X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইলিশবাড়ি চর পাতিলা

ফারুখ আহমেদ
২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৪:৪০আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৬:১১
image

সুবিশাল মেঘনা নদী আমাকে মুগ্ধ করে সবসময়ই। সেদিন আবারও বের হলাম মেঘনা নদী ও তার আশেপাশের চর এলাকা ঘুরে দেখার জন্য। এখন ইলিশের সময়, দেখা হয়ে যাবে ইলিশও!

পঞ্জিকা মতে বর্ষা মৌসুম শেষ। হলে কি হবে, মধ্য শরতেও বৃষ্টি বন্ধ হয়নি। এমনই এক বৃষ্টিস্নাত দিনে দেশের দক্ষিণাঞ্চল ঘুরে দেখার সাধ হলো। যেতে হবে নদীতে ভেসে ভেসে, চাইলে সাগরেও মিশে যাওয়া যাবে। চর কচ্ছপিয়া হয়ে চর কুকরি-মুকরি, ঢাল চর ও চর পাতিলা ঘুরে বেড়াবো। সেজন্য ঢাকা থেকে যাচ্ছি ভোলার চর ফ্যাশন। কথা হয়েছে বন্ধু হাশেম মহাজনের সঙ্গে। বৃহস্পতিবার রাতে যাত্রা শুরু করলাম।

চর পাতিলার পথে

লঞ্চে সদরঘাট থেকে যাব বেতুয়া। বেতুয়া চর ফ্যাশনের অন্যতম নদী বন্দর। বেতুয়া থেকে চর ফ্যাশন শহরে কিছু সময় কাটিয়ে আমরা শশিভূষণ হয়ে চলে যাব চর কচ্ছপিয়া, তারপর ট্রলার বা স্পিডবোটে চর পাতিলা। যাত্রা শুরু করলাম ঢাকা থেকে। বুড়িগঙ্গা নদীর অবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভালো, নদীর পানির ঘনত্ব কমেছে। এখন বুড়িগঙ্গাতেও মাছ ধরা পড়ে, আগের মতই বিলুপ্ত প্রায় শুশুক ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। কিন্তু বুড়িগঙ্গার কোনো তেজ নেই! এসব ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আমাদের যাত্রা শুরু হয়। আমরা বলতে, আমি আর ওয়াজেদ মহান।

চর পাতিলা

ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম দুইজন, চর কচ্ছপিয়ায় এসে সে সংখ্যা পাঁচে পরিণত হল। হাশেম ভাই, তার বন্ধু আলাল ভাই আর সহযোগী জাকির তালুকদার। ঘাটে স্পিডবোট আমাদের জন্য তৈরি ছিল কিন্তু হাতের কাছে ইলিশের নৌকা পেয়ে লোভটা সেদিকেই গেল। কচ্ছপিয়ার খাল দিয়ে আমাদের নিয়ে তরতর করে সে নাও এগিয়ে চলল চর পাতিলার দিকে। আমাদের নৌকা তেতুলিয়া নদীতে পড়তেই নদীর বিশালতা বোঝা গেল। তারপর বুড়া গৌরাঙ্গ হয়ে যখন বিশাল মেঘনায় পড়লাম মহানের চোখ দেখি চড়কগাছ! নদীর এমন বিশাল রূপ দেখে সাগর ভেবে ভুল হয়। নদীর কুল নাই/ কিনার নাই বুঝি একেই বলে। আর নদীতে সেকি ঢেউ! নদীতে ঢেউ খেলে যাচ্ছে, নৌকা দোল খাচ্ছে। সেই সঙ্গে ঢেউয়ের ঝাপটা এসে লাগছে আমাদের নৌকায়, পানি আছড়ে পড়ছে নৌকার ভেতর।

মেঘনায় চলতে চলতে কত যে মাছ ধরার ট্রলার দেখলাম তার ইয়ত্তা নেই। মাঝ নদীতে ছোট্ট এক শিশুকে একটি কোষা নৌকায় বৈঠা হাতে কসরত করতে দেখলাম, একেই বলে নদীর জীবন। যেখানে আমাদের বুকে কাঁপন ধরায় সেখানে এরা নির্ভার। বিশাল নদীর বিশাল রূপ। নদীর বর্তমান রূপ দেখে বোঝার উপায় নেই বর্ষা চলে গেছে। আমরা যখন চর পাতিলার কাছাকাছি চলে এসছি তখন দেখি দূরের গ্রামগুলোর কিছু কিছু বাড়ি ডুবে ডুবে দাঁড়িয়ে। আমার কাছে দৃশ্যটা অসাধারণ সুন্দর মনে হলেও এখানকার বাসিন্দাদের জন্য অবর্ণনীয় কষ্টের।

আমরা এর মধ্যে চর কুকরি-মুকরির ম্যনগ্রোভ বন পেরিয়ে চলে এসছি চর পাতিলার বাঁকে অর্থাৎ আমাদের গন্ত্যবের খুব কাছে। এখানে একটা কুকুর দেখি নদীর সাঁতরে পার হচ্ছে। চারপাশের অথৈ পানির মধ্যে ছোট্ট দ্বীপ চরের মাঠে বিশ-পঁচিশটা গরু চড়তে দেখলাম। তারপর মেঘনার যে বাঁক পেরিয়ে আমরা ছোট্ট দ্বীপ চরে আমাদের মাছ ধরার নৌকা বা ইলিশের নাও নোঙর করি, সে জায়গাটির নামই চর পাতিলা।

চলছে ইলিশ কেনাবেচা

চলছে ইলিশ কেনাবেচা

পুরো চরকে জেঁকে ধরেছে অসংখ্য মাছ ধরার ট্রলার। আমরা যখন চর পাতিলার মাটি স্পর্শ করি তখন জুম্মার আজান দিচ্ছে। পাতিলার চরে পা দিয়েই বুঝতে পারি চরটা আসলেই মৎসজীবীদের আস্তানা। মাছের লোভে অনেক পাখিরও এখানে আনাগোনা। চর পাতিলায় পা দিয়ে আমরা বিমোহিত বলা চলে। কাছে গিয়ে তো অবাক! যেমন শুনেছি ঠিক তেমনই। চর পাতিলাকে মৎসজীবীদের আস্তানা বলা হলেও সেটা আসলে ইলিশ মাছের আস্তানা। কিছুক্ষণ পর পর দূরের নদী বা সমুদ্র থেকে ট্রলার ভর্তি ইলিশ আসছে আর বিভিন্ন মাছের গদিঘর বা আড়তে সে মাছ চালান হচ্ছে। এসব মাছের আড়তে ডাক ওঠে না। আড়তদার জেলেদের দাদন দিয়ে থাকেন। যে আড়তের মালিকের কাছ থেকে জেলেরা টাকা নেয়, মাছ সেই আড়ত মালিকই পেয়ে থাকেন। হাশেম মহাজন বললেন, পানিতেই লক্ষ লক্ষ টাকা। পানির মতই ফুলে উঠতে পারে, আবার ডুবে যাওয়াটা কোনও ব্যাপার না! আমরা তার কথা শুনি আর ইলিশ মাছ দেখি, মাছের নৌকা এলেই ছুটে যাই। মাঝে মধ্যে এক থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশ দেখলে সেই মাছ স্পর্শ করে দেখি। দুপুরে খেলাম ইলিশ ভুনা, ইলিশ ভাজা, ইলিশ ভর্তা, পুঁইশাক দিয়ে ইলিশ মাথা দিয়ে। পুরো বিষয়টাই ইলিশময়!  

ইলিশ মাছ

খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম। তারপর আবার ক্যামেরা হাতে বের হই। ঘুরে দেখি চর পাতিলার বাজার, স্কুল ও মসজিদ। বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা মেঘনা পারের দ্বীপ চর কুকরিমুকরি। চর কুকরিমুকরির একটি ইউনিয়ন চর পাতিলা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখানে স্বাভাবিক ঘটনা। এই নিয়ে চরের কারোর কোনও দুশ্চিন্তা নেই। তবে চরের বাসিন্দা ইদ্রিশ আলীর আক্ষেপ চরটা মনে হয় থাকছে না। ভাঙ্গনের কবলে পড়ে একবারে শেষ অবস্থা চরের। আমি ইদ্রিশ আলীর এই আক্ষেপ নিয়ে চর পাতিলার একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াই আর ক্যামেরায় বিরামহীন ক্লিক করে চলি। অনেক বৃদ্ধ দেখে প্রশ্ন করেন কেন এসেছি। বলি ইলিশ দেখতে এসেছি। শুনে বলে তারা তাদের বাসায় ইলিশ খাওয়ার দাওয়াত দিয়ে দেন। আমি হাসি আর ভাবি এত সহজে আমরা কাউকে নিমন্ত্রণ জানাতে পারি না। কিছুক্ষণ পর জাকির তালুকদারের খোঁজাখুঁজিতে আবার মেঘনা পাড়ে পৌঁছে যাই। তখনও ইলিশ আসছে। আবার অনেক জেলেকে দেখলাম অলস সময় কাটাতে। রাতে মাছ ধরতে বের হবেন। অনেকেই বসেছেন জাল নিয়ে। ফুটাফাটা জাল মেরামত করে নিচ্ছেন। অনেক জেলে রাতে তাদের নৌকায় মাছ ধরা দেখতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখে। আমরা ইলিশ নৌকায় চেপে মাছ ধরা দেখতে গিয়েছিলাম কিনা সে গল্প আজ থাক। শুধু এইটুকু বলি, এমন ইলিশময় একটি চমৎকার দিন আমাদের জীবনে আর আসেনি! এ যেন ইলিশের রাজ্য।

জাল মেরামত চলছে

প্রয়োজনীয় তথ্য 

ঢাকা থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় এবং সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বেতুয়া ও ঘোসের হাটের লঞ্চ ছেড়ে যায়। লঞ্চ থেকে বেতুয়া বা ঘোসের হাট নেমে সরাসরি চলে আসুন চর কচ্ছপিয়া। এখানে লাইনের ট্রলার বা রিজার্ভ ট্রলার নিয়ে চলে যান চর পাতিলা। চর পাতিলায় থাকার ব্যবস্থা নিজেদের করে নিতে হবে। দলবেঁধে গেলে তাঁবু কিংবা স্থানীয় কারোর বাড়ি অথবা মাছের গদিঘরই ভরসা। সারাদিন ইলিশ মাছ দেখুন, চাইলে রাতেও। পারলে ইলিশ নৌকায় চড়ে জেলেদের মাছ ধরা দেখে আসতে পারেন। চর পাতিলার আশেপাশেই রয়েছে চর কুকরি-মুকরি, ঢাল চর, সোনার চর, তারুয়ার দ্বীপ ইত্যাদি। দেখে আসতে পারেন সেগুলোও।

এখানে খাবারের সমস্যা নেই। ছোট হোটেল আছে, আগে বলে রাখলেই রান্নার বা খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

সচেতনতা

নদী পথে যাতায়াতে একটু বাড়তি সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে। সম্ভব হলে সঙ্গে লাইফ জ্যাকেট রাখবেন। শুকনা খাবার এবং প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধ সঙ্গে রাখবেন। একটা বিষয় খেয়াল রাখবেন। আপনার বা আপনার ভ্রমণ সঙ্গীদের দ্বারা পরিবেশ হুমকিতে পড়ে এমন কোনও কিছু অবশ্যই করা চলবে না। পলিথিন বা প্লাষ্টিকের বোতলসহ পরিবেশ বিপন্ন হয় এমন কিছু ফেলে আসবেন না।

ছবি: লেখক


/এনএ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
‘হিট ইমারজেন্সি’ জারির আহ্বান সাইফুল হকের
‘হিট ইমারজেন্সি’ জারির আহ্বান সাইফুল হকের
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী