X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভাঙনের শব্দ শুনি...

সামিউল্ল্যাহ সমরাট
৩০ নভেম্বর ২০১৬, ১৭:৪৭আপডেট : ৩০ নভেম্বর ২০১৬, ১৮:০৪
image

বয়রাকান্দি গ্রামের শেষ মাথায় মেলা বসেছে। চলছে লাঠি খেলা, পাতা খেলা, গরু বাইচ, ঘোড় দৌড়। রাতে মঞ্চস্থ হবে স্ত্রী বন্ধকের মর্মস্পর্শী গল্প নিয়ে নাটক ‘মায়া বন্ধক।’

ঝলমলে চাঁদনি রাত। চাঁদের আলো ছড়িয়ে আছে খাঁ বাড়ির আঙ্গিনা জুড়ে। সে আঙ্গিনায় গোল হয়ে বসেছেন ধলিরকান্দি গ্রামের শ'দুয়েক মানুষ। সবার মধ্যমণি হয়ে দোতারা হাতে সুরে সুরে গাজী কালুর কিচ্ছা গেয়ে চলেছেন কাটু মিয়াঁ। ঝনঝনে খঞ্জনি বাজিয়ে তাকে সঙ্গ দিচ্ছেন আরও দুজন। রূপবতী রাজকন্যা চম্পাবতীর জুড়ে দেয়া শর্ত পালন করতে কত কষ্টই না করতে হচ্ছে গাজী কালুকে। সেই কষ্টে শ্রোতাদের অনেকেই ফেলছেন চোখের জল। এভাবে এগিয়ে চলে গল্প। চলে মাঝরাত অবধি ।
এই দৃশ্যটি বছর কয়েক আগের। এই খাঁটি গ্রাম্য সম্মিলন আর বিনোদনের গল্প এখন শুধুই ইতিহাস। গাজী কালুর গল্প এই অঞ্চল থেকে হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন হারিয়ে যেতে বসেছে সেই অঞ্চলও। ধলিরকান্দি গ্রামের অর্ধেকের বেশি অংশই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে গত কয়েক বছরে। খাঁ বাড়ির উঠোনটুকু এখনও টিকে থাকলেও ধসে যাওয়ার প্রহর গুনছে।  ঘাড়ের উপরে এসে নিঃশ্বাস ফেলছে যমুনা নদী। গিলে খাবে যেকোনও মুহূর্তেই। আশেপাশের অনেকেই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন। যে কয়েকটি বাড়ি বাকি রয়েছে তার বাসিন্দারাও অন্যত্র সরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

নদীর গর্ভে হারিয়ে যায় শত বছরের বসতি...

খাঁ বাড়ির মেয়ে রেজেকা সুলতানা রাজিয়া দীর্ঘদিন থেকে এই এলাকায় হোমিওপ্যাথিক  চিকিৎসা দিয়ে আসছেন। সম্প্রতি বন্যার পানিতে পুরো গ্রাম ডুবে গেলে  নিরুপায় হয়ে স্থানান্তর হয়েছেন বড়ইকান্দি গ্রামে। তিনি জানালেন, নিজের এলাকা ছেড়ে কখনো অন্য জায়গায় চলে যেতে হবে ভাবিনি। এই নদী ভাঙন তো আজকের কথা নয়। ছোট বেলায় এই নদী ছিল অনেক দূরে । আমাদের বিশ্বাস ছিল একটা স্থায়ী ব্যবস্থা হবেই। কিন্তু সেটা আর হলো না। চিরদিনের জন্য নিজ গ্রাম ছেড়ে যাওয়া যে কতটা কষ্টের তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। বাবার কবরটা এখানেই রয়ে গেল। জানিনা আগামী বছর পর্যন্ত এই শেষ স্মৃতিটুকু টিকবে কিনা।

নদী ভাঙনের নিষ্ঠুর শব্দে আতংকিত হতে হয় প্রতিদিনই।।
একটি জনপদ যখন বিলীন হয়ে যায় তখন ভূখণ্ডই শুধু হারিয়ে যায় না,  হারিয়ে যায় ওই জনপদের শত শত বছরের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বন্ধন। ভেঙে যায় শিক্ষা ব্যবস্থা। বসতি হারিয়ে মানুষগুলো যে যার সাধ্য অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন গ্রাম বা শহরে চলে যায়। অচেনা জায়গায় গিয়ে তৈরি করে নতুন বসতি। আশেপাশের মানুষগুলো থাকে অচেনা। পরিবেশ থাকে অচেনা। শুধু মাত্র সরকারি চাকুরে বাদ দিয়ে অন্যন্য পেশার মানুষকে বাধ্য হয়ে বদলে ফেলতে হয় পেশা। একজন ব্যবসায়ী তার বাজারের জমজমাট ব্যবসা হারিয়ে নতুন জায়গায় গিয়ে আগের মতো করে শুরু করতে পারেন না । একজন অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ জমিজমা হারিয়ে প্রায় পথে বসে যান। ধলিরকান্দি গ্রামের বাবলু খাঁ এমনি একজন। নিজের ভিটে ছেড়ে যাবার কথা স্বপ্নেও ভাবেননি। তার প্রধান উপার্জন ছিল কৃষি। সব জমিজমা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। যদিও বাড়িঘর এখনও সরিয়ে নেননি।  স্থির করতে পারছেন না কী করবেন। 

বিলীন হয়ে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম

বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের ধলিরকান্দি গ্রামের পাশেই বয়রাকান্দি। এ গ্রামের অর্ধেকের বেশি গত কয়েক মাসে বিলীন হয়ে গেছে। বয়রাকান্দি গ্রামের পূর্ব পাশে গা ঘেঁষে বইছে প্রমত্তা যমুনা। এখন পানি কমতে শুরু করেছে। তাই ভাঙনের শব্দও যেন ঘনিয়ে আসছে। এ গ্রামের মোল্লাবাড়ির কিছু মানুষ অনেক আগেই চলে গেছেন ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়া, ভুল্লি এলাকায়। এখনও টিকে থাকা কয়েক ঘরের লোকজন দ্রুতই চলে যাবেন বলে ঠিক করেছেন। কথা হলো রশিদ মোল্লা আর বাবলু মোল্লার সাথে। তাদের  দীর্ঘশ্বাসে বেরিয়ে আসে চেপে রাখা অস্ফুট আর্তনাদ। বাপ দাদার ভিটা ছেড়ে যেতে হচ্ছে। জমি-জমা ব্যবসা সব নষ্ট হয়ে গেছে। কখনও আর দেখা হবে না এত আপন মানুষগুলোর সাথে। ভাবতেই বুকটা ভেঙে যাচ্ছে।

নিজাম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়

এই ইউনিয়নের অন্যতম ব্যবসা কেন্দ্র কুতুবপুর হাট। ইউনিয়ন পরিষদও এখানে। এখন ভাঙনের হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে আছে এই হাট।

উপজেলার কর্নিবাড়ি ইউনিয়নের প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্নিবাড়ি ফাজিল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা হয় ১৯২০ সালে। কর্নিবাড়ি ইউনিয়নের প্রায় পুরোটাই যমুনা গ্রাস করেছে। ঐতিহ্যবাহী মাদ্রাসাটি স্থানান্তর করে স্থাপন করা হয়েছে কুতুবপুর ইউনিয়নের বড়ইকান্দি গ্রামে। খুব স্বাভাবিকভাবেই জৌলুস হারাতে বসেছে এই প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। কর্নিবাড়ি ইউনিয়নের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিজামউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়। ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এলাকার শিক্ষা বিস্তারে অবদান রাখা এই বিদ্যালয় এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার  জায়গা বদল করে এখন রয়েছে ধলিরকান্দি গ্রামে। স্কুলটি বগুড়া জেলার অন্যতম সেরা শিক্ষাকেন্দ্র। নদীর আগ্রাসী অবস্থানে এই স্কুলটি আবারও স্থানান্তর করা প্রয়োজন হতে পারে বলে জানালেন প্রধান শিক্ষক তরিকুল ইসলাম। তিনি বললেন, এই স্কুলটি আশেপাশের মানুষের ভরসার জায়গা। দূর-দূরান্ত থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী আসে এখানে। এমনকি বগুড়া শহর থেকেও অনেক অভিভাবক ভালো ফলাফলের আশায় তাদের সন্তানকে এখানে ভর্তি করান। এই বর্ষায় স্কুলে প্রায় এক কোমর পানি উঠেছিল। এভাবে শিক্ষাব্যবস্থা চরম ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এই জনপদের উন্নয়নে অনেক ভূমিকা রেখেছে বলে জানালেন আরেক শিক্ষক আনছার আলী। গ্রামবাসীর অনেককেই নিজেদের বসতবাড়ির চাইতেও এই স্কুল রক্ষার কথা বলতে শোনা গেল বেশি।

কর্নিবাড়ি ফাজিল মাদ্রাসা
সারিয়াকান্দি উপজেলার কর্নিবাড়ি ইউনিয়নের মথুরাপাড়া বাজার আর দেবডাঙ্গা বাজার দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বাজার। ভাঙ্গন কবলিত হয়ে দুটি বাজার এখন  আশ্রয় নিয়েছে একেবারে পাশাপাশি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো বেশ কিছু নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে। ধর্মীয়  প্রতিষ্ঠানগুলোরও একই অবস্থা।  এখন যেগুলো টিকে আছে সেগুলোও বারবার স্থান পরিবর্তন করে এখন শিক্ষার্থী সংকটে।  
চন্দনবাইশা ইউনিয়ন ছিল একসময়ের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা- সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। চন্দবাইশার প্রাচীন নাম ছিল নওখিলা। ১৮৭১ সালে নাটোরের দিঘাপতিয়ার রাজবংশের ষষ্ঠ রাজা প্রমদা নাথ রায় জমিদার প্রমদানাথ রায় চন্দবাইশায় তার নামে একটি জুনিয়র হাইস্কুল (নওখিলা পিএন) ও একটি দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রিটিশ ও জমিদার আমলে এখানে কাচারি বাড়ি স্থাপন করা হয়। শোনা যায় ওই সময় জমিদারদের রাজকোষ ও খাজনা লেনদেন রক্ষার জন্য বগুড়ার মধ্যে এখানেই প্রথম ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ১৮৮২ সালে নওখিলা পিএন জুনিয়র স্কুলকে হাই স্কুলে উন্নীত করা হয়। বগুড়া জেলার প্রাচীনতম পোষ্ট অফিসের একটি হলো জমিদার আমলে চন্দনবাইশায় প্রতিষ্ঠিত পোষ্ট অফিস। জনশ্রুতি আছে প্রাচীন টেলিফোন পদ্ধতির মাধ্যমে চন্দনবাইশার সাথেই প্রথম কোলকাতার যোগাযোগ হয়েছিল। ১৯৬৪ সালে বগুড়া জেলার দ্বিতীয় ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় চন্দনবাইশায়। সব হারিয়ে এই ইউনিয়নের একটি মাত্র মৌজা টিকে আছে সেটি হলো ঘুঘুমারি। ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানগুলো জোড়াতালি দিয়ে এই  ঘুঘুমারিতেই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছ। চন্দনবাইশার অধিকাংশ মানুষ চলে গেছে  বগুড়া জেলার আরেকটি থানা শেরপুর আর ধুনটে। চন্দন বাইশা ছেড়ে ধুনটে বসাবাসকারী শ্রী উজ্জ্বল কুমার বললেন তার আক্ষেপের কথা। ‘আমরা ব্যক্তিগতভাবে কি হারিয়েছে সে হিসেব মেলানোর মতো নয়। অনেক ইতিহাস আর ঐতিহ্য সমৃদ্ধ চন্দনবাইশাকেও নদী গর্ভে বিলীন হতে হলো। এই জায়গাটিকে রক্ষা করা খুবই প্রয়োজন ছিল’ – বলেন তিনি।

মসজিদ আছে, নামাজ পড়ার লোক নেই
সারিয়াকান্দির বিভিন্ন ইউনিয়নের হারিয়ে যাওয়া আরও কয়েকটি গ্রামের মধ্যে রয়েছে  নারাপালা, কাশিয়াহাটা, নান্দিয়ারপাড়া, চিলা পাড়া, শোনপচা। এছাড়াও অনেক গ্রামই যোগাযোগবিহীন। প্রতি বছরই নদী ঠেকাতে বেরি বাঁধ তৈরি করা হয়। এবারও হয়েছে। কিন্তু যমুনাকে রুখবার সাধ্য সেই বাঁধের থাকে না।
কাজলা, চালুয়াবাড়ি, কর্ণিবাড়ী, কুতুবপুর, বোহাইল, কামালপুর- এই  ইউনিয়নগুলো একেবারে যমুনা নদীর তীর ঘেঁষে। কীভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায় শত বছরের বসতি, তারই জলজ্যান্ত নীরব সাক্ষী হয়ে এখনও আংশিকভাবে টিকে আছে এই জনপদ। কুতুবপুর ইউপি চেয়ারম্যান ইমরান আলী রনি আর কর্নিবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান আজহার আলী মণ্ডলের সঙ্গে কথা হয়। আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো তাদেরকেও বেশ বিমর্ষই দেখাল। তবুও আশার কথা শোনালেন। নভেম্বরেই নদীর তীর সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়েছে। এই অঞ্চলের কিছু কিছু জায়গায় গ্রোয়েন তৈরি করে স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে সে জায়গাগুলো টিকে গেছে। তেমনি এক স্থায়ী পদক্ষেপের তীব্র  প্রত্যাশা নিয়ে রাতের ঘুমাতে যান পূর্ব বগুড়ার এই সংগ্রামী মানুষগুলো। হয়তো প্রিয় বসতি ছেড়ে আর সরে যেতে হবে না। হয়তো আর আতংকিত করবে না ভাঙনের নিষ্ঠুর শব্দ।

/এনএ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা