সেদিনই পাহাড়ের উপরে অবস্থিত মন্দির ও রাজা রানির স্নানের জন্য নির্মিত পুকুর দেখতে গেলাম। চট করে কাঞ্চিপুরাম এলাকা ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাংগেলে দেখে ফেললাম। পাহাড় থেকে নামলাম খানিকটা জঙ্গের ভেরত দিয়ে। বনের পাখির কলতানে অতিথি আপ্যায়নটা বেশ হয়েছিল।
নেমেই চোখে পড়ল ‘কৃষ্ণর বাটারবল’। মনে হচ্ছিল একটি বিশাল গোলাকার পাথরখণ্ড পাথুরে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে ধেয়ে আসছে আমার দিকে। আসলে কিন্তু পাথরটি একটুও নড়ছিল না। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বলে পাহাড়ের গায়েই আটকে ছিল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মাখন খেতে ভালবাসতেন। দেবতার কথা স্মরণ করেই এ পাথরটির নামকরণ।
সেখান থেকে দু মিনিটের হাঁটা পথ ‘অর্জুনের প্রায়শ্চিত্ত’ নামক গুহাটি। আস্ত পাথরে তৈরি গুহাটির গায়ের ভাস্কর্যে দেবদেবীসহ সাধারণ মানুষের বন্দনার চিত্র ফুটে উঠেছে।
পুরাকথা বলে, দেবতা অর্জুনকে বধ করতে অসুর যখন একটি বরাহ প্রেরণ করে সেই মুহূর্তের শিবঠাকুর এক সাধারণ শিকারীর বেশে আসেন অর্জুনকে রক্ষা করতে। শিবঠাকুর এবং অর্জুন একই সাথে বরাহটিকে বধ করেন এবং দুজনে রণে লিপ্ত হন নিজের সৌর্য সমুন্নত রাখতে। রণে অর্জুনের পরাজয় ঘটে এবং শিবঠাকুর নিজ অবতারে ফিরে আসেন। শিবঠাকুরকে দেখে অর্জুন ভীষণ অনুতপ্ত বোধ করেন। শিবঠাকুর অর্জুনকে বর স্বরূপ তার অস্ত্রটি দেন। এই কাহিনীটি বিভিন্ন আঙ্গিকে গুহার ভেতরের এবং বাইরের দেয়ালে খোদাই করা আছে।
পুরাকীর্তি দেখতে দেখতে বিকেল হতে চলল। খাবার কথা মনে নেই। আমি ভোজন বেরসিক মানুষ। তবুও কিছু তো খেতে হয়ই। ভারতীয় সামুদ্রিক খাবারের খোজ পেলাম এক রেস্তোরাঁতে। সেখানেই দুপুরের খাবার সেরে ছুটলাম মহাবালিপুরাম সমুদ্রসৈকতে যা আমার কটেজের সামনেই।
যতদূর চোখ যায় সৈকত ধরে হাঁটলাম। যখন ক্লান্ত হলাম তখন কটেজে গিয়ে বারান্দায় বসে সোনালি তটে সাফেদ ঢেউয়ের মাতামাতি দেখলাম।
আহ কি গর্জন! আর কী ঠাণ্ডা বাতাস! দূরে জেলেরা ততক্ষনে সাগরের উত্তাল ঢেউ সামলে মাছের নেশায় মাঝসাগরে মত্ত।
এখানে বসে বসে দিনরাত শুধু সাগর দেখা যায়। অশান্ত সাগর আর উদ্দাম জলরাশি তার।
কটেজটি ফিশারম্যান ভিলেজ বা জেলেদের গ্রামের মধ্যে। আমাদের দেশে গ্রাম বলতে যা বোঝায় তা নয়। প্রত্যেকটি বাড়ি পাকা একতলা অথবা দোতলা আর সবার ঘরেই টিভি ফ্রিজ আছে, সব বাচ্চারা স্কুলে যায়। রাস্তাঘাটও পাকা। জেলেরা বিকেলে মাছ ধরতে যায় গহীন সাগরে। দিনে জাল বুনে, বসে আড্ডা দেয় করে বা ঘুমায়। সাগরপাড়ের জায়গাগুলো হোটেল মালিকেরা কিনে নিয়েছে। পেছনের জায়গা গুলোতে জেলেদের সুখের আবাস।
মহাবালিপুরামে দ্বিতীয় দিন। খুব ভোরে উঠলাম সূর্যোদয় দেখার জন্য। আমার বারান্দা থেকেই। সুয্যিমামা তার লালিমা ছড়াতেই চলে গেলাম ‘সমুদ্রতটের মন্দির’ দেখতে।
দক্ষিণ ভারতের সব মন্দির দ্রাবিড়ীয় স্থাপত্যকলায় নির্মিত। যার বৈশিষ্ট্য মূল মন্দিরের চারপাশ ঘেরা উঁচু প্রাচির, বিশাল আকৃতির প্রবেশ দ্বার, যাকে বলা হয় গোপুরা এবং যার মাথায় রয়েছে পিরামিড আকৃতির নির্মান শৈলী, মন্দির প্রাঙ্গণে পুকুর যাকে বলা হয় কল্যাণী, মূল মন্দিরের চূড়ার পিরামিডাকৃতি ইত্যাদি।
সাতশ’ শতাব্দীতে সমুদ্রতটে সাতটি মন্দির নির্মিত হয়েছিল। এখন একটি মাত্র মন্দির মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বাকিগুলো প্রকৃতির তাণ্ডব ও আবহাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে। মন্দিরটি একপ্রস্তরশিলা বা একটি আস্ত পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। মহাবালিপুরামের সব মন্দিরই পুরাকালে আস্ত পাথর খণ্ড থেকেই তৈরি।
সমুদ্রতটের মন্দির দেখে চললাম ‘পঞ্চরথ’ দেখতে। পঞ্চপাণ্ডবের স্মৃতিতে নির্মিত এই মন্দিরে পাঁচটি আলাদা মন্দির পাশাপাশি অবস্থিত। তার সঙ্গে আছে একপ্রস্তরে নির্মিত গজ।
পঞ্চ রথ দেখে হাটতে হাটতে ফিরছিলাম পাথরে খোদাই করা মূর্তি, শো পিস ইত্যাদির সারি সারি দোকানের সামনে দিয়ে। কিনে ফেললাম ঐতিহ্যবাহী লাল মার্বেল আর গ্রানাইট পাথরে সূক্ষ্ম কারুকার্যময় দুটো শো পিস আর কয়েকটা সাদা, লাল মার্বেল পাথরে খোদাই করা ক্ষুদ্র পেন্ডেন্ট। মহাবলিপুরামের ঐতিহ্যবাহী খোদাই করা শো পিসের খ্যাতি সারা ভারতজুড়ে। তাই স্মৃতি হিসেবে কিনে নিয়ে যেতে ভুলবেন না যেন।
ফিরে এসে বাকি সময় সাগর পাড়ে কাটালাম। অন্যান্য সমুদ্রসৈকত থেকে ভ্রমনার্থী কম থাকার কারণে সাগর দেখার আনন্দ আলাদা। জেলেরা জাল বুনছে বা নৌকা ঠিকঠাক করছে খানিক বাদেই যে সাগর পাড়ি দিতে হবে। কয়েকজন জেলের সাথে কথা হল। নাইলনের পাতলা দড়ি দিয়ে যে জালটা বুনছিল সেটা পমফ্রেট মাছ ধরার জন্য আর মোটা দড়ি দিয়ে যে জালটা বুনছিল সেটা টুনা মাছ ধরার জন্য। অনেক জেলেই ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন। এখানকার মোটামুটি সবাই ইংরেজি বোঝেন এবং বলতে পারেন তাই দর্শনার্থীদের অসুবিধা তেমন হয়না। সবচেয়ে বন্ধুবৎসল জেলেটির নাম পরিমল। আরও যারা ছিলেন তারা মুরগান, বালা, শক্তি।
আমার তৃতীয় এবং শেষ দিন মহাবালিপুরামে। পুরাকীর্তিগুলোকে আরো দৃঢ়ভাবে মনের খাঁচায় বন্দি করে রাখার জন্য আধবেলা পথের সাথে বন্ধুত্ব করলাম। বাকি আধাটা দিন কাটিয়ে দিলাম ক্রুদ্ধ অথচ শীতল পবন দানকারী করমণ্ডল উপকূলে। সাগরপাড়ের অনিন্দ্য সৌন্দর্য ফেলে যাবার ইচ্ছে একেবারেই ছিলনা, তবুও অন্য আরেক অচেনা গন্তব্যের টানে বিদায় জানালাম এই পুরাকীর্তির অল্প চেনা আর বেশি বন্ধুত্ব হয়ে যাওয়া স্থানটিকে।
কীভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে কোলকাতা বাস, ট্রেন বা বিমানে যাতায়াত করা যায়। কোলকাতা থেকে চেন্নাই যাবার জন্য ট্রেনের ( ভ্রমন সময় ২৬-২৮ ঘন্টা ট্রেন ভেদে) ভাড়া ৬৫০-৪৫০০ রূপি (এসি, নন এসি ইত্যাদি ভেদে) ওয়ান ওয়ে। বিমান(ভ্রমন সময় ২ ঘন্টা কোলকাতা থেকে) ভাড়া ৩০০০ রূপি থেকে শুরু ওয়ান ওয়ে, তবে চাহিদা এবং লভ্যতা অনুসারে যে কোন রূটের বিমান ভাড়া কম বেশি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
মহাবালিপুরামে সব ধরনের হোটেল পাওয়া যাবে, বাজেট থেকে শুরু করে সাত তারা। অনলাইনে ভিসা অথবা মাস্টার কার্ড ব্যবহার করে টাকা পরিশোধ করে সহজেই যে কোন মানের হোটেল রুম বুকিং দেওয়া যায়। হোটেল বুকিং করা না থাকলে, সেখানে গিয়েও পছন্দমত হোটেল পাওয়া যায়।
/এফএএন/