ইউরোপে ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রায় মধ্যভাগ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়টা ছিল গোথিক শিল্পের। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য নটরডেম ক্যাথেড্রালকে ভাবা হয় ফরাসি গোথিক স্থাপত্যের প্রাচুর্য। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রতীকগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। গির্জাটির প্রধান যাজক প্যাট্রিক শোভেত জানিয়েছেন, প্রতি বছর ১ কোটি ২০ লাখ পর্যটক ও তীর্থযাত্রী এই গির্জা দেখতে আসেন। শত শত বছরের বৈচিত্রম্যয় হস্তনির্মিত বস্তু, চিত্রকর্ম ও যীশুখ্রিষ্টের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষিত আছে সেখানে। সোমবার (১৫ এপ্রিল) অগ্নিকাণ্ডের কারণে নটরডেম ক্যাথেড্রাল এখন দুনিয়াজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে। এই নয়নাভিরাম স্থাপত্যে আগুন দেখে মনমরা ভ্রমণপিপাসুরা। মধ্যযুগীয় গির্জাটি কেন অনন্য চলুন জানা যাক।
* নটরডেম ক্যাথেড্রালের বয়স ৮৫০ বছরেরও বেশি। গির্জার ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১৩ সালে এই মাইলফলক উদযাপন করেছে এটি।
* গির্জাটি তৈরি করতে লেগেছে ১৮২ বছর! দ্বাদশ শতকে নটরডেম ক্যাথেড্রালের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। পুরো কাজ সম্পন্ন হয়েছে ত্রয়োদশ শতকে। ভ্রমণ বিষয়ক মার্কিন গাইডবুক ফোডোর’স ট্রাভেলে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
* ভ্রমণ বিষয়ক অস্ট্রেলীয় গাইড বুক লোনলি প্লানেট জানিয়েছে, নটরডেম ক্যাথেড্রালে একসঙ্গে ছয় হাজারেরও বেশি ধর্মানুরাগী সমবেত হতে পারেন।
* নটরডেম ক্যাথেড্রালেই ইংল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ হেনরির মাথায় ওঠে ফ্রান্সের রাজার মুকুট। পোপ পাইয়াস সপ্তমের হাত ধরে ফ্রান্সের রাজা হিসেবে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের অভিষেক হয়েছিল এই গির্জায়। এসব তথ্য লোনলি প্লানেটের।
* এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা গ্রন্থে জানানো হয়েছে, ঊনিশ শতকে সংস্কারের সময় গির্জার উপরিভাগে যুক্ত করা হয় পিরামিড গঠন। ১৮৩১ সালে প্রকাশিত ভিক্টর হুগোর ‘দ্য হাঞ্চব্যাক অব নটর-ডেম’ উপন্যাসের সাফল্যের সুবাদে সংস্কারের উদ্যোগ আংশিকভাবে লাভবান হয়।
* মূল তিনটি দরজায় নানান নকশা করা সুবিশাল কাচের জানালা (রোজ উইন্ডোজ) ও অন্যান্য অসাধারণ স্থাপত্যের জন্য গির্জাটি সুপরিচিত।
* ফরাসি বিপ্লব চলাকালে নটরডেম ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ফোডোর’স ট্রাভেলের তথ্যানুযায়ী, ঊনিশ শতকে ফরাসি স্থপতি ইউজিন ভিওলেত-লে-দ্যুক এটি পুরনো অবস্থায় ফিরিয়ে নেন।
* বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে অন্যতম মধ্যযুগীয় গ্রেট অরগ্যান। বছরের পর বছর এর প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এটি সংস্কার করেছে। মূল অর্গানিস্ট তথা হেড অর্গানিস্ট ফ্রান্সসহ সারাবিশ্বে বিশাল মর্যাদা নিয়ে চলাফেরা করেন। অগ্নিকাণ্ডের আগ পর্যন্ত যন্ত্রটি অক্ষতই ছিল।
* ঊনিশ শতকের শেষ প্রান্তে আইফেল টাওয়ারের নির্মাণ কাজ শেষের আগে নটরডেম ক্যাথেড্রালের টুইন বেল টাওয়ার ছিল প্যারিসের সবচেয়ে উঁচু ভবন। এর উত্তর টাওয়ার ১২৪০ খ্রিষ্টাব্দে ও দক্ষিণ টাওয়ারের কাজ শেষ হয় ১২৫০ খ্রিষ্টাব্দে।
* গির্জার মূল ঘণ্টা ইমানুয়েল রয়েছে দক্ষিণ টাওয়ারে। ফরাসি ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য মুহূর্তগুলোর সাক্ষী এটি। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি, ছুটির দিন ও রাষ্ট্রীয় বিশেষ অনুষ্ঠান।
* ক্যাথিড্রালের অভ্যন্তরে অসংখ্য ভাস্কর্য, মূর্তি ও চিত্রকর্মে রয়েছে বাইবেলের দৃশ্য আর ঋষিরা। এর মধ্যে ৭৬টি চিত্রকর্মের একটি সিরিজ প্রায় চার মিটার লম্বা। রয়েল একাডেমি অব পেইন্টিং অ্যান্ড স্কাল্পচারের সহযোগিতায় এগুলোর কাজ সম্পন্ন হয়েছে ১৬৩০ থেকে ১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। ফরাসি চিত্রশিল্পী জ্যঁ জ্যুভেনেতের একটি সিরিজ চিত্রকর্মে রয়েছে যীশুখ্রিস্টের মা ভার্জিন ম্যারির জীবন। ১৮৬০ সালে এটি গির্জা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় লুভর জাদুঘরে। কেবল দ্য ভিজিটেশন চিত্রকর্মটি নটর ডেমে ফের আনা হয়। ১৬৪৮ সালে আঁকা ইতালিয়ান পুরোহিত সেন্ট থমাস অ্যাকুইনাসের একটি প্রতিকৃতি আছে ক্যাথেড্রালে।
* নটরডেম ক্যাথেড্রালের ভাণ্ডারে হস্তনির্মিত খ্রিষ্টানদের পবিত্র কিছু নিদর্শন আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক্রুশবিদ্ধকরণের সময় যীশুর মাথায় থাকা ‘ক্রাউন অব থর্নস’। তাকে যেখানে বেঁধে ক্রুশবিদ্ধ করা হয় সেই ট্রু ক্রসের খণ্ড আর পেরেকও আছে। প্যারিসের মেয়র অ্যান হিদালগো নিশ্চিত করেছেন, আগুন ধরার পর ক্রাউন অব থর্নস ও সেন্ট লুইয়ের পোশাকসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জিনিস উদ্ধার করা হয়েছে।
* গির্জার বহির্ভাগের দেয়াল শক্ত রাখতে আছে প্রাণীর ভাস্কর্য। প্রত্নতাত্ত্বিক সমাধিকক্ষ রয়েছে গির্জার আঙিনার নিচে। ঊনিশ শতকের ধ্বংসাবশেষ রক্ষার জন্য এটি তৈরি হয়েছিল। ১৯৬৫ সালে খননকালে আবিষ্কৃত এটি আবিষ্কৃত হয়। ১৯৮০ সালে জনসাধারণের জন্য তা উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
* নটরডেম গির্জার সামনে দিনের বেশিরভাগ সময় পর্যটকদের দেখা যায়। নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক ট্রাভেল এজেন্ট ও প্যারিস বিশেষজ্ঞ ইয়ারন ইয়ারিমি ইমেইলে সিএনএনকে বলেন, ‘বিশ্বের সবচেয়ে অবিশ্বাস্য সুন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ মধ্যযুগীয় গির্জাগুলোর মধ্যে নিঃসন্দেহে এটি অন্যতম। আমরা প্যারিসে ভ্রমণ আয়োজন করলে সবচেয়ে অনুরোধ আসা পাঁচটি স্থানের মধ্যে থাকে এটি।’