X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

রোমাঞ্চকর এক সমুদ্রযাত্রা

সৈয়দ খালেদ সাইফুল্লাহ্‌
২৪ এপ্রিল ২০১৭, ১৬:৪৩আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০১৭, ১৭:০১
image

ফিলিপাইনে এসেছি সপ্তাহখানেক। দুই ভাই মিলে। ছোট ভাই চলে যাবে, আর আমি ব্যবসায়িক কাজে এখানেই থেকে যাব।
ব্যবসা করতে এসেছি, তাই বলে কেবল গম্ভীর মুখে লাভক্ষতির অংক করার মানে হয় না! সেদিন ছিল তাই সাগর দেখার মহাযজ্ঞ। রাজধানী ম্যানিলা থেকে ঘণ্টা আড়াইয়ের পথ, তেরানতে সি বিচ।
সাগরের কথা শুনেই দুই ভাই ঠোঁট উল্টালাম। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সি-বিচ উল্টে-পাল্টে এলাম, আর আমাদের দেখাবে কীনা এই দক্ষিণ চীনা সাগরের বিচ! এমনকি সাগর দর্শনের জন্য যে হাওয়াই শার্ট-টার্ট পরতে হয়, সেটাও বাদ দিয়ে আমরা পরলাম টিশার্ট-কেডস-জিনস।
আমাদের সফরসঙ্গী ফিলিপাইনের একজন প্রবাসী বাঙালি। আপাতত তার জিম্মাতেই আমরা আছি। যাওয়ার আগে ভদ্রলোক বললেন, পাসপোর্ট কোথায় আপনাদের? আমি বললাম, পকেটে। ‘উঁহু এই জায়গায় পাসপোর্ট নিয়ে যাওয়ার কোনও দরকার নেই। ঘরের মধ্যে ড্রয়ারে রেখে যান’- বললেন উনি। ওরেব্বাবা! পাসপোর্ট রেখে যাওয়ার জন্য এত কড়াকড়ি? সমস্যা হবে নাকি? ভালো করে মুড়ে পাসপোর্ট ভদ্রলোকের হাতে দিলাম। সুন্দর করে ড্রয়ারে রেখে তিনি আমাদের নিয়ে বের হলেন।

স্বচ্ছ জলের সাগর
ভোরের ম্যানিলা। চারদিকে কর্মজীবীদের চঞ্চলতা মাত্র শুরু হয়েছে। এখানে ওখানে খাবার দোকানে গরম গরম ভাতের ধোঁয়া দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ফিলিপিনোরা পারলে পাঁচবেলা ভাত খায়!
গাড়িতে উঠে  আমি ভদ্রলোককে বললাম, ‘সাগরের আর দেখেছেন কী? বাংলাদেশে আমি একবার...’ কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে ভদ্রলোক শুকনো গলায় বললেন, একটা ভুল হয়ে গেছে! বললাম, কী ভুল? আমি নিজের পাসপোর্ট রেখে আসতে ভুলে গেছি! জানালেন তিনি। আমি গা করলাম না। পাসপোর্ট সাথে নিয়ে ঘোরার কারণে এত উতলা হওয়ার কী আছে? সাপ-বিচ্ছু তো আর পকেটে নিয়ে ঘুরছে না!

ফিলিপাইনের রাস্তা-ঘাট নখের পিঠের মতো মসৃণ। সাঁই সাঁই করে বহুক্ষণের যাত্রা শেষে সাগরের দর্শন মিললো। আহা কী অপূর্ব! অনেক নিচে সবুজ টলটলে সাগর। প্রবালের কারণে এই সবুজ রং। আর অটল প্রহরীর মতো এর মাঝে দাঁড়িয়ে আছে আকাশ ছোঁয়া পাহাড়। আমি আনমনে বললাম, ‘বাংলাদেশে একবার কী হয়েছিল জানেন?’

ভদ্রলোক বললেন, চলেন আগে নিচে যাই। বোট রাইডিং করে কয়েকটা দ্বীপ দেখে ফেলি। এইখানে কেবল সি-বিচে কেউ বসে থাকে না। স্কুবা ডাইভিং করে, কেউ সাঁতরায়, কেউ দ্বীপ দেখতে যায়।
বাংলাদেশের সাগর নিয়ে আমার বীরত্বগাঁথাটা সেই বোট রাইডিংয়েই জমিয়ে বলে ফেলার চিন্তা করছিলাম। কিন্তু  'বোট' দেখে চুপসে গেলাম! আমাদের খালে-বিলে পুঁটি মাছ মারতেও এর চেয়ে বড় ডিঙি নৌকা ব্যবহার করা হয়! এই নৌকা দিয়ে আমরা সাগর পাড়ি দেব?
আমার চুপসে যাওয়া চেহারা দেখে ভদ্রলোক উৎসাহ দিয়ে তাড়াতাড়ি বললেন, ‘আরে এতো ভয়ের কিছু নেই। দেখেন দুইদিকে দু'টা ডানা আছে। ব্যালান্স রাখার জন্য।’

সাগর পাড়ি দিতে হবে এই নৌকা দিয়ে!

ডানা মানে দুইদিকে দু'টা বাঁশ আড়াআড়ি রাখা! সমুদ্রের জলে ছপাস ছপাস বাড়ি খাচ্ছে। এমন পক্ষীরাজের মতো ডানা দেখে আমি আরও চুপসে গেলাম।
আমাদের জিন্স-টিশার্ট দেখে স্থানীয় মাঝি চোখ কপালে তুলে ফেলেছে। হোয়ার ইজ শর্টস? হোয়ার ইজ শর্টস? কী যন্ত্রণা! ফুটবল খেলতে নেমেছি নাকি? সমুদ্রে জিন্স পরে নামবো নাকি জোব্বা পরে নামবো আমার ব্যাপার!
শেষ পর্যন্ত মাঝির জেদের জয় হলো। আমরা কেডস খুললাম। পঞ্চাশ পেসোতে শর্টস ভাড়া পাওয়া যায়। শর্টস পরলাম। তারপর ডানাওয়ালা পক্ষীরাজে নিজেদের কষ্ট করে ঢুকিয়ে ফেললাম।
এই পলকা নৌকা অনেকটা কাশ্মীর অঞ্চলের শিকারার মতো। আমরা তিনজন আর মাঝি বসার পরে মোটামুটি আমার কোমর আর নৌকার বাইরের পানি এক লেভেলে চলে এলো। আমাদের দেশে বালির ট্রলারের শুধু ধোঁয়া বের হওয়্যার মাথা দেখা যায়। ভয় হলো আমাদেরও না সেই অবস্থা হয়!

নৌকা ভেড়ানো হয়েছিল দ্বীপে
মোটর স্টার্ট দেওয়ার সাথে সাথে পান্নার মতো সবুজ পানিতে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। অবশ্য যাত্রা না বলে সিন্দাবাদের জাহাজ পাড়ি দেওবার কথা বললে বরং বেশি মানায়! পানির ধাক্কায় কোমর পর্যন্ত ভেসে যাচ্ছে। প্রকাণ্ড ঢেউ ঘাড়ের পেছনে ধাক্কা মারছে। দুই-তিনবার পানি মাথার ওপর দিয়েও চলে গেল!  
নৌকার সামনে আমি বসে ছিলাম। সাকিব আমাকে অভয় দেওয়ার জন্য বললো, বড় ঢেউয়ে ডুবে গেলে কোনও ভয় নেই ভাইয়া। নৌকা শক্ত করে ধরে রাখো, অটোমেটিক একটু পরে ভেসে উঠবা।

তার অভয় পেয়ে আমি হাসার চেষ্টা করলাম। হাসি বের হলো না। মন অন্যদিকে সরানোর জন্য বললাম, সাগরে কী করেছিলাম একবার জানেন? বাংগ্লললস... খক খক খক। প্রবল ঢেউয়ের ধাক্কায় মুখের মধ্যে পানি ঢুকে গেছে! কাশি শুরু করলাম।

এরমধ্যে ভদ্রলোক আমাদের ফিলিপিনো মাঝিকে বললেন, সাবধানে চালাও বাপু একটু। আমার ব্যাগে পাসপোর্ট আছে। এটা গেলে সব শেষ!

বলার সাথে সাথেই সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপারটা ঘটে গেল। ব্যাগের ফিতা বাতাসের ঝাপটায় উড়ে গিয়ে পড়লো বোটের ফ্যানে। ফররর আওয়াজ তুলে ব্যাগ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল! ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলে থেমে গেল ফ্যান!

আমি শুধু দেখলাম নৌকার খলুয়ে পুঁটি মাছের মতোই এপাশ থেকে ওপাশ পানিতে দৌড়াদৌড়ি করছে পাসপোর্ট। আর দস্যি ছেলের মতো সেটা ধরার জন্য হুটোপুটি লাগিয়ে দিয়েছেন ভদ্রলোক আর সাকিব! নৌকার মাথায় বসে আমি আর নড়লাম না। নৌকার ব্যালান্স হারাতে পারে।

স্মরণীয় যাত্রা শেষে আবারও বিচে...

ভেজা পাসপোর্ট হাতে পেয়ে ভদ্রলোক মাথা চাপড়ানো শুরু করেছেন। আর হতবুদ্ধি হয়ে বসে আছে ফিলিপিনো মাঝি। মধ্য সাগর। দুরন্ত ঢেউ যেন ছেলেখেলা করছে। খোলামকুচির মতো এদিক ওদিক করছে নষ্ট হওয়া নৌকা! ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশন আর কাকে বলে!
অনেক সাধ্য-সাধনা, নৌকার গায়ে হাত বুলানোর পর ইঞ্জিন ক্ষীণ স্বরে আওয়াজ করে উঠলো। সম্ভবত দক্ষিণ চীন সাগরের হাঙরেরা সেদিন কোনও পাপ করেছিলো। তাই  তাদের ভুরিভোজটা আর সেদিনের মতো হলো না!
দ্বীপ দেখার সাধ মিটে গেছে! পরিত্যাক্ত একটা দ্বীপে নৌকা ভেড়ানো হলো। ভদ্রলোক ভালোমতো তার পাসপোর্ট দেখে আশ্বস্ত হলেন। নৌকাটাও কোনওমতে ফেরার জন্য মেরামত করা হলো। নির্জন দ্বীপে পা রেখে যথারীতি আর দশটা বাঙালির মতো নিজেকে রবিনসন ক্রুসো ভেবে রোমাঞ্চিত হলাম!

কোনওভাবে বিচে ফেরার পর ভদ্রলোক বললেন, কী যেন বলছিলেন বাংলাদেশের সাগরের কথা?

ক্লান্ত আমি চোখ বুঁজে বললাম, বাদ দেন! বরং এখন থেকে বলবো, ফিলিপাইনে একবার সাগরে কী হয়েছিলো জানেন?

/এনএ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়