দিনাজপুরের নবাবগঞ্জে ঐতিহাসিক আশুরার বিলের ওপর তৈরি হয়েছে উত্তরবঙ্গের দীর্ঘতম আঁকাবাঁকা আকৃতির শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কাঠের সেতু। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৯০০ মিটার। এটি দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন দেশের বিভিন্ন স্থানের ভ্রমণপিপাসুরা। ঈদ আনন্দে পরিবার নিয়ে আসা দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে এই স্থাপনা।
কাঠের সেতুটি যেন বন ও বিলকে এক সুতোয় গেঁথেছে। তাই এই জায়গার প্রতি ভ্রমণপ্রেমীদের আগ্রহ বেড়েছে। ঈদের দিন থেকেই শেখ রাসেল জাতীয় উদ্যান ও আশুরার বিলের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে নেমেছে হাজারও মানুষের ঢল। বনে ছায়াঘেরা সবুজ মনোরম পরিবেশে ও বিলের পানিতে নৌকায় চড়ে বেড়িয়েছেন অনেকে। আরও কয়েকদিন দর্শনার্থীদের ভিড় থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসে ইব্রাহিম হোসেন জানতে পারেন, নবাবগঞ্জে বনের ভেতরে বিশাল একটি কাঠের সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। খবর পেয়ে যেতে দেরি করেননি। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সেতুটি দেখে খুব ভালো লাগলো। আমার কাছে মনে হয়, এটি উত্তরবঙ্গের মধ্যে দীর্ঘতম কাঠের সেতু। একইসঙ্গে বিল ও বনের অপরূপ সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ করেছে।’
বন ও বিলের মাঝে কাঠের সেতু স্থাপনের খবর পেয়ে আরও অনেকে এসেছেন। তাদেরই একজন গাইবান্ধার নজরুল ইসলাম। তার কথায়, ‘ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে আমরা বন্ধুরা মিলে বেড়াতে এসেছি। এখানে আসতে পেরে খুব ভালো লাগছে। একে তো বন ও বিলের অপরূপ সৌন্দর্য, এসবের সঙ্গে যোগ হলো দীর্ঘতম কাঠের সেতু। সাধারণত কাঠের সেতু পার্বত্য চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি বা রাঙামাটি বা পাহাড়ি এলাকায় দেখা যায়। নবাবগঞ্জে এ ধরনের স্থাপনা বেশ আকর্ষণীয়।’
রংপুরের শিউলি আকতার আগে থেকেই নবাবগঞ্জের জাতীয় উদ্যান ও আশুরার বিলের কথা জানতেন। তার মন্তব্য, ‘বেড়ানোর জন্য এই বন ও বিল জুতসই। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কাঠের সেতু উদ্বোধনের খবর পেয়ে ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে পরিবার নিয়ে এখানে বেড়াতে এসেছি। দুটি বনের মাঝখানে বিশাল আকৃতির বিল আর এর ওপর কাঠের সেতু এককথায় মুগ্ধকর। সামনে থেকে না দেখলে এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমরা পরিবারের সবাই সেতুর ওপর দিয়ে হেঁটে বনের এ-পাশ থেকে ও-পাশে ঘুরেছি, নৌকায় চড়েছি। সব মিলিয়ে দারুণ সময় কেটেছে। বিলে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির ওড়াওড়ি এখানকার সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।’
বন ও বিলের পাশে বসেছে আইসক্রিম, ফুচকা, চটপটি, আচার, ঝালমুড়িসহ দু’শতাধিক বিভিন্ন ধরনের খাবার ও খেলনা সামগ্রীর দোকান। এছাড়া আছে চরকি ও নাগরদোলাসহ শিশুদেও জন্য নানান আয়োজন। সন্তান নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর ফাঁকে কেউ রঙিন বেলুন ও হরেক রকমের খেলনা কিনে দিচ্ছেন অভিভাবকরা।
চটপটি ও ফুচকা বিক্রেতা সিরাজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বললেন, ‘নবাবগঞ্জের জাতীয় উদ্যান ও আশুরার বিলে আগে তেমন একটা মানুষ দেখা যেতো না। কাঠের সেতুর সুবাদে এখানে ভ্রমণপিপাসুদের সমাগম বেড়েছে। ঈদ উপলক্ষে এখানে চটপটি ও ফুচকার দোকান দিয়েছি। বেচাকেনাও বেশ ভালো হচ্ছে। আমার মতো আরও অনেকে এখানে বিভিন্ন ধরনের দোকান দিয়েছে।’
দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার শেখ রাসেল জাতীয় উদ্যান প্রায় দেড় হাজার একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। বনের মাঝখানে রয়েছে প্রায় ৬০০ একরের মতো আশুরার বিল, যা দেশীয় মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে পরিচিত। এর পাশেই ঐতিহাসিক সীতার কোট বৌদ্ধবিহার।
পর্যটনের সম্ভাবনা থেকে ২০১০ সালে সরকার এই বন ও বিলকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করে। কিন্তু দীর্ঘদিন অবহেলায় পড়ে থাকে এটি। সম্প্রতি উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানান উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে পাখিদের অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তুলতে বিভিন্ন গাছে মাটির পাতিল লাগানো, বনের পাশ দিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির সৌন্দর্যবর্ধনকারী ফুলের গাছ রোপণ ও বিলের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে জলাশয় থেকে কচুরিপানা পরিষ্কার করা।
নবাবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মশিউর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উদ্যান ও বিলের সঙ্গে কাঠের সেতু পর্যটনের জন্য বেশ সম্ভাবনাময়। বিলের জলে ফুটে থাকা শাপলা ও পদ্ম ফুল দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। আর সেতুটি নির্মাণের পর এখানে মানুষের ঢল নেমেছে। প্রতিদিন হাজারও পর্যটক দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে আসছেন।’
পর্যটকদের সুবিধার্থে শৌচাগার নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে বলে জানান ইউএনও। এছাড়া রোদ-বৃষ্টিতে বসার জন্য গোলঘর বানানোর আশ্বাস দেন তিনি। তার দাবি, এখন ভ্রমণপ্রেমীদের নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
দিনাজপুর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কাঠের সেতুটি ইতোমধ্যে ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার পেয়েছে। তাই অল্প সময়ে এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বন, বিল ও সেতুকে ঘিরে উত্তরবঙ্গের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে এই অঞ্চল।’