X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

অবিন্তা কবিরকে যেমন দেখেছি

জীনাত ইকরামুল্লাহ
২৩ জুলাই ২০১৬, ২৩:৪৪আপডেট : ২৪ জুলাই ২০১৬, ১৫:০৯

অবিন্তা কবিরের পারিবারিক ছবি ‘মা ছিলেন আমার জীবনের আদর্শ। তিনি আমাকে শিখিয়েছেন ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং পরিবার ও বন্ধুদের সম্মান করতে। তিনি শিখিয়েছেন আল্লাহর আশীর্বাদের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে এবং অনুমতি ছাড়া কোনও কিছু না নিতে। কঠোর পরিশ্রম ও নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে। একজন সফল নারী হতে গেলে যা যা অর্জন করতে হয়। উদারতা একটি মহৎ গুণ; দুর্বলতা নয়। জন্মসূত্রে বাঙালি হওয়াটা আমার জন্য গর্বের।’

আমাদের মধ্যে যাদের সৌভাগ্য হয়েছিল অবিন্তার কাছাকাছি থাকার, তাদের সবাই ওপরের কথাগুলো কোনও না কোনওভাবে শুনেছি তার কাছ থেকে। মনে হতে পারে এটা একজন একজন বয়স্ক মানুষের অনুভূতির প্রকাশ। কিংবা এটাও হতে পারে, অবিন্তা ছিল তার বয়সের তুলনায় প্রাজ্ঞ। কিন্তু আমাদের কাছে শিশুকাল থেকেই সে এমনই ছিল।

অবিন্তা ছিল খুব অনুভূতি প্রবণ মেয়ে। সে বুঝতে পারত কখন তার মায়ের মন খারাপ। ঢাকায় ফেরার পর সে সব সময় টুটু (নানু) ও নানার অভাববোধ করত।

কে জানে মা ও বাবার তার প্রতি ভালোবাসা আকাশের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। স্বর্গের তারাদের কাছে পৌঁছে গেছে এবং পৃথিবীতে ফিরে আসছে তাদের বাহুতে।

আমাদের ঘৃণা করতে বা অপরিচিতদের আলিঙ্গন করতে শেখানো হয়নি। অবিন্তাকে তার মা শিখিয়েছিলেন ভালোবাসতে। সমাজে যারা পিছিয়ে পড়েছে তাদের সহযোগিতা করতে। মা তাকে উদার হতে বলতেন, খাবার অপচয় না করতে বলতেন, কারণ অনেকেই আছে যাদের না খেয়ে থাকতে হয়।

স্নেহ ও যত্নশীলতা ছিল অবিন্তার বড় গুণ। কারণ মা তাকে এটা শিখিয়েছেন। কানের কাছে নিঃশ্বাস নিয়ে ও যখন মায়ের ভালোবাসার আলিঙ্গনে ঘুমানোর সময় এসব শেখান মা। এই দুই মহৎ চেতনার মানুষের মধ্যে কোনও গোপনীয়তা ছিল না।

অবিন্তা বলত, ‘মাকে আঘাত করার কোনও সুযোগ নেই। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি বুঝতে পারেন। ভালো ও খারাপ, যন্ত্রণা ও ভালোবাসা; যাই আসুক আমার জীবনে তিনি পাশে থাকতেন। মা মন থেকে জানতেন যে অবিন্তা তার মায়ের কাছে ফিরে আসবে।

অবিন্তার কাছে পরিবারই ছিল তার সবকিছু। নানা আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। তুতু সবচেয়ে ভালো রাঁধুনি। পুমপুম সবচেয়ে সুন্দর। বিলুর রয়েছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় চোখ ও মহৎ হৃদয়।

অবিন্তা ছিলেন স্নেহময়ী ও যত্নশীল

পরিবারের সবার সঙ্গে একসঙ্গে খাওয়া ছিল ছোটবেলা থেকেই অবিন্তার প্রিয়। যখন চেয়ারে বসলে তার পা মেঝে পর্যন্ত পৌঁছাতো না সেই বয়সেও খাবারের টেবিলে বসতে চাইত। আকর্ষণীয় চোখ ও কোকড়া চুল নিয়ে অধীর অপেক্ষায় বসে থাকত টুটু কী রান্না করেছেন। তার প্রিয় টুটু নিয়ে আসবেন অসাধারণ খাবার। যারাই অবিন্তার সংস্পর্শে এসেছে তাদের জীবনে আনন্দ নিয়ে এসেছে সে। তার সরলতা ও ছোট ছোট বিষয়ে তার উপলব্ধির চমৎকারিত্ব ও গভীরতার কারণে সবাই বুঝতে পারত, অবিন্তা বিশেষ কিছু।

অবিন্তাকে নিয়ে মজা করতে আমরা তাকে ‘আমেরিকানো’ বলতাম। ব্যাপক প্রতিবাদে আমেরিকান উচ্চারণ ভঙ্গিতে সে বলত, ‘না, আমি বাঙালি।’

যখন আমরা জিজ্ঞেস করতাম কেন তাকে আমরা একজন বাংলাদেশি হিসেবে মনে করব? জবাবে সে বলত, ‘কারণ মা-বাবা এবং আমি যাদের ভালোবাসি তারা সবাই এখানে বাস করে। এবং আমিও একজন বাংলাদেশি। ’

খুব সাধারণ শব্দ কিন্তু অনুভূতি গভীর।

কোন বিষয়টি অবিন্তাকে বাঙালি করেছে? এটা কি এ কারণে যে, সে গুরুর মাংস, ঢাল ও ভাত পছন্দ করত? সে শাড়ি পরতে পছন্দ করত বলে? এসিড দগ্ধদের সহযোগিতা করতে গিয়ে কাঁদত বলে? এটা কি এ কারণে যে, সে শপথ নিয়েছিলে যখন সে বড় হবে দেশে ফিরে পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য কাজ করবে বলে? এটা কি এ কারণে যে, সে মনে করত সব শিশুরই শিক্ষা, খাবার, আশ্রয় ও ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার আছে, যা তার মা তাকে দিয়েছেন? এটা কি এ কারণে সে রাস্তায় আটকে পড়া একটি কুকুরকেও ফেলে রেখে যেতে পারত না?

নাকি এই সব কিছু এবং একজন ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টার কারণে? সে বাংলাদেশকে একটি প্রগতিশীল জাতি মনে করত এবং পরিবর্তন মেনে নিতে রাজি ছিল। ছিল বিশ্বায়নে অংশ নেওয়ার আগ্রহ, বিশ্বের যত ভালো গুণ আছে গ্রহণ এবং আমাদের নাগরিক জীবনে তা চালু করার মনোভাব।

সমাজের পিছিয়ে পড়া শিশুদের নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখতেন অবিন্তা শিক্ষা, আত্মোৎসর্গ, কঠোর পরিশ্রম, নিয়মানুবর্তিতা, ধৈর্য এবং গ্রহণযোগ্যতা অবিন্তাকে অনন্য করে তুলেছে। স্কুল ও ইমোরি কলেজে অবিন্তার রিপোর্ট কার্ড তার অধ্যবসায়ের প্রমাণ দেয়। পেছনে ছায়ার মতো ছিলেন তার মহা গর্বের মা।

আধ্যাত্মিক বৃদ্ধি, আল্লাহর প্রতি আস্থা ও কল্যাণের শক্তি ছিল অবিন্তার ব্যক্তিগত বিষয় যা সে শুধু তার মা ও পরিবারের ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে আলোচনা করত।

ভয়াবহ কার দুর্ঘটনায় পড়েও বেঁচে যাওয়া, খেলতে গিয়ে একাধিক ইনজুরিতে পড়ে অবিন্তা আল্লাহর প্রতি তার বিশ্বাসের পরীক্ষা দিয়েছে। যে শারীরিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে, তাতে অনেকেই আল্লাহর প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলতেন। কিন্তু এই দৃঢ় মনোবলের তরুণী আস্থা হারায়নি। সে এ নিয়ে কখনও অভিযোগ করেনি।

মায়ের হাত ধরে করা প্রার্থনায় সে মনে করত তার যন্ত্রণা শেষ হবে। এভাবে সে তার নিদারুণ যন্ত্রণাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পেরেছে। বিশ্বাস করেছে, আল্লাহ নিশ্চয়ই তার জন্য বড় কোনও লক্ষ্য রেখেছেন।

১ জুলাই ২০১৬, জাতি হিসেবে আমরা আমাদের নিষ্কলুষতা হারিয়েছি। আমাদের সতর্ক হতে হবে, যাতে করে অবিন্তার মতো এত তাড়াতাড়ি কেউ আমাদের এই প্রিয় জাতি ছেড়ে না যায়। অবিন্তা ও তার মায়ের জন্য ই ই কামিংস-এর কবিতা উদ্ধৃত করে বলতে চাই—

সঙ্গে নিয়ে

তোমার হৃদয় (আমার হৃদয়ে)

তুমি জীবনজুড়ে থাকো ছেয়ে

(যেখানেই চলে, যাও না কেন

ঘটুক যা খুশি তবু তুমি জেনো

ও প্রিয়ে)!

 

ভয় করি না, নিয়তিরে আর

(প্রিয়; নিয়তি আমার তুমি)

পৃথিবীর নেই কোনও দরকার

(সুন্দর, তুমি যে আমার সব

জানে অন্তর্যামী)

 

এবং এখানে চাঁদের চাওয়ায়

অথবা যদি সূর্যেরও গাওয়ায়

যদি তোমাতে মুখর হয়, তবু

জানবে না, কোনও গোপনতায়

(শেকড়ে শেকড়ে, অঙ্কুর দলে

আকাশ গভীরে আকাশ তলে

ভাবি যারে—জীবন বৃক্ষ বলে;

বেড়ে ওঠে, যা আত্মা ছাড়িয়ে

ছড়িয়ে থাকে আশার আশায়

অথবা বন্দি সে হৃদয় পাড়ায়)

আশ্চর্যময় সে পৃথক তারায়, 

তোমার হৃদয় বয়ে বয়ে যায়

(আমার; হৃদয়ের কোলে।)

 

সব সময় ভালোবাসি।

খালামনি।

 

লেখক: ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান ক্যাফেতে জঙ্গি হামলায় নিহত অবিন্তা কবিরের খালা। ১৮ বছরের অবিন্তা কবির ছিলেন বাংলাদেশী আমেরিকান। অবিন্তার ছেলেবেলা কেটেছে ঢাকায়। সর্বশেষ, ইমোরি অক্সফোর্ড কলেজের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।

(মূল লেখাটি ঢাকা ট্রিবিউন-এ প্রকাশিত। এখানে ভাষান্তর করে প্রকাশ করা হয়েছে। ই ই কামিংস-এর কবিতা ভাষান্তর করেছেন মনোজিৎ মিত্র।)

/এএ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বিএনপির বিরুদ্ধে কোনও রাজনৈতিক মামলা নেই: প্রধানমন্ত্রী
বিএনপির বিরুদ্ধে কোনও রাজনৈতিক মামলা নেই: প্রধানমন্ত্রী
চুয়াডাঙ্গায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা, হিট অ্যালার্ট জারি
চুয়াডাঙ্গায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা, হিট অ্যালার্ট জারি
জিমি নেই, তারপরও খেলতে নামছে মোহামেডান
জিমি নেই, তারপরও খেলতে নামছে মোহামেডান
বায়ার্নের কোচ হওয়া থেকে এক ধাপ দূরে জিদান
বায়ার্নের কোচ হওয়া থেকে এক ধাপ দূরে জিদান
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!