল জেলা গেজেটিয়ারে নামকরণ বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে, সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলার সুবেদার নবাব শায়েস্তা খাঁ পর্তুগিজ জলদস্যুদের দমনে দাক্ষিণাত্যের মোগলদের নিয়ে শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠন করেছিলেন। কালক্রমে তা ভেঙে দেওয়া হলে তাদের অনেকেই দক্ষিণ ভারতের মালাবার উপকূলে ফিরে না গিয়ে লৌহজং নদীর চর এলাকায় বসতি স্থাপন করে। এসব নতুন গড়ে ওঠা বসতিগুলোকে মোগলরা অভিহিত করেছিল দিহ টাঙ্গাল (দিহ শব্দের অর্থ হলো মহল্লা), যা কালক্রমে টাঙ্গাইল হয়েছে।

বাংলাদেশ আদম শুমারি রিপোর্ট সূত্রে জানা যায়, দাক্ষিণাত্যে মালাবার সমুদ্র উপকূল এলাকায় ‘মোপলা’ নামে এক জাতি বাস করতো। তারা আরব বণিকদের বংশধর ও এই অঞ্চলের মেয়েদের সঙ্গে বিয়ের বন্ধনে জড়াতো। মোপলাদের ধর্মগুরুকে ‘তাংগাইল’ বলা হতো। এই অনুযায়ী পরবর্তী সময়ে বর্তমান ‘টাঙ্গাইল’ নামকরণ হয়েছে। তরুণ গবেষক, ইতিহাসবিদ, অনুবাদক খুররম হোসাইন তার ‘টাঙ্গাইলের স্থান নাম: ইতিহাস ও কিংবদন্তি’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, টাঙ্গাইলে এই সম্প্রদায় এখনও টিকে আছে। তারা নিজেদের পরিচয় দেয় মাহিফরাস। মৎস্য ব্যবসা তাদের প্রধান জীবিকা। টাঙ্গাইল অঞ্চলের লোকজন মোপলাদের নিকারি বলে জানে। তাদের সর্দারকে যে স্থানে জায়গা দেওয়া হয়েছিল সেটিই ক্রমে ‘টাঙ্গাইল’ নামে পরিচিত হতে থাকে।

পূর্বে টাঙ্গাইল অপেক্ষাকৃত নিচু অঞ্চল ছিল। এখানকার মানুষ বসবাসের জন্য মাটির ওপর বাঁশ পুঁতে টং ঘর নির্মাণ করতো। টং ফার্সি শব্দ, এর অর্থ উঁচু। অতীতে স্থানীয় অনার্য বাসিন্দারা বাসস্থানকে ‘ইল’ বলতো। তাই কারও মতে, টংইল (উঁচু বাসস্থান) থেকে টাঙ্গাইল নামের উৎপত্তি। কারও মতে, ব্রিটিশ শাসনামলে মোগল প্রশাসন কেন্দ্র আটিয়াকে আশ্রয় করে এই অঞ্চল জমজমাট হয়ে ওঠে। সেই সময়ে ঘোড়ার গাড়ি ছিল যাতায়াতের একমাত্র বাহন, যাকে স্থানীয়রা বলতো ‘টাঙ্গা’। বর্তমান শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই অঞ্চলের স্থলপথে সর্বত্র টাঙ্গা গাড়ির চলাচল ছিল। আর বর্তমান টাঙ্গাইলের বিভিন্ন স্থানের নামে ‘আইল’ শব্দের আধিক্য আছে। যেমন— বাসাইল, ঘাটাইল, ডুবাইল, নিকরাইল, রামাইল ইত্যাদি। আইল শব্দটি কৃষিজমির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর অর্থ জমির সীমানা সংলগ্ন অংশ। টাঙ্গাওয়ালাদের বাসস্থানের সীমানার ক্ষেত্রে ‘টাঙ্গা+আইল’ যোগ করে হয়েছে ‘টাঙ্গাইল’। 

আরেকটি সূত্রমতে, হযরত শাহ জামাল (রা.) জাহাজে চড়ে এদেশে আগমন করার সময় মাদ্রাজ থেকে একদল জেলে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। তাদের দলপতির নাম ‘টাংগা’। জেলেরা লৌহজং নদীর পূর্ব তীরে বসবাস শুরু করে। তাদের দলপতির নামানুসারে স্থানের নাম হয় ‘টাঙ্গাইল’। অন্য মতবাদে জানা যায়, ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে সরকারের আদেশ অনুযায়ী পারদীঘুলিয়া মৌজার অন্তর্গত আতিয়া নামক গ্রামে টান-আইল থানার সদর স্থাপন করা হয়। গত শতাব্দীর মধ্যবর্তীকালীন টান-আইল মৌজা টাঙ্গাইল নামে রূপান্তরিত হয়। 

মহেড়া জমিদার বাড়ি (ছবি: সোহেলী তাহমিনা) টাঙ্গাইলের জনপদে রাজা-জমিদারদের বাড়িরও ঐতিহ্য আছে। তারা মনের মাধুরী দিয়ে তার বাসস্থান নির্মাণ করেছেন। শুধু তাই নয়, বাঙালিদের শিক্ষাদানে টাঙ্গাইলের জমিদারদের অবদান অপরিসীম। কালিয়া, মহানন্দপুর, কীর্ত্তনখোলা, প্রতিমা বংশী, দাড়িয়াপুর, শহর গোপিনাথপুর, রতনগঞ্জ, বেহুলা-লক্ষ্ণীন্দর, গড় গোবিন্দপুর প্রভৃতি স্থানগুলো ঐতিহ্যের শিরোনাম।
এই জেলার দর্শনীয় স্থানগুলো হলো মহেড়া জমিদার বাড়ি, আতিয়া মসজিদ, উপেন্দ্র সরোবর, পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি, এলেঙ্গা রিসোর্ট, ধলাপাড়া চৌধুরী বাড়ি, নাগরপুর চৌধুরী বাড়ি (জমিদার বাড়ি), কৃত্রিম চিড়িয়াখানা, শহীদ সালাহউদ্দিন সেনানিবাস, মোকনা জমিদার বাড়ি, ধনবাড়ি নবাব প্যালেস, ধনবাড়ি মসজিদ, টাঙ্গাইল ডিসি লেক, পাকুল্লা মসজিদ, পাকুল্লা জমিদার বাড়ি, দেলদুয়ার জমিদার বাড়ি, করটিয়া জমিদার বাড়ি, হেমনগর জমিদার বাড়ি, ২০১ গম্বুজ মসজিদ।
সূত্র: বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন

/জেএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়