স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ পারমাণবিক বিস্ফোরণের পর ইউক্রেনের পরিত্যক্ত শহর চেরনোবিলে পর্যটকরা ঘুণাক্ষরেও যাওয়ার কথা ভাবতো না বলা চলে। কারণ সেখানে প্রায় ৫০ মাইল এলাকা জুড়ে বসবাস নিষিদ্ধ। তবে দুর্ঘটনার তিন দশক পর যুক্তরাষ্ট্রের এইচবিও চ্যানেলের নতুন একটি টিভি সিরিজের সুবাদে পৃথিবী গ্রহের আকর্ষণীয় পর্যটন গন্তব্য হয়ে উঠেছে এটি।
চেরনোবিলের ভূতুড়ে শহরে গত কয়েক বছর ধরে সাহসী ভ্রমণপ্রেমীরা ঘুরেছেন। তবে তা ছিল হাতেগোনা। এইচবিওর ‘চেরনোবিল’ সিরিজ প্রচারের পর জায়গাটির প্রতি হঠাৎ ভ্রমণপিপাসুদের আগ্রহ বেড়ে গেছে। স্থানীয় ট্যুর অপারেটরগুলোর দাবি, গত মাস থেকে সেখানে পর্যটকদের ঢল নেমেছে!
ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে ১১০ কিলোমিটার উত্তরে পৃপিয়াত শহরের কাছে অবস্থিত চেরনোবিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত জায়গাগুলোর অন্যতম। কেবল লাইসেন্সধারী গাইড সঙ্গে থাকলে সেখানে বেড়ানো যায়। মানুষের বসতি নিষিদ্ধ থাকায় এখন ওই জায়গা পরিণত হয়েছে জঙ্গলে। সবখানে ধ্বংসস্তূপ।
‘চেরনোবিল’ মিনি সিরিজে তুলে ধরা হয়েছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিস্ফোরণের পরবর্তী সময়ে মানুষকে সরিয়ে নেওয়া, পরিষ্কার অভিযান ও তদন্তের চিত্র। ৩৩ বছর পরেও চেরনোবিল পরিচ্ছন্নতা অভিযান শেষ করা যায়নি। এ ঘটনাকে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ও বিপর্যয় হিসেবে ধরা হয়। এতে অভিনয় করেছেন জারেড হ্যারিস, স্টেলান স্কারসগার্ড ও এমিলি ওয়াটসন। চলচ্চিত্র ও টিভি ডাটাবেজ আইএমডিবির তথ্যানুযায়ী, সবচেয়ে বেশি টিআরপি পাওয়া সিরিজ এটি। এ মাসের শুরুতে এর পঞ্চম ও শেষ পর্ব প্রচারিত হয়।
যদিও মিনি সিরিজটির শুটিং হয়েছে লিথুয়ানিয়ায়। এটি লেখার আগে চেরনোবিল ঘুরে দেখেছেন ক্রেগ ম্যাজিন। এর জনপ্রিয়তার সুবাদে ইউক্রেন ও বেলারুশ সীমান্তে অবস্থিত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বিস্ফোরণের স্থানে ভ্রমণপিপাসুর সংখ্যা গত বছরের চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ বেড়েছে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চারপাশে চার হাজার বর্গকিলোমিটারেরও বেশি জায়গায় গাইডসহ ঘুরে দেখায় বিভিন্ন ট্যুর অপারেটর। সলোইস্ট নামের এমন একটি প্রতিষ্ঠান দুই দশক ধরে চেরনোবিলে ভ্রমণ প্যাকেজ দিচ্ছে। এর পরিচালক ভিক্টর করোল বলেন, “আমাদের বুকিং ৩৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। বেশিরভাগ পর্যটকই জানিয়েছেন, এইচবিওর মিনি সিরিজ দেখে এখানে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম— তারা টিভিতে দেখলেন আর বিমানে উড়ে চলে এলেন! ‘চেরনোবিল’ প্রচার শুরুর পর থেকে সপ্তাহে ১০০ থেকে ২০০ পর্যটক আমাদের প্যাকেজ নিয়েছেন।”
সলোইস্টের আরেক পরিচালক সের্গেই ইভানচুক জানিয়েছেন— জুন, জুলাই ও আগস্টের বুকিং অন্যান্য বছরের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেড়েছে। সব মিলিয়ে চেরনোবিল অনুপযোগী এক আকর্ষণ হয়ে উঠেছে বলা চলে।
ভিক্টর করোল জানালেন, বেশিরভাগ ভ্রমণপ্রেমী দলবেঁধে একদিনের জন্য বিস্ফোরণ স্থানের আশেপাশে বেড়াতে আসছেন। এক্ষেত্রে জনপ্রতি খরচ হচ্ছে ৯৯ মার্কিন ডলার (সাড়ে ৮ হাজার টাকা)। চার নম্বর পারমাণবিক চুল্লি ও পৃপিয়াতের মরুভূমিতে চিত্তবিনোদনের পার্ক ফেরিস হুইলের প্রতি পর্যটকদের আগ্রহ বেশি।
চেরনোবিলের বেশিরভাগ এলাকা ২০১১ সালে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। তবে রোসোখা গ্রামের মেশিন সিমেট্রির মতো কিছু জায়গায় প্রবেশাধিকার সীমিত। এর মধ্যেও ভ্রমণকারীরা পৃপিয়াতের পরিত্যক্ত শহর ঘুরে দেখতে পারেন। পাশাপাশি বিস্ফোরণের পর চার নম্বর চুল্লির অবশিষ্ট অংশ ঢেকে রাখতে স্থাপিত নিউ সেফ কনফাইনমেন্ট থেকে ৩০০ মিটার দূরে একটি পর্যবেক্ষণ পয়েন্টে যাওয়া যায়। ২০১৭ সালে ৩৪৪ ফুট (১০৫ মিটার) ইস্পাতের গম্বুজ দিয়ে ঢেকে দেওয়া চার নম্বর চুল্লিটি।
বেড়ানোর জন্য চেরনোবিল নিরাপদ ঘোষণা করা হলেও প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। ভিক্টর করোল স্বীকার করেছেন, অনেকে ঘোরাঘুরির সময় তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ মাত্রার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘এটাই এখানে বেড়াতে আসা ভ্রমণপিপাসুদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রশ্ন! তবে এখন চেরনোবিল পুরোপুরি নিরাপদ। তা না হলে সরকার কখনও পর্যটকদের বেড়ানোর অনুমতি দিতো না। এখানে ভ্রমণের সময় তারা যত বিকিরণের মুখোমুখি হন তা একটি ইন্টারকন্টিনেন্টাল ফ্লাইটের চেয়ে কম। আরেকটু খুলে বললে বুকে এক্স-রে করানোর চেয়ে এই মাত্রা কম।’
একইভাবে নারী ট্যুর গাইড ভিক্টোরিয়া ব্রজকো চেরনোবিলকে নিরাপদ মনে করেন। তার কথায়, ‘ঘরে ২৪ ঘণ্টা থাকলে যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মুখে পড়ি আমরা, এই শহরে এখন একই ব্যাপার। তাই অসংখ্য মানুষ এখানে বেড়ানোর সময় টিভি সিরিজ ও দুর্ঘটনা সম্পর্কে জানতে চায়। তাদের কৌতূহল বেড়েছে।’
চেরনোবিল ট্যুরের পরিচালক ইয়ারোস্লাভ ইমেলিয়ানেঙ্কো মনে করেন, মিনি সিরিজটির সুবাদে ৩০-৪০ শতাংশ পর্যটক সমাগম বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে যেসব স্থান দেখানো হয়েছে সেগুলোতে ঘুরে দেখানোর প্যাকেজ দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। কিয়েভ থেকে বাসে চড়ে ১২০ কিলোমিটার জায়গায় ভ্রমণপ্রেমীরা ক্ষতিগ্রস্তদের নিদর্শন ও পরিত্যক্ত গ্রাম দেখতে পারেন। চেরনোবিলের একমাত্র রেস্তোরাঁয় দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চতুর্থ চুল্লিতে নিয়মিত একটি পরীক্ষা চালানোর সময় দুর্ঘটনার সূত্রপাত হয়। চুল্লিটির ওপরের প্রায় এক হাজার টন ওজনের কংক্রিটের ঢাকনা সরে যায়। তখন ছাদ ভেঙে যাওয়ায় বিশাল গহ্বরের সৃষ্টি হয়। দুর্ঘটনার ২০ ঘণ্টা পর বাইরের বাতাস ঢুকে পড়লে পারমাণবিক চুল্লির দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে সেখানে বিরাট অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। এ আগুন ১০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এতে করে পারমাণবিক বিক্রিয়ায় তৈরি পদার্থ প্রায় ১ কিলোমিটার উঁচু অবধি ছড়িয়ে পড়েছিল। এ কারণে প্রচুর পারমাণবিক ধুলো পরিবেশের ব্যাপক দূষণ ঘটায়। তখন পরিবেশে যত পারমাণবিক পদার্থ নিক্ষিপ্ত হয়েছিল তা ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমায় আমেরিকার নিক্ষেপ করা পারমাণবিক বোমার প্রায় ৫০০ গুণ বেশি!
দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই চার কর্মীর মৃত্যু হয়। তৎকালীন সোভিয়েত সরকার ঘটনা ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল। এ কারণে ৩৬ ঘণ্টা পর ১০ হাজার মানুষকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে ২৩৭ জন পারমাণবিক বিকিরণে অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রথম তিন মাসে ৩১ জন মৃত্যুবরণ করে, যাদের অধিকাংশই উদ্ধারকর্মী। দুর্ঘটনার কারণে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের মধ্যে ছিল ছয় লাখ শিশু। জাতিসংঘ মনে করে, ২০০৫ সাল পর্যন্ত ৯ হাজার মানুষের থাইরয়েড ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া চেরনোবিল বিপর্যয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। অনেকের মধ্যে তেজস্ক্রিয়তাজনিত অস্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক সমস্যা ধরা পড়ে৷
সূত্র: রয়টার্স, সিএনএন