X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

হাটের নাম ‘কাইকারটেক’

ফারুখ আহমেদ
১৪ জুন ২০১৭, ১২:২৫আপডেট : ১৪ জুন ২০১৭, ১৫:২৯
image

অনেক পথ যেতে হবে না, পথ অল্পই। তবে যখন মনে পড়ল অল্প পথটুকুই খানাখন্দের তখন যাবার ইচ্ছাটা মরে গেল। সে জন্য যাই যাই করে তিন সপ্তাহ পার করে দিলাম। এরপর তো ভেবেই নিলাম, এবছর আর যাওয়া হচ্ছে না। ঠিক তখনই এক সকালে দৃশ্যপটে নাজমূল স্যারের আগমন। তিনি কাইকার টেক যেতে চান। কিন্তু হাট তো আর রোজ রোজ বসে না। সপ্তাহের একদিন রবিবার হাটবার। হিসেব করে দেখি সেদিনও রবিবার। আমি তো খুশিতে চিৎকার করে উঠলাম। বিষয়টা একেবারে সোনায় সোহাগা। কিছু না ভেবেই যাত্রা শুরু করলাম।

কাইকারটেক- ১

ঠিক শেষ গ্রীষ্মের একদিন। মেয়র হানিফ উড়াল সেতুর পথটুকু অসাধারণ ছিল। সে পথ ধরে চলতে আকাশ দেখি। পরিষ্কার নীল আকাশ। তাতে ছোপ ছোপ শরতের মত শ্বেতশুভ্র মেঘ। এমন দৃশ্যে মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু উড়াল সেতু অতিক্রম করে দনিয়ার পথে নামতেই সব ভালো লাগা উধাও হয়ে গেল। উড়াল সেতুতে ৮০ কিলোমিটার বেগে বাইক চালাচ্ছিলাম। এবার পথচলা কখনও ১০ আবার কখনও ২০ কিলোমিটার বেগে। এভাবেই এক সময় কাচপুর ব্রীজে পৌঁছলাম। ব্রীজের ওপর এখন আর দাঁড়ানোর উপায় নেই। কাচপুর ব্রীজ থেকে নেমে রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে হাতমুখ ধুয়ে নাজমূল ভাইর ইচ্ছায় দুকাপ চা খেয়ে আবার ৮০ কিলোমিটার বেগে মটর সাইকেল চালাই। এভাবেই এক সময় মদনপুর, লাঙ্গলবন্ধ পেছনে ফেলে চলে আসি মুগরাপাড়া। এখানে ডানবাম করে একটু পেছনে ঢাকামুখী হয়ে বাম দিকে যে পথটা পেয়ে যাই সেটাই কাইকার টেকের পথ।

কাইকারটেক- ২


কাইকারটেক নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি গ্রাম। অবশ্য পুরো এলাকার সাইনবোর্ড জুড়ে সোনার গাঁ লেখা দেখবেন। কাইকারটেকের পথে প্রবেশ করে পথের সব ক্লান্তি মুছে যায়। পিচঢালা পথের দু ধারে অসাধারণ সবুজ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। এখানে সাদা মেঘের ভেলা কাছের অনেক চেনা শহরের চেয়ে যেন অনেক আলাদা। সঙ্গত কারণেই পথে নেমে বারবার বিরতি দিয়ে ছবি তোলা। এভাবেই এক সময় কাইকারটেক হাটে চলে আসি। আজ হাট-বাজারের দিন। হাটে প্রবেশের দুপাশে গেন্ডারির বাজার। কোথাকার আঁখ জানতে চাইলে বিক্রেতার উত্তর চাঁদপুরের। একটা আনাম ইক্ষু কিনে তিন টুকরা করে মোটর সাইকেলের পাশে বেঁধে আরো সামনে এগিয়ে হাটের ভেতর প্রবেশ করি। এবার একপাশে বাইক ষ্ট্যান্ড করে হাটের বেচাকেনা দেখা শুরু।

কাইকারটেক- ৩

ইতিমধ্যে হাতে ক্যামেরা চলে এসেছে। আর ক্যামেরা দেখে হাটের লোকজনের সেকি কৌতূহল! বিশেষ করে জাল বিক্রেতাদের কৌতূহলের কমতি নেই। হাট ভেঙ্গে যেন লোকজন আমাদের দেখতে চলে আসছে। তারপর প্রশ্নের পর প্রশ্ন বানের ছুটে। নাজমূল স্যারও কম যান না, তিনি উল্টা প্রশ্ন শুরু করেন। হাটে আসা বিশাল সব বাঁশ আর নৌকা নিয়েই তার যত প্রশ্ন। শেষ প্রশ্নটা ছিল এক বয়স্ক ব্যক্তির কাছে, ‘চাচা কাইকারটেকের এই হাটের বয়স কত?’ উনি উত্তর দেওয়ার আগেইএকজন জোয়ান মর্দ ছলিম মিয়ার উত্তর- ‘দাদার মুখে হুনছি ব্রহ্মপুত্র নদের পারের এই হাটের বয়স প্রায় ২০০ বছরের মতো।’

কাইকারটেক- ৪
দোকান বসেছে, পসরা সাজানো হয়েছে হাটে। দলে দলে লোকজন আসছেন কেনাকাটা করতে। কী নেই এই হাটে! কবুতর, জাল, দা, কুড়াল, জামা-কাপড়, গরু-ছাগল, মাছ, হাঁস-মুরগিসহ নিত্য ব্যবহার্য সবকিছুই রয়েছে। আম, জাম লিচু, দুধ, কলাসহ গৃহস্তের ঘরের একটা দুইটা কাঁঠাল। আহা চোখ জুড়ানো!

কাইকারটেক- ৫

ক্ষুদ্র এক মফস্বল শহরের ছোট্ট গ্রামের বিশাল বাজার কাইকারটেক। সপ্তাহের একদিন রবিবার এখানে হাট বসে। কাছে-দূরের অনেকে আসেন তাদের পসরা নিয়ে। সেই ভোরে হাট শুরু হয়ে শেষ হয় সন্ধ্যাবেলা। পানাম নগর কাছে হওয়াতেই কিনা এখানেও বাজারের মাঝখানে প্রাচীন এক প্রচীর চোখে পড়ল। হাটের বয়স ২০০ বছর বললেও সে প্রাচীরটির বয়স সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে পারলো না। তবে প্রাচীরের পাশে বিরাট বুড়ো বটগাছ আর তাতে অগুনিত পাখির বাসা দেখে তার বয়স সম্পর্কে কিছুটা ধারণা নিতে সক্ষম হলাম। দুইদিন পর বর্ষাকাল শুরু হবে। বেপারিদের দেখলাম নৌকা নিয়ে বসে থাকতে, নৌকার বিক্রিও কম না। ছোট-বড় সেসব নৌকা বিক্রি হচ্ছিল দেদার। বিশাল সব বাঁশ ব্রহ্মপুত্র নদের কিনারে লাইন করে সাজানো। হতশ্রী নদীর পাশে বাঁশের সে দৃশ্য দেখার মতো। একেবারে মনোরম যাকে বলে ঠিক তাই।

কাইকারটেক- ৬

এসব দেখে দেখে আমরা ব্রম্মপুত্র নদের তীরে এসে দাঁড়াই। প্রতি বর্ষায় নদী এগিয়ে আসে। এবছরও তার ব্যাতিক্রম দেখলাম না। নদী তীরে দাঁড়াতেই ঘূর্ণিহাওয়া এঁকেবেঁকে সারা শরীরে তার ঝাঁপটা দিচ্ছিলো। আমি ভাবছিলোম অন্যকথা। নদীটা যদি সেই আগের মত প্রমত্তা হয়ে উঠতো! বহু দূর পর্যন্ত বিস্তার, দাপাদাপি আর দুধের মতো তার ফেনিল রেখা ছুটে আসতো! আমি জীবনে অনেক লেখা লিখেছি কিন্তু নদী নিয়ে সেভাবে কিছু লিখে উঠতে পারিনি। ভাবতে ভাবতে নাজমূল স্যারের ডাকে সম্বিত ফিরে পাই। ক্ষুধা লেগেছিল খুব। অস্থায়ী খাবারের রেস্টুরেন্টে চলে আসি। এখানে পরোটা কিনি সের দরে। মিষ্টি, ভাজি, জিলাপি- সব নিয়ে খেতে বসি। সে সময় নাজমূল স্যার দোকানিকে প্রশ্ন রাখেন, ভাত হবে না ভাই!

কাইকারটেক- ৭

আমরা প্রায় দুই ঘন্টা কাইকারটেক হাটে ছিলাম। তারপর বাইক স্টার্ট দিয়ে কাইকারটেক ব্রীজে চলে আসি। ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে কাছের কাইকারটেক হাট দেখি, দেখি ব্রহ্মপুত্রকে। ব্রীজটা কাছে-দূরের লোকজনদের জন্য বিকেলের বিনোদনের আস্তানা। সূর্য হেলে পড়েছে, সুতরাং লোকজনের ভিড় বাড়ছে দেখে আমরা প্রিয় নগরের পানে ছুটে চলি। বৃষ্টি নামবে, ঝড়ো হাওয়া বইছে। মনে হচ্ছে যেন আকাশ থেকে সুর ঝরে পড়ছে। সে সুর ভেসে আসছে আমার কানে আর চোখে লেগে রয়েছে কাইকারটেক হাট আর ব্রহ্মপুত্র নদ!

কাইকারটেক- ৮

প্রয়োজনীয় তথ্য

আমরা কাইকারটেক গেছিলাম গ্রাম-গঞ্জের সাপ্তাহিক হাট দেখবার জন্য। সে হাট বসে প্রতি রবিবার। হাট দেখতে চাইলে আপনাকে যেতে হবে সোনার গাঁওয়ের কাছে মুগরা পাড়া চৌরাস্তা। সেখান থেকে ডানের কিছুটা পথ গেলেই পেয়ে যাবেন কাইকারটেক হাট। গুলিস্তান থেকে দোয়েল বাস প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর মুগরা পাড়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। যে কোনও রবিবার সাতসকালে আপনি দোয়েল বাসের যাত্রী হয়ে মুগরা পাড়া চলে যান। সেখানে নেমে যেকোনও অটোতে চড়ে চলে যাবেন কাইকারটেক। দলবেধে নিজস্ব বাহনেও যেতে পারেন। খাবার নিয়ে ভাববেন না। হরেক রকম খাবারে ভরা হাট। যা মন চায় খেয়ে নেবেন। ফেরার পথে টাটকা মাছ আর সবজিসহ হাটের বিশাল সব মিষ্টি কিনে ফিরতে পারবেন এই নগরে!

ছবি: লেখক

/এনএ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা