কেউ ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন! কেউ বই পড়তে! কারও আবার প্রিয় পশু-পাখি পোষা। কারও আবার বাগান করার সখ! এমন একজন মানুষ যার বৃক্ষের প্রতি অগাদ ভালোবাসা। বৃক্ষই ধ্যান, বৃক্ষই জ্ঞান, বৃক্ষই তার সাধনা। পড়াশুনা করছেন বিবিএ শেষ বর্ষে। কিন্তু পড়াশুনায় তার মন নেই। বলছি, বৃক্ষ প্রেমিক উৎপলের কথা। তার পুরো নাম বোরহান উদ্দিন খান উৎপল। বয়স ২৫।
তিনি সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোল চৌরঙ্গী মোড়স্থ নিজের বাড়ির ভিতরে প্রায় আড়াই শতাধিক ফলজ, বনজ ও ওষধি গাছ লাগিয়ে বাড়ি ভরে ফেলেছেন। বাড়ির ছাদে উঠতেই ছোখ ছানাবড়া সারি সারি বট গাছ দেখে। ছাদ জুড়ে ১৫ বয়সী বটবৃক্ষসহ বিভিন্ন বৃক্ষের সমাহার। এটি কি সম্ভব। হ্যা, তার দ্বারা সম্ভব কারণ তিনি একজন সৌখিন বনসাই শিল্পী। অসাধ্য সাধন করে তিনি বড় বড় বট গাছকে খর্বাকৃতি করার পাশাপাশি বিভিন্ন আকৃতি দিয়েছেন। ছোট ছোট বট গাছে ফল হয়েছে, ছোট গাছে ধরেছে মালটা। গাছ দিয়ে লিখেছেন আল্লাহ, টবের মধ্যে ইট বসিয়ে ইটের উপর গাছ লাগিয়েছেন। এ যেন জীবন্ত শিল্পকর্ম।
সবুজের সমারোহ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। ১৫ বছর ধরে পরম যত্নে উৎপল গড়ে তুলেছেন এই সখের বাগান।
সরেজমিনে গিয়ে তার বাড়িতে দেখা গেল, দিনের বেলায়ও মাটিতে যেন একটু আলো পড়ার সুযোগ নেই। পড়বে বা কী করে? প্রাচির ঘেরা বাড়িতে বড় বড় গাছ লাগানো হয়েছে। কিন্তু এগুলো তো কিছুই না। তার বাড়ির ছাদে রয়েছে অন্যতম আকর্ষণ বনসাই গাছ। যেন এক মিনি বন!
দুপুরের কড়া রোদে টবের ভেতরের ঘাস পরিস্কার, গাছের মরা পাতা কাটার কাজ করছেন। ছোট বেলা থেকে এসব কর্মকাণ্ডের কারণে বন্ধুরা কেউ বট পাগলা, কেউ বৃক্ষপ্রেমিক নামে ডাকে। তাঁর বাড়িকে মানুষ ‘বনসাই বাড়ি’ নামে চেনে।
তার বাগানে রয়েছে দেশি বট, চায়না বট, পাকড় বট, লোটা বট, ঔষধ বট, খুদে বট, থাই বট, ভ্যায়া কাটা বট, সাইকাস বট, বাটার ফ্লাই বটসহ ১৫ প্রজাতির বনসাই বট বৃক্ষ। এছাড়া তিনি সুন্দরবনের নোনাপানির গেওয়া প্রসেসিং করে মিষ্টি করে সেটিও বনসাই করেছেন। সৌদি আরবের খেঁজুর গাছও বনসাই করার প্রস্তুতি চলছে।
এছাড়া তার বাগানে দেশি-বিদেশি ৪১ প্রজাতির বনসাই গাছ আছে শতাধিক। সেগুলো হলো- দুই জাতের কামিনী ফুল, বকুল ফুল, চেরি ফল, সফেদা, তেতুল, জেদি, বনজাম, ছেতিম, সেড়া, পাইন, ছাপোনা, দুই জাতের পেয়ারা, সিলভার ডাস্ট, স্বেত চন্দন, চায়না কমলা, অস্টেলিয়ান কমলা, জুই ফুল গাছ, এডিমিনিয়ান, ঝাউগাছ, শিমুল, টগর ইত্যাদি।
বোরহান উদ্দিন উৎপল জানালেন, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াকালিন সাতক্ষীরা শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কে বৃক্ষ মেলায় যেয়ে বনসাইয়ের প্রেমে পড়ে যাই। তার পর কাঞ্চন ব্যানার্জি ছোট্টু (তিনি এখন আর বেঁচে নেই) দাদার কাছ থেকে নিয়ম শিখে শুরু করে দেই বনসাই করার কাজ। প্রথম যে বনসাইটি তৈরি করেছি তার বয়স এখন ১৫ বছর। সবচেয়ে বড় কথা বনসাই এমনি একটি শিল্প যার মাধ্যমে বৃক্ষকে ইচ্ছামতো রূপ দেওয়া যায়।
এই বনসাই শিল্প বাজারজাত করার ইচ্ছে আছে কিনা জানতে চাইলে উৎপল বাংলা ট্রিবিউনে বলেন, এখন পর্যন্ত এটা আমার কাছে একটা শিল্পকর্মই এবং বিক্রি করার কথা শুনলে কষ্ট লাগে। তবে খুব তাড়াতাড়ি বাণিজ্যিকভাবে বনসাই বিক্রি করার কাজ শুরু করবেন বলে তিনি জানান। বনসাই শখের পাশাপাশি এটি বাণিজ্যিকভাবে করা যায়। কিছুদিন আগে এখন একটি বনসাই ১৭ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিল কিন্তু আমি দেইনি। প্রতিদিন মাত্র দুইঘণ্টা সময় দিয়ে অনেক বনসাই বিক্রি করা যায়।
উৎপল ইন্টারনেট ঘেটে ইউটিউবে টিউটোরিয়াল দেখে বনসাই তৈরি বিষয়টি আরও ভালোভাবে রপ্ত করেছেন।
২০০১ সালে ২২ ফুট লম্বা একটি মরিচ গাছ তৈরি করেছিলেন তিনি। সেটিতে তিন হাজার মরিচ ধরেছিল। সে বছর সাতক্ষীরা কৃষি মেলায় প্রথম পুরস্কার লাভ করেন।
অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার বাবা আলাউদ্দিন খান ও গৃহিনী মা নাজমুন নাহার খান দম্পতির দুই ছেলের মধ্যে উৎপল ছোট। পড়াশুনা অমনোযোগী হওয়ার কারণে প্রথম দিকে পরিবার থেকে তার এই কাজে বাধা পেলেও এখন সবাই তাকে সাহায্য করে।
/এফএএন/