X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

জল্লাদখানা স্মৃতিপীঠের গল্প

ফারুখ আহমেদ
৩০ মে ২০১৭, ১২:২০আপডেট : ৩০ মে ২০১৭, ১৩:৫২
image

ইচ্ছে ছিল এ বছরের স্বাধীনতার মাসে যেসব এলাকায় গণহত্যা হয়েছে, সেসব এলাকা একবার ঘুরে আসবো। আমি যুদ্ধ করিনি তবে আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বাবার সঙ্গে খুব বেশি সখ্য না থাকায় তার কাছ থেকে যুদ্ধের গল্প সেভাবে শোনা হয়নি। তবে পরবর্তীতে যুদ্ধের কথা জেনে মনে হয়েছে যুদ্ধ না করতে পারা জীবনের সেরা অপূর্ণতা।

একদিন বেরিয়ে পড়লাম মিরপুরের পথে। এখানে রয়েছে দশটি বধ্যভূমি। মুসলিম বাজার, কালাপানি, আলোকদি, শিয়ালবাড়ি, রাইনখোলা, সারেংবাড়ি, শিরনিরটেক, গোলারটেক, বাংলা কলেজ আর জল্লাদখানা। আমার গন্তব্য জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠ। 

দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে মিরপুরে যাতায়াতের একটি মাত্র রাস্তা ছিল। গুলিস্তান থেকে বাসে তখন কল্যানপুর শ্যামলী হয়ে তারপর মিরপুর যেতে হত। মিরপুর দশ-এগারো বা বারো যেতে হত মিরপুর এক এর ওপর দিয়ে। সে সময় মুড়ির টিন নামের একটি বাস চলতো। অবশ্য মুড়ির টিন নামটি জনসাধারণের দেওয়া! আর এসব বাসের সঙ্গে দোতলা বাস চলতো খুব। বর্ষাকালে বাস চলাচল বন্ধ না হলেও হতো বাধাগ্রস্ত। এ পথের কিছু অংশ সে সময় বন্ধ হয়ে যেত। শুনেছি তখন শ্যামলী থেকে কল্যানপুরের মাঝের অংশ নৌকায় পার হতে হতো।

মিরপুর দশে এসে বেনাসরি পল্লীর এক নম্বার ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। ডানে বামে বিশাল বিশাল সব অট্টালিকা, শাড়ি কাপড় থেকে হার্ডওয়ার ও মনোহরি দোকানসহ কত কী! কিন্তু পথ খানাখন্দে ভরা। সে ভাঙ্গাচোরা পথ পেরিয়ে জুট বাজার। তার ঠিক পাশেই জল্লাদখানা স্মৃতিপীঠ। জল্লাদখানা স্মৃতিপীঠ প্রবেশ পথের একপাশে লেখা- ‘কান পেতে শুনি কী বলতে চাইছে বধ্যভূমি।’ অন্যপাশে লেখা- ‘একাত্তরের গণহত্যা ও শহীদদের কথা বলবে শতকন্ঠে জল্লাদখানা স্মৃতিপীঠ।’ মূহুর্তে আমার শরীরে শিহরণ খেলে যায়। ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করলাম।

জল্লাদখানা স্মৃতিপীঠ- ১
নজরুল সংগীত শিল্পী এম এ মান্নান আমার গানের শিক্ষক ছিলেন। তখন আমি বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে নজরুল সংগীত শিখি। সে সময় মান্নান স্যার বিজয় দিবসকে সামনে রেখে আমাদের শেখালেন, ‘মিরপুরে আর কাঁটাসুর বুড়িগঙ্গার ধারে/ নদী নালা খাল-বিল আর হাজারো প্রান্তরে/ বলনা মাগো ছড়িয়ে কেনও অজস্র কঙ্কাল।’ দেশের গান খুব আবেগ দিয়ে গাইতাম, কিন্তু গানের কথায় ঠিক ততোটা ধ্যান ছিলনা। তবে অজস্র কঙ্কালে এসে সেদিনও  থমকে যেতাম, যেমন এখনও যাই। তারপর দিনে দিনে অজস্র কঙ্কালের মর্মার্থ বুঝলাম। জল্লাদখানা স্মৃতিপীঠের ভেতর প্রবেশ করে আমি কিছু সময় যেন হতবিহ্বল অবস্থায় ছিলাম। তারপর নিজেই শুনি নিজের ফিসফিসানি। শুনে অবাক হই। যেন অদৃশ্য থেকে ভেসে আসছিল শহীদদের আর্ত চিৎকার।

জল্লাদখানা স্মৃতিপীঠ- ২

আমার মনে হচ্ছিল আমার চারদিকে ছড়িয়ে আছে শহীদের রক্ত। ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকি পুরো এলাকা। ছোট্ট জায়গা কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চমৎকার পরিবেশন। এখানে প্রতিটি পদক্ষেপে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। আমার সামনে এখন শিল্পী রফিকুন্নবীর আঁকা দেয়াল চিত্র ‘জীবন অবিনশ্বর।’ দেয়ালচিত্রে চমৎকার ভাবে পাম্পের ট্যাংকের তলদেশ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এখানে ছয়টি লাশ একটার ওপর একটা পরে আছে। বোঝাই যাচ্ছে এদেরকে জবাই করে হত্যা করা হয়। আর সবার উপরে স্বাধীনতার সূর্যোদয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। আমি বামদিক দিয়ে ভেতরে যাই। এখানে স্বচ্ছ কাচের ফ্রেমে একটি সরার উপর বিভিন্ন বধ্যভূমির মাটি। এগুলো হলো বড়ইতলা বধ্যভূমি কিশোরগঞ্জ, বাবলা বন বধ্যভূমি রাজশাহী, পাগলা দেওয়ান বধ্যভূমি জয়পুরহাট, ফয়সলেক বধ্যভূমি চট্টগ্রাম, চুকনগর খুলনা এবং আদিত্যপুর বধ্যভূমি সিলেট। এখানে বিশ শতকের কয়েকটি গণহত্যার ঘটনা সাথে নিহতদের নাম লেখা রয়েছে ফলকে। যেমন একটি ফলকে লেখা আছে ইন্দোনেশিয়াতে বারো লক্ষ মানুষ হত্যা, ভিয়েতনামে ত্রিশ লক্ষ, বাংলাদেশে ত্রিশ লক্ষ, কম্বোডিয়ায় ১৭ লক্ষ এবং যুগোশ্লাভিয়ায় দুই লক্ষ পঁচিশ হাজার। পুরো এলাকা ছেঁয়ে আছে সবুজ ঘাসে।

জল্লাদখানা স্মৃতিপীঠ- ৩

জল্লাদখানা স্মৃতিপীঠ মূলত একটি পরিত্যাক্ত পাম্প হাউজ। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী, অবাঙালি বিহারি এবং তাদের দোসররা বাঙালিদের হত্যা করার পর এই পাম্প হাউজের কূপে ফেলে দিত। স্বাধীনতার পর এই বধ্যভূমি ও তার চারপাশের নিচু জমি থেকে প্রায় তিন ট্রাক মানুষের দেহাবশেষ উদ্ধার করে তা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু পাম্পের ট্যাংকের ভেতরের দেহাবশেষ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭৩ সালের দিকে তৎকালীন পররাষ্টমন্ত্রী ড: কামাল হোসেন জায়গাটি ঘুরে দেখেন। তারপর ১৯৯৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় খনন কাজ চালায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। এভাবেই গড়ে ওঠে বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠ। পাম্প হাউজের সেই ছোট্ট ঘরের ভেতর বাম দিকে জল্লাদখানা স্মৃতিপীঠ হত্যাকাণ্ডের দলিল দেয়ালে লিপিবদ্ধ। ডানে কূপটি স্বচ্ছ কাচ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। এর পাশের কিছু অংশ কালো রংয়ের টাইলস দিয়ে ঘেরা। সামনের দেয়ালে তসবি, স্যান্ডেল, টুপি, ম্যানিব্যাগ, সাইকেলের চেইন ও কলম প্রদর্শন করা। এগুলো নূরি মসজিদের কাছের বধ্যভূমি থেকে মানুষের খুলি ও হাড়ের সাথে পাওয়া গিয়েছিল। এসব দেখতে দেখতে কী এক কষ্ট দানা বাঁধে বুকে। মনে হচ্ছিল কোনও এক অদৃশ্য ছুরি ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছে আমার হৃদয়। আমার চোখে তখন ভাসছিল শহীদদের পরে থাকা লাশ, ছোপ ছোপ রক্ত।

জল্লাদখানা স্মৃতিপীঠ- ৪

এরপর দ্রুত পাম্প হাউজ থেকে বের হই। বের হতে হতে দেখা হয় জল্লাদখানা স্মৃতিপীঠের তত্ত্বাবধায়ক নাসিরুদ্দিনের সাথে। তার সাথে জল্লাদখানা স্মৃতিপীঠ নিয়ে কথা হয়। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও বিজয় নিয়ে কথা হয়। কথা হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে। যুদ্ধাপরাধীদের কোনওভাবেই ক্ষমা করা যাবে না- কথাগুলো তার কন্ঠে অঙ্গীকারের মতো শোনায়। শহীদদের রক্তের ঋণ শোধ করতে হলে স্বাধীনতা বিরোধী ও বিশ্বাসঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কোনও বিকল্প নেই।

যখন জল্লাদখানা স্মৃতিপীঠের ভেতর প্রবেশ করি, তখন মনে হচ্ছিল একটি ধ্বংসস্তুপের ভেতর যাচ্ছি। কিন্তু বের হওয়ার সময় মনে হলো জল্লাদখানা স্মৃতিপীঠ শুধুমাত্র একটি বধ্যভূমি নয়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটি পরিপূর্ণ ইতিহাস।

/এনএ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
ঢাকা শিশু হাসপাতালে আগুন
ঢাকা শিশু হাসপাতালে আগুন
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ