X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

ফ্যাশনে ঐতিহ্য সংরক্ষণের শপথ

শেখ সাইফুর রহমান
১৪ এপ্রিল ২০১৭, ১৪:০০আপডেট : ১৪ এপ্রিল ২০১৭, ১৪:০০
image

আজ পহেলা বৈশাখ। সকাল থেকেই শুরু হয়েছে আবালবৃদ্ধবনিতার নব আনন্দে জাগার পালা। নতুন বসন, বিচিত্র অশন উৎসবকে দিয়েছে মাত্রা।
মানুষের সভ্যতার সূচনায় দুটো বিষয় সংযুক্ত হয়েছিল: অশন আর বসন। আজও সেই ধারা বৈচিত্র্যের অনন্যতায় অব্যাহত রয়েছে। পৃথিবীর সব দেশেই এই দুটো উপাদান ছাড়া উৎসব অচল। উদযাপন ম্লান। বাঙালিও এর বাইরে নয়। বরং অন্যদের চেয়ে বাঙালির উচ্ছ্বাস আরও বেশি। আবেগ টইটম্বুর। উদযাপন তাই প্রাণময়।
উৎসবরে সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ঐতিহ্য। পরিভাষায় বলি ট্র্যাডিশন। নববর্ষ আবাহনেও সেটা বিলক্ষণ বিদ্যমান। কিন্তু কেন যেন আধুনিকতার নামে, নিরীক্ষার নামে অনেক কিছু উপাদান অনাবশ্যকভাবে সম্পৃক্ত করে মূলকে বিনষ্ট করার খেলায় মেতেছি আমরা। কিংবা বলা চলে সরে যাচ্ছি মূল কেন্দ্র থেকে। তাতে করে নষ্ট হচ্ছে ট্র্যাডিশন; নতুন প্রজন্ম আসল বিষয় অনুধাবনে ব্যর্থ হচ্ছে। আমরা তাদের দ্বিধাগ্রস্ত করে দিচ্ছি।

বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসের এ বছর এবং গত বছরের বৈশাখী আয়োজন
আসলে নববর্ষ উদযাপনে ধর্ম নয়, সংস্কৃতিই মূল। সংস্কৃতির সঙ্গে থাকে ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, রীতি-নীতি। ফলে সব মিলেই তৈরি হয় পোশাক সংস্কৃতি। পোশাক কিন্তু কেবল বাঙালিয়ানা জাহির করার জন্য নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এ দেশের বয়ন ঐহিত্যকে টিকিয়ে রাখার লড়াই। দেশের মর্যাদা, আর সমৃদ্ধ সংস্কৃতির গৌরবকে সমুন্নত রাখার প্রয়াস।

ঐতিহ্যগতভাবে বাঙালি এই উৎসবে দুটো রং গ্রহণ করেছে। কিন্তু ইদানীং নিরীক্ষার নামে নকশার অভিনবত্বের স্খলনটা বড্ড বেশি দৃষ্টিকটু। বসন্তের রং নিশ্চয়ই বৈশাখে কাম্য নয়। কিংবা সারা বছরের আন্তর্জাতিক রং নিদের্শনা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের বৈশাখকে মাথায় রেখে করা হয় না। সেই অবস্থানে তো আমরা আমাদের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে উন্নীত করতে পারিনি। তাই বর্তমানে ডিজাইনের দোহাই দিয়ে লাল আর সাদার সঙ্গে হেন রং নেই যে ব্যবহার করা হচ্ছে না! এমনকি কালো, নীল আর সবুজও। পারলে পুরো প্যানটন চার্টকেই তুলে দেওয়া হয়! অনেকেই তর্কের খাতিরে বলতে পারেন লাল-সাদা তো একঘেয়ে লাগবে। এই বিষয়টি আসলে মানা যায় না। কারণ, এটা নির্ভর করে আমি কিভাবে বর্ণবিন্যাস করছি তার উপর। গুচ্ছির রং কাপড়ের উপর ঢেলে দিয়ে সেটাকেই দারুণ ডিজাইন হিসাবে সাব্যস্ত করার চেষ্ট চলছে।
এখানে একটু বলে রাখা প্রয়োজন, সারা বিশ্বেই মানুষের পোশাক-রুচি তৈরি করেন ডিজাইনাররা। আমাদের দেশেও তার ব্যতিক্রম নয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ফ্যাশন হাউজগুলো যা দিচ্ছে সবাই সেটাই কিনছে। বিশেষ করে তরুণদের রুচি এভাবে তৈরি হয়ে যাচ্ছে। তারা জানছে না, কিংবা জানলেও পাত্তা দিচ্ছে না ঐতিহ্যকে। এই জায়গায় ফ্যাশন হাউজগুলোর গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এসেছে। ঐতিহ্যকে ধরে রাখার দায় তাদেরও। তার একটা বিষয় হলো, লাল আর সাদায় একঘেয়েমি দূর করতে হলেও কিন্তু তাদের আরও বেশি নিরীক্ষাপ্রবণ হতে হবে। ধর তক্তা মার পেরেক ধরনের হলে চলবে না। তবেই লাল-সাদায় নান্দনিকতা আসবে, অনবদ্য হবে। হাজারো ফ্যাশন হাউস থাকতেই পারে। আছেও। সবাই তখন লাল-সাদা নিয়ে কাজ করলেও নকশা মিলবে না।
ঠিক এই জায়গায় কাজ করার যথেষ্ট অবকাশ থেকেই যাচ্ছে। কারণ বেশিরভাগ হাউসগুলোর কাজ দেখে সত্যিকার অর্থেই বোঝার উপায় থাকে না কোনটা কার পোশাক। এখান একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, একেবারেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। একবার একটি পত্রিকার পোর্টফোলিও শুটে একটি ফ্যাশন হাউজ পাঞ্জাবি পাঠিয়েছে। সেটা দেখে আমার মনে হলো এই ধরনের নকশা তো পুরনো একটি হাউসের সিগনেচার স্টাইল। যারা কাপড় পাঠিয়েছে সেখানে তখন ডিজাইন বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন অনুজপ্রতিম এক ডিজাইনার। তাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করতে জানাল, আসলে ঐ হাউস থেকে একজন ডিজাইনার এসে জয়েন করেছে; এগুলো তারই কাজ।

শান্ত-মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত ফ্যাশন শোয়ের ছবিটি গত বছরের

এক্ষেত্রে যেটা সবচেয়ে আগে মাথায় আসে তা হলো ব্র্যান্ডিং এবং বিপণনের মৌলিক কিছু বিষয় আছে। যেগুলো আমাদের এখানে একেবারেই মানা হয় না। ব্র্যান্ড পারসোনালিটির বিষয়টি আমাদের ফ্যাশন হাউসগুলো মাথাতেই রাখে না। নেই তাদের ব্র্যান্ডি পজিশনিং, আর ইউনিক সেলিং পয়েন্ট নিয়ে মাথাব্যথা। তাদের কর্মকাণ্ড অনেকটাই অবৈজ্ঞানিক। প্রকৃতপক্ষে তাদের নেই ব্র্যান্ড গাইডলাইনও। অথচ অন্য কোন হাউস থেকে কোন ডিজাইনার আসলে, ফ্যাশন হাউসের প্রথম কাজই হবে কম্পিউটার ধরার আগে ব্র্যান্ড গাইডলাইন মুখস্থ করানো। তার মাথা থেকে পুরনো ভূত তাড়ানো। তাহলেই তার পক্ষে সম্ভব নতুনভাবে চিন্তা করা। নতুন সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ হওয়া। কিন্তু তা হচ্ছে না। দীর্ঘদিন এই সেক্টরে সম্পৃক্ততার কারণে পুরনো আর নতুনকে প্রায়শই পার্থক্য করতে কষ্ট হয়।
ডিজাইন প্রসঙ্গে বলতে হয়, ইন্টারনেট আমাদের ডিজাইনারদের অনেক সুবিধা করে দিয়েছে। তারা এখন নিজেদের মাথা খাটানোর চেয়ে কপি আর পেস্টে অধিক দক্ষ। এক্ষেত্রে কখনো কখনো হাউসগুলোই এর জন্য দায়ী। তারা অনেক সময় প্রত্যক্ষভাবে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। কখনোবা পরোক্ষ ভাবে। যেমন কোনও কোনও হাউস প্রতিদিন এত বেশি সংখ্যক ডিজাইন একজন ডিজাইনারের কাছ থেকে নেয় যে, তার আর দ্বিতীয় চিন্তার অবকাশ থাকে না। তখন তার মুশকিল আসান করে ইন্টারনেট। আবার যেখানে এই চাপ নেই, সেখানে হয়তো ডিজাইনাররা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সবার সব ডিজাইনের উৎস সন্ধান সম্ভব নয়। তাই কপি-পেস্টের দায় শেষ পর্যন্ত বর্তায় প্রতিষ্ঠানের উপর। কখনো কখনো সেই মাশুলটা একটু চড়া হয়ে যায় বৈকি। এজন্য ডিজাইনারদের সততাও প্রয়োজন আছে। এই কপি-পেস্টের একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। বছর তিনেক আগে একটি ব্রাইডাল পোর্টফোলিওর পোশাক এসেছে। সেখানে ছেলেদের শেরওয়ানি পাঠিয়েছে অনেক হাউজ। এর মধ্যে দুটো হাউজের শেরওয়ানি হুবহু এক। দুটোই শীর্ষস্থানীয়। নামও আছে। একটা তুলনায় বড়, একটা একটু ছোট। পরে দেখা গেল দুটোই কপি করা হয়েছে ভারতীয় একটি ডিজাইনারের শেরওয়ানি থেকে! ক্রেতার পক্ষেও কিন্তু সেটা সবসময় ধরা সম্ভব হয় না। এটা শুধু ফ্যাশন ডিজাইনাররাই করছেন তাও নয়।

‘আরটিভি-লাক্স লুকঅ্যাটমি ফ্যাশন রানওয়ে-২০১৬’ এর ছবি
আবার এটা যে শুধু আমাদের এখানেই হচ্ছে, অন্যরা করছে না ব্যাপারটা এমনও না। ভারতীয় উপগ্রহ চ্যানেলগুলোর সিরিয়াল বা রিয়েলিটি শো, একটু খুঁটিয়ে দেখলে চোখ এড়াবে না তাদের কস্টিউম। মিল পাবেন আমাদের অনেক ফ্যাশন হাউস বা ডিজাইনারের কাজের সঙ্গে। কখনো মোটিফ মিলে যায়, তো কখনো লে আউট। তারা আমাদের ডিজাইনারের খোঁজখবর বেশ রাখেন। পাইরেসি এভাবেই হয়। সারা বিশ্বেই হয়। আরমানি থাইল্যান্ড, ব্যাংককে কপি হয়। এগুলো থাকবে। কিন্তু আরমানিকে ভারসাচি কপি করে না। আমাদের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির কাছে চাওয়া আসলে এটাই।
আরও একটা বিষয়, বৈশ্বিক ফ্যাশন এখন অনেক বেশি উদার। কোনও কিছু এখন আর পুরনো হয় না। নতুনের সঙ্গে গলাগলি করে চলে। তাই পশ্চিমে আঁটসাঁট পোশাকের চল চলে গেলেও ঢিলেঢালা পোশাকের সঙ্গে এখনও রয়ে গেছে। কিন্তু আমরা এখনো সেই পুরনোতেই আছি। আবার আমাদের অবস্থা আরও খারাপ। সেই নববইয়ের দশকে কোন ফ্যাশন হাউস যা করেছিল আজও তা খুঁজলেই পাওয়া যাবে। তিন-চারটা মিডিয়া ব্যবহার করে পোশাকের জমিন অলঙ্করণ। এটাই প্রমাণ করে আমাদের গবেষণার দৈন্য।
একটু নতুনত্ব দিতে প্রয়োজন গবেষণা। সেজন্য লাগবে সময় আর ব্যয় করতে হবে কিছুটা অর্থ। তবে প্রতিদান কিন্তু অনেক বেশি হবে। এখন ফ্যাশন উদ্যোক্তাদের সংগঠন আছে। আছে ডিজাইনাদের সংগঠন। তাদের এ ক্ষেত্রে আরও সংঘবদ্ধ হতে হবে। তবেই বৈচিত্র্য আসবে। ক্রেতা পাবে নতুনত্ব। নচেৎ সবই একঘেয়ে হয়ে যাবে। আর ফ্যাশন বহতা স্রোতের মতোই। সেই স্রোতে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন মুন্সিয়ানা। গবেষণা ও তার রূপায়নের সঙ্গে সমান সহাবস্থান প্রয়োজন বিপণন প্রক্রিয়া আর ব্র্যান্ডিংয়ের। এই বৈশাখে কিন্তু তিন বিষয় আমার অন্তত সেভাবে চোখে পড়েনি গোটা ইন্ডাস্ট্রিতে। সেটাই ভাবার।
ঈদ সামনে। অনেক বড় বাজার। এনিয়ে এখনই ভাবা প্রয়োজন বলেই আমার মনে হয়। নিশ্চয়ই উদ্যোক্তারা এ নিয়ে ভাববেন।

বাংলা নতুন বছরের আবাহনে আমাদের শপথ হোক দেশীয় ফ্যাশন ইন্ডাষ্ট্রিকে সঠিক পরিকল্পনায় সুসংগঠিত করে আগামীর পথে পা বাড়ানো। আর অবশ্যই সৃজনের নামে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানো নয়, ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখাও হবে আমাদের শপথ। শেষ করতে চাই দুই মহান ব্যক্তিত্বের দুটো উদ্ধৃতি দিয়ে। বিখ্যাত ইংরেজ কথাসাহিত্যিক সমারসেট মম বলেছেন- ঐতিহ্য হলো নির্দেশনা, কারারক্ষী নয়। আর অস্ট্রিয়ার রোমান্টিক কমপোজার গুস্তাভ মাহলার বক্তব্য- ঐতিহ্য ভস্মের উপাসনা নয়, বরং আগুনের সংরক্ষণ।
সবাইকে বাংলা নববর্ষের আন্তরিক শুভকামনা।

লেখক: নিউজ এডিটর, এটিএন নিউজ ও ফ্যাশন কলামিস্ট

/এনএ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষে বাস উঠে পড়লো রেললাইনে, ট্রেন থামিয়ে যাত্রীদের উদ্ধার
ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষে বাস উঠে পড়লো রেললাইনে, ট্রেন থামিয়ে যাত্রীদের উদ্ধার
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি
চুরি করা গরুসহ ট্রাক থামিয়ে পালিয়ে যায় চোরেরা, আগুন ধরিয়ে দিলো জনতা
চুরি করা গরুসহ ট্রাক থামিয়ে পালিয়ে যায় চোরেরা, আগুন ধরিয়ে দিলো জনতা
বাংলাদেশ সফরের জিম্বাবুয়ে দলে অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেলের ছেলে
বাংলাদেশ সফরের জিম্বাবুয়ে দলে অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেলের ছেলে
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…