গল্প আছে, ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামের হকার্স মার্কেটগুলোতে সামান্য কিছু টাকা নিয়ে এক পাশ দিয়ে ঢুকে আরেক পাশ দিয়া স্যুট-কোট পরে বের হয়ে আসা যায়। তখন আপনার হাতে নাকি স্যুটকেসও থাকবে। ঢাকার ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের চিত্রটা অনেকটাই এরকম। এই মার্কেটে ঢুকলে পরিবারের সবার জন্য ঈদের পোশাক ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় অনুসঙ্গ নিয়ে বের হতে পারবেন।
'ধানমণ্ডি হকার্স মার্কেট' গাউছিয়া মার্কেটের উল্টোপাশের শাড়ির মার্কেট হলেও ক্রেতা সাধারণ ঢাকা কলেজের কোণার গ্লোব মার্কেট পর্যন্তই ধরে নেন। এর মধ্যে রেজা এসি মার্কেট, বদরুদ্দোজাসহ ৫টি মার্কেট রয়েছে।
এই মার্কেটে দু’দিন সরেজমিনে গিয়ে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেল। প্রতিটি দোকানে ক্রেতাদের লক্ষণীয় ভিড়।
মালিহা বেগম এসেছিলেন শাড়ি কিনতে। জামদানি ঘর থেকে জামদানি নিয়েছেন ৫টি। ভীষণ সন্তুষ্ট তিনি। এসব শাড়ি অনলাইন শপ ও শোরুমে দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশও করলেন তিনি। একটি দোকানে জাকাতের শাড়ির দাম জেনে নিলেন। তিনি জানান, গত ১৫ বছর ধরে এক মার্কেটেই তিনি কেনাকাটা করছেন। গত বছর ছেলের বিয়ের বেনারসিও এখান থেকেই কিনেছিলেন। ছেলের বিয়েতে মেয়ের পরার জন্য লেহেঙ্গাও এখান থেকে নিয়েছিলেন।
২০০ টাকা থেকে শুরু করে ২ লাখ টাকার শাড়ি আছে এখানে বলে জানালেন বিক্রেতা মামুন। মামুন দাবি করেন, অনেক তারকারাও তার দোকান থেকে নিয়মিত শাড়ি কিনেন। অনেকের ফোন নম্বর রাখা আছে। ভালো কোনও শাড়ি আসলে ফোন দিয়ে তাদের জানান। তারা এসে কিনে নিয়ে যান।
মিরপুর ২ থেকে এসেছেন সাগুফতা, এসেছেন ঈদের কুর্তি কিনতে রেজা এসি মার্কেটের একটি দোকানে কিনতে ঢুকেছেন। এখানে কেনও কিনতে এসেছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, দেশের নামি ব্র্যান্ডগুলোর মূল্য এত বেশি যে কেনার সুযোগ থাকে না। প্রায় একই ডিজাইনের পোশাক এখানে পাওয়া যায় অনেক কম মূল্যে। ৫০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে ভালো ডিজাইনের কুর্তি পাওয়া যায় বলে জানালেন সাগুফতা। কাপড়ের মান সম্পর্কেও বেশ উচ্ছসিত প্রশংসা করলেন তিনি।
যেখানে ব্র্যান্ডের সিঙ্গেল কুর্তি দুই থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয় সেখানে ডিজাইনার কুর্তি এক হাজার টাকার মধ্যে পেয়ে খুব খুশি মায়মুনা বেগম। মেয়ে ও বোনের মেয়ের জন্য ঈদের শপিং করতে এসেছেন তিনি। আজিমপুর থেকে এসেছেন। বেশ কয়েকটি শোরুম ঘুরে সাধ্যের মধ্যে কেনাকাটা করতে পারেননি। তাই হকার্সই ভরসা। মেয়ের জন্য কেনাকাটা শেষে ছেলে ও স্বামী ও সন্তানের জন্য শার্ট ও প্যান্ট ও এখান থেকেই কিনবেন বলে জানালেন। বদরুদ্দোজা মার্কেট থেকে শার্ট কেনার পরিকল্পনা রয়েছে তার। ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে টমি হিলফিগার, মার্ক অ্যান্ড স্পেন্সার, জেনোসেন এর মতো এক্সপোর্ট কোয়ালিটির টিশার্ট পাওয়া যায় কম দামে।
বদরুদ্দোজা মার্কেটের শার্ট বিক্রেতা আনোয়ার জানালেন, এসব শার্ট সবই এক্সপোর্টের জন্য তৈরি হয়। পরে বিদেশ গিয়ে আবার দেশে আসে বিদেশি সিল নিয়ে, তাই বড় শোরুমে এসব শার্টের দাম অনেক বেশি। কিন্তু কখনও রেডি পণ্য শিপমেন্ট ফেল করলে সেগুলো লোকাল বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়। সেগুলো বায়িং হাউসস, গার্মেন্টস থেকে সংগ্রহ করে সল্প মূল্যে বিক্রি করতে পারেন তারা। তিনি দাবি করেন, দেশের শীর্ষ স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোর মতোই দামি ব্র্যান্ডের শার্ট ও প্যান্ট রয়েছে তার দোকানে। এবং একদম নিখুঁত।
প্যান্ট বিক্রেতা আশিক জানালেন, প্রায় ২০ বছর ধরে হকার্সে প্যান্ট বিক্রি করে আসছেন, বিদেশ যাওয়ার আগে ক্রেতারা তার দোকান থেকেই কেনাকাটা করেন। সব ধরনের জিন্স, গ্যাবাডিন, ফরমাল প্যান্ট তার দোকানে পাওয়া যায়। ঈদ উপলক্ষে কেনাবেচা গতবারের মতো ভালো নয়। তবে আশা করছেন ২০ রোজার পর থেকে বেশ বিক্রি হবে। ৪০০ থেকে দেড় হাজার টাকা দামের প্যান্ট রয়েছে তার কাছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাপস এসেছিলেন প্যান্ট কিনতে। তিনি জানালেন, ঈদে বাড়ি যাওয়ার আগে সব শপিং এখান থেকেই সেরে যান তিনি। কারণ এখানে সবচেয়ে কমদামে ভালো ও পছন্দসই জিনিস পাওয়া যায়। আর তার বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব কাছে হওয়াতেও সুবিধা। ইচ্ছামতো কেনাকাটা করা যায়। আর দামটা একদম সাধ্যের মধ্যে বলে তিনি কোনও ব্র্যান্ডের দোকানে যেতে আগ্রহী নন। তিনি বললেন, আমরা এখানকার পণ্যকে বলি ‘ঢাকা কলেজ ব্র্যান্ড’।
বদরুদ্দোজা মার্কেটের আলম ফ্যাশনের দুই দিক থেকেই ঢোকা ও বের হওয়ার সুযোগ রয়েছে। দুইপাশ দিয়ে ক্রেতা ঢুকছেন কিনছেন বের হচ্ছেন। একদম দম ফেলার সুযোগ নেই। এই দোকানের মালিক আবু হানিফ জানালেন, এখনই সময় ব্যবসা করার। শীতকালে তিনি শীতের পোশাক আনেন, ঈদ উপলক্ষে ডিজাইনার টি-শার্ট এনেছেন। ২০০-৮০০টাকার মধ্যে শার্ট, টি শার্ট বিক্রি করছেন তিনি। বাংলা ট্রিবিউনে কথা বলার এক ফাঁকে একজন ক্রেতাকে বললেন, আপা এখানে দাম বেশি মনে হলে, বসুন্ধরা সিটিতে যান, এসির মধ্যে গিয়া আরামে কেনাকাটা করেন। ক্রেতা ব্যাংক কর্মকর্তা তাহমিনা হোসেন পালটা উত্তর দিলেন, ওই মার্কেটে গেলে তো আপনার এখানে আসতাম না।
তাহমিনা দুই ছেলের জন্য ঈদের টি-শার্ট কিনতে এসেছেন। বেশ কয়েকটি শার্ট কিনে ফেলেছেন। রেজা এসি মার্কেটে ঢোকার মুখেই ফিক্সড প্রাইজের একটি দোকান থেকে ৩৭৫ ও ৪৭৫ করে বেশ সুন্দর ও ভালো মানের শার্ট কিনেছেন বলে জানালেন। বোনের মেয়ের ফ্রক কিনেছেন রেজা এসি মার্কেট থেকে। ৫০০ টাকায় একটি গাউন ফ্রক কিনেছেন তিনি। এখানে কেনাকাটা করে বেশ সন্তুষ্ট তিনি।
এত কম দামে পণ্য দিয়ে লাভ কেমন থাকে জানতে চাইলে হানিফ জানালেন, এইটা হইলো খুশির মার্কেট। ক্রেতাও খুশি থাকে। আমরাও খুশি থাকি।
রেজা এসি মার্কেটে আন্ডারগার্মেন্টেসের দোকান ওমেন’স কালেকশন। মেয়েদের উপচে পড়া ভিড়। বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা মিতা জানালেন, সাধারণত তিনি গুলশান-বনানীতেই শপিং করেন কিন্তু গত কয়েকমাস ধরে এই মার্কেটে আসেন আন্ডারগার্মেন্টস কিনতে। এখানে ভালো মানের পণ্য কম দামে পাওয়া যায়।
মোট কথা শিশুদের পোশাক থেকে শুরু করে ছেলে-বুড়ো সবার জন্য পছন্দের পোশাক রয়েছে হকার্স মার্কেটে। এবং দামটা সাধ্যের মধ্যে।
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন।
/এফএএন/