X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

সমীরণ দত্তের শেকড়ের আসবাব

সামিউল্ল্যাহ সমরাট
২২ নভেম্বর ২০১৬, ১৮:৩০আপডেট : ২২ নভেম্বর ২০১৬, ১৮:৪১
image

ছোটবেলা থেকেই গতানুগতিক চিন্তা থেকে বেরিয়ে নতুন কিছু ভাবতে পছন্দ করতেন শিল্পী সমীরণ দত্ত। হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তাই দিয়েই ঝটপট বিভিন্ন কিছু বানিয়ে ফেলেন তিনি। পরে থাকা এক টুকরো কাঠ কিংবা শক্ত মাটির টুকরো অথবা কুড়িয়ে পাওয়া শুকনো নারিকেল থেকে বানিয়ে ফেলেন দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য অথবা শো পিস। বন্ধু কিংবা আপনজনদের বিশেষ দিনে উপহার হিসেবে তুলে দেন তার সেই অন্যরকম সৃষ্টি। সমীরণ দত্তের সেই অসাধারণ শিল্প চেতনা শুধু ছোট শো পিসেই আটকে থাকেনি, পুরোদস্তুর বিশাল এক কর্মযজ্ঞে রূপ নিয়েছে এখন। ফেলনা ও অব্যবহৃত উপকরণ কাজে লাগিয়ে মেধা আর পরিশ্রমে গড়ে তুলছেন দৃষ্টিনন্দন আসবাব। তেজগাঁও গুলশান লিংক রোডের ডাইনেস্টি ফার্নিচারে গিয়ে শিল্পী সমীরণ দত্তের তৈরি অনন্য আসবাবপত্রের বিশাল সাম্রাজ্যে দেখে তো চোখ ছানাবড়া! প্রতিটি আসবাবই দারুণ। বৈচিত্র্যময় নকশায় একটি আরেকটি থেকে আলাদা। বিস্তর সন্ধান করে সংগ্রহ করা বিভিন্ন গাছের শেকড় থেকে সমীরণ তৈরি করেছেন এসব।

শেকড় দিয়ে তৈরি খাট

শেকড়ের টেবিল

জানালেন, আসবাবের জন্য মেহগনি আর লিচু গাছের শেকড়কেই বেশি প্রাধান্য দেন তিনি। টেকসই ও মসৃণ করে তুলতে লিচু ও মেহগনির শেকড়ই উপযুক্ত। দেখা গেল আস্ত লিচু গাছের শেকড় হয়ে গেছে আকর্ষণীয় ডাইনিং টেবিল। এই টেবিলটিকে অনায়াসে কনফারেন্স টেবিল হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে। প্রায় দু’শ বছরের প্রাচীন দুটি লিচু গাছের শেকড় একটির সাথে আরেকটি উপর নিচ করে জোড়া লাগিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই নান্দনিক টেবিল। ৪ জন আসবাব শ্রমিক প্রায় ১৪ মাস নিরলস পরিশ্রম করে বানিয়েছেন এই টেবিল। টেবিল ঘিরে থাকা অনেক পুরনো মেহগনি গাছের শেকড় দিয়ে বানানো চেয়ারগুলোও নিজেদের ব্যাতক্রমী আকৃতির জন্য নজর কাড়ছে। রয়েছে দারুণ কিছু খাট । এগুলো মেহগনি শেকড় থেকেই তৈরি। প্রতিটি আসবার তৈরির পেছনে মেধার পাশাপাশি রয়েছে নিরলস শ্রম। কোনটিতে ছয় মাস আবার কোনটিতে আট মাস সময় ব্যয় করেছেন। প্রতিটি শিল্পকর্মের কারুকাজের সূক্ষ্মতা শুধুই বিস্ময়। শিল্পীর সুগভীর শিল্পবোধের পরিচয় বহন করছে আসবাবগুলো। ছোট ছোট আরও কিছু চেয়ার আর টুল সাজিয়ে রাখা হয়েছে পুরো চারতলা জুড়ে। সেট ছাড়াও আলাদা আলাদা করে বানানো রয়েছে কিছু আসবাবপত্র। এগুলোর রকমারি নকশার সমন্বয়ও অতুলনীয়।

সমীরণ দত্ত

শিল্পী সমীরণের এই মহা কর্মকাণ্ডে কিন্তু বৃক্ষ নিধন করা হয় না । গাছ কেটে নেওয়ার পর শেকড় সাধারণত জ্বালানী হিসেবেই ব্যবহার করা হয়। এই শেকড়ই যোগাড় করেন তিনি। কোথাও গাছ কাটা হলেই খবর চলে যায় তার কাছে। দল-বল নিয়ে হাজির হন সমীরণ। চলে খনন কাজ। তারপর সেটিকে তুলে আনেন তার গ্রাম চাঁদপুরে জেলার শাহরাস্তির ঘুঘুশালে। এই শান্ত সুনিবিড় গ্রামেই গড়ে তুলেছেন কারখানা। সমীরণ দত্তের সমস্ত নির্মাণ এই ঘুঘুশালের কারখানাতেই। এখান থেকে তৈরি শো পিস আর আসবাবপত্র চলে যায় গুলশানের ডাইনেস্টি ফার্নিচারে। চারজন শ্রমিকের নিয়মিত কাজের পাশাপাশি স্কুল কলেজের দরিদ্র্য শিক্ষার্থীদেরকেও এই কাজে সম্পৃক্ত করেছেন তিনি। পড়ালেখার পাশাপাশি সৃজনশীল কাজে দক্ষ হয়ে উঠছে তারা। কোথাও কোনও শেকড়ের সন্ধান কিংবা পরিত্যাক্ত কাঠের সন্ধান পেলেই এই শিক্ষার্থীরা খবর দেন শিল্পীকে। সংগৃহীত শেকড়ের কোন অংশই বাদ যায় না । আসবাব বানানোর পর বাড়তি অংশের আকৃতি অনুযায়ী তৈরি করে ফেলেন এমন সব পণ্য যা যে কেউই বসার ঘরে সাজিয়ে রাখতে চাইবেন।
শেকড় সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক বিপত্তির ঘটনাও ঘটেছে। একটি প্রাচীন লিচু গাছকে কয়েক মাস ধরে নজরে রেখেছিলেন। একদিন খবর এলো গাছটি কাটা হচ্ছে। সাথে সাথেই ৫ জন শ্রমিক নিয়ে হাজির হলেন সমীরণ। গাছ কাঁটা হয়ে গেলে মালিকের কাছ থেকে শেকড়টি কিনে নেন। শেকড় খননের কাজ শুরু হলো। পুরনো গাছের শেকড় বিশেষ করে লিচু গাছের শেকড় অনেক দূর পর্যন্ত জালের মত বিস্তৃত হয়ে থাকে। চতুর্দিকে প্রায় ১৫ ফুট দূর থেকে গর্ত করা শুরু হলো। ছেঁটে ছোট করা হলো শেকড়গুলো। কাটার পর শেকড়ের অগ্রভাগ সুচালো আকৃতির হওয়ার কারণে বেশ ঝুঁকিপূর্ন হয়ে গেল কাজটি। শ্রমিকদের সাথে আরও কয়েকজন স্থানীয় লোক নিচ থেকে শেকড়টি তোলার চেষ্টা করতেই কে যেন চিৎকার করে উঠল। সমীরণ যা আশঙ্কা করছিলেন তাই। শেকড়ের নিচে চাপা পড়েছে কেউ।  নিশ্চয় এতক্ষণে সুচালো শেকড় তার দেহ এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে। নিজেই নেমে পড়লেন গর্তে। বেশ কিছুক্ষণ পর ঐ শ্রমিককে বের করা হলো। সে এক অলৌকিক ব্যাপার! সামান্য কয়েকটি আঁচড় ছাড়া তেমন কিছুই হয়নি!

কাজে লাগান শেকড়ের সব অংশই

একবার এক ভদ্রলোক লিচু ও মেহগনি শেকড়ের সংমিশ্রণে একটি খাটের অর্ডার করেন।  সেটি পছন্দ হলে আরও কয়েকটি নেবেন বলে জানান। শেকড় সংগ্রহ করে দীর্ঘ তিন মাস পুরো দলসহ শ্রম দিয়ে খাটটি অনেক আকর্ষণীয় করে বানানোর পরেও সেই লোক অপছন্দের কথা বলে সেটি আর কেনেননি। এমন অনেক গল্পই জড়িয়ে আছে সমীরণের কাজের পেছনে।  শিল্পী সমীরণ দত্তের শিল্পী হয়ে ওঠার পেছনের গল্পও অনেক সংগ্রামের। এই সংগ্রাম তিনি এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন। কৃষক বাবা অবনী মোহন দত্ত আর মা ছবিরানী দত্তের চার সন্তানের মধ্যে ছোট এই ছেলের মেধার পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল শিক্ষা জীবনের প্রারম্ভেই।  ১৯৮৪ সালে ফেনীর দাগনভুইয়া স্কুল থেকে এস এস সি দিয়ে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে ৯ম স্থান অধিকার করেন তিনি। চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ থেকে এইচ এস সি করলেন চটগ্রাম কমার্স কলেজ থেকে। এবারও প্রতিভার স্বাক্ষর রাখলেন । ভর্তি হলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে। বড় ভাইয়ের ইচ্ছে ছিল সমীরণ চ্যাটার্ড একাউন্টেন্ট হবেন। কিন্তু পাহাড় ঘেরা সবুজ নিবিড় পরিবেশ সমীরণ দত্তের সৃষ্টিশীল মনকে যেন আরও ধারালো করে তুলল। জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে তিনি শেকড়-বাকড় খুঁজে বেড়াতে শুরু করলেন। সেই শেকড়কে রূপ দিলেন অর্থবহ ভাস্কর্যে। মাঝে মাঝেই উধাও হয়ে যান তিনি। বন্ধু মহলে তার এই শিল্পগুণের জন্য যতটা না খ্যাতি ছিল তার চেয়ে বেশি সমালোচনা হতো পাগলাটে স্বভাব নিয়ে। বড় ভাই মারা গেলেন। আর্থিক ভাবে বেশ অনটনে পড়তে হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার শেষ ধাপ চুকিয়ে কাজের সন্ধানে ছুটে এলেন ঢাকায়। একটি পোশাক তৈরি কারখানায় অ্যাকাউন্টসে কাজ নিলেন। সংসারও পেতেছেন। কিন্তু থিতু হতে পারলেন না। বেশ ক’বার চাকরি বদলে আবারও ফিরলেন চট্টগ্রামে। কিছু বন্ধুর কাছে ঋণ করে আর নিজের উপার্জন মিলিয়ে নিজ গ্রামে ব্যবসায়িকভাবেই শুরু করলেন ব্যতিক্রমি আসবাব তৈরির কাজ। পরিচিত জনদের মাধ্যমেই এই শেকড় শৈলীর কথা অনেকের কাছেই ছড়িয়ে গেল।

শেকড়ের খাট

গাজীপুরের এক ব্যবসায়ী বিভিন্ন অবয়বের এসব আসবাব নিয়ে বড় পরিকল্পনার কথা বলে সমীরণ দত্তকে সেখানে নিয়ে যান । প্রথম ক’মাস ভাল চললেও সেখানে প্রতারণার শিকার হন তিনি। শক্ত ধাক্কা খেলেন। ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। চেষ্টা করলেন ঘুরে দাঁড়ানোর। ২০১০ সালে সিলেটে প্রদর্শনীর আয়োজন করলেন। বিক্রিও হল বেশ। ২০১৩ সালে ঢাকার ধানমণ্ডিতে আরেকটি প্রদর্শনী হলো। দেশের গুণী শিল্পীসহ বেশ নামি দামী ব্যবসায়ীরা অপূর্ব কাজগুলো দেখে মুগ্ধ হলেন। সেখানেই আসবাবপত্র ব্যবসায়ী আফজাল হোসেন সমীরণ দত্তের কাজের প্রতি আগ্রহ দেখান। পরের মাসেই তেজগাঁও-গুলশান লিঙ্ক রোডের নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ডাইনেস্টি ফার্নিচারের ৩য় ও ৪র্থ তলা সমীরণ দত্তের জন্য বিনা ভাড়ায় ছেড়ে দেন।  কাজে গতি পেলেন সমীরণ । প্রচার বাড়ল, বাড়ল প্রসারও।

কোনও কিছুই ফেলনা নয়।  শিল্পের ছোঁয়ায় মরা কাঠেও প্রাণের সঞ্চার করে চলেছেন সমীরণ দত্ত। শত বাধা বিপত্তি আর প্রতিকূল পরিবেশেও নিজের কাজ নিষ্ঠার সাথে করে যাচ্ছেন তিনি। স্বপ্ন দেখেন তার কাজ একদিন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে যাবে।

ছবি: শাহরিয়ার শাওন

/এনএ/  

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পাগলা মসজিদের দানবাক্সে এবার মিলেছে ২৭ বস্তা টাকা
পাগলা মসজিদের দানবাক্সে এবার মিলেছে ২৭ বস্তা টাকা
বিকল্প অর্থনীতি ও গ্রাম্য কায়কারবার
উপন্যাসবিকল্প অর্থনীতি ও গ্রাম্য কায়কারবার
ইরান-সমর্থিত ইরাকি সেনা ঘাঁটিতে বিস্ফোরণ, নিহত ১
ইরান-সমর্থিত ইরাকি সেনা ঘাঁটিতে বিস্ফোরণ, নিহত ১
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলি বন্ধ
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলি বন্ধ
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি