X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

মেঘের রাজ্যের বিস্ময় ‘সেভেন সিস্টার্স ঝরনা’

নওরিন আক্তার
০৪ অক্টোবর ২০১৭, ২১:০০আপডেট : ০৪ অক্টোবর ২০১৭, ২১:২৮
image

যতদূর চোখ যায় ছোট বড় অসংখ্য ঝরনা। সবুজ পাহাড়কে যেন পরম মমতায় জড়িয়ে রেখেছে সাদা রঙের ঝরনাগুলো। অবিরত ঝরে পড়েছে বিশাল পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। এটি ভারতের মেঘালয়ে অবস্থিত বিস্ময়কর সেভেন সিস্টার্স ঝরনা। ভারতের চতুর্থ বৃহৎ ঝরনা হচ্ছে সেভেন সিস্টার্স ওয়াটার ফল।

সেভেন সিস্টার্স ঝরনা
চেরাপুঞ্জিতে খাসিয়া পাহাড়ের এই ঝরনার দেখা পাওয়া কিন্তু খুব সহজ নয়! কেবল ভাগ্য সহায় থাকলে তবেই দেখা মিলবে বিস্ময়কর সেভেন সিস্টার্স ঝরনার।
মাস দুয়েক আগে চেরাপুঞ্জি গিয়েছিলাম এ ঝরনা দেখার উদ্দেশ্যে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হওয়া চেরাপুঞ্জিতে গিয়েই পড়লাম বৃষ্টির কবলে। অল্পসল্প বৃষ্টি না, তুমুল বৃষ্টি! খানিকক্ষণ পর বৃষ্টি কমে গেলে চেরাপুঞ্জির অন্যতম আকর্ষণ সেভেন সিস্টার্স দেখতে ছুটে গেলাম। কিন্তু বিধিবাম! প্রচণ্ড মেঘে ঢাকা পড়ে আছে ঝরনা। সেই মেঘ এতই শক্তিশালী যে একহাত দূরের কিছু দেখা যায় না। রাস্তার পাশে ব্রিজ। সেটিই সেভেন সিস্টার্স এর ভিউ পয়েন্ট। আমাদের মতো অসংখ্য পর্যটক সেখানে অপেক্ষায় আছেন মেঘ সরে যাওয়ার। কিন্তু প্রকৃতির খেলা বোঝা মুশকিল। যতই দিন গড়ায়, ততই বাড়তে থাকে মেঘ।

এই পানিই ঝরে পড়ে ঝরনা হয়ে কখন সরবে মেঘ? এমন প্রশ্নে আমাদের ট্যাক্সি ড্রাইভার হেব্রিত জানালেন, স্বয়ং ঈশ্বর ছাড়া আর কেউই বলতে পারেন না চেরাপুঞ্জির আবহাওয়া সম্পর্কে! হতে পারে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দেখা দেবে ঝরনা, আবার আগামী ৫ দিন পরেও দেখা দেওয়া বিচিত্র নয়! অগত্যা অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। ব্রিজে দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনি সেভেন সিস্টার্স ঝরনার তীব্র গর্জন। ঘন কুয়াশার মতো মেঘের আস্তরণে আড়াল হয়ে থাকা ঝরনার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আমাদের হাতে অপেক্ষা করার মতো আর সময় ছিল না। আসাম ঘুরে নিজ দেশে ফিরতে হবে আমাদের। ফিরে আসার আগে মেঘে ঢাকা সেভেন সিস্টার্স ঝরনার সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আবার ফিরে আসবোই! কেবল এই ঝরনা দেখার জন্যই আবার ফিরে আসবো চেরাপুঞ্জিতে।

বৃষ্টির কারণে সৃষ্টি হওয়া অস্থায়ী ঝরনা
সেই প্রতিজ্ঞা রাখতে ও সেভেন সিস্টার্স ঝরনা দেখার টানে আবারও ছুটে গিয়েছিলাম চেরাপুঞ্জিতে। এবার চেরাপুঞ্জিতেই থাকবো বলে ঠিক করলাম। যেহেতু বর্ষাকাল শেষ, হয়তো পরিষ্কার দেখতে পাব সেভেন সিস্টার্স। এমন ভাবনা থেকেই শরতের মাঝামাঝি সময় বেছে নিয়েছিলাম। তবে চেরাপুঞ্জি পৌঁছে পুরোপুরি বিভ্রান্ত হতে হলো। আগেরবারের থেকেও বেশি বৃষ্টি! ছাতা, রেইনকোট কোনও কিছুতেই বাঁধ মানছে না বৃষ্টি। মেঘেরা যেন আরও বেশি একরোখা। সামনের মানুষকেই দেখা যায় এত প্রচণ্ড মেঘ। এবার একেবারেই নিরাশ হয়ে গেলাম আমরা চার বন্ধু। তবে কি আর সেভেন সিস্টার্স ঝরনা দেখা কপালে লেখা নেই?

ঝরনার ওপরে


সকালে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে নাস্তা শেষ করেই ট্যাক্সি নিয়ে ছুটে গেলাম সেভেন সিস্টার্স ঝরনার সামনে। কিছুই দেখার উপায় নেই। যেন মেঘের চাদরের নিচে ঘুমিয়ে আছে ঝরনা। এর মধ্যে তুমুল বৃষ্টি। গাড়ি থেকে নামার উপায়ই নেই! কী আর করার। গাড়ি পার্কিং এ রেখে গাড়িতে বসেই অপেক্ষা শুরু করলাম। এর মধ্যে বৃষ্টি কখনও বাড়ে, কখনও কমে। কিন্তু মেঘ আর সরে না। বিরস বদনে আমরা বারবার তাকায় ঝরনার দিকে। যদি একটু দেখা যায়! ঝাপসা হলেও যদি একবার দেখা পাই এই বিস্ময়ের। কিন্তু মেঘ সরার কোনও লক্ষণই নেই। এর মধ্যে পার হয়ে গিয়েছে প্রায় ৩ ঘণ্টা। আবারও ফিরে যেতে হবে ঝরনা না দেখেই? আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা যাক।
হঠাৎ একটা শোরগোল শোনা গেল বাইরে। দেখলাম ছাতা নিয়ে ছুটে আসছেন পার্কিং এর তদারকিতে থাকা একজন। গাড়ির কাছে এসেই চিৎকার শুরু করলেন তিনি, ‘তাড়াতাড়ি বের হও। মেঘ সরে গেছে। সেভেন সিস্টার্স ঝরনা একদম পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।’ সেই মুহূর্তে মনে হলো এর থেকে শ্রুতিমধুর বাক্য আর জীবনে শুনিনি।

পাথুরে নদীর এই পানিই নামে ঝরনা হয়ে
সবাই দৌড়ে বের হলাম। ছুটে গেলাম ব্রিজে। চোখের সামনেই মেঘের আড়াল থেকে একটু একটু করে বের হতে শুরু করলো সেভেন সিস্টার্স ঝরনা। অসংখ্য ঝরনাগুলো একটি একটি করে দেখা দিতে থাকলো। আর আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়েই থাকলাম। একটি একটি করে কখন যে পুরো পাহাড়ই বের হয়েছে মেঘের আড়াল থেকে সেটা খেয়াল করিনি। হঠাৎই দেখলাম একসঙ্গে সবগুলো ঝরনার প্রবল উচ্ছ্বাস নিয়ে তীব্র গতিতে নেমে আসছে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। এই সৌন্দর্য বর্ণনা করা অসম্ভব। ঝরনার এই উন্মাতাল রূপ কেবল দুচোখ ভরে উপভোগ করতে হয়। আর সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির প্রতি মুগ্ধ হতে হয়।

প্রবল উচ্ছ্বাসে নেমে আসছে ঝরনা

বিশাল পাহাড়ের ওপারে কি লুকিয়ে আছে? কোথা থেকে আসছে ঝরনার এত পানি? এগুলোর উত্তর খুঁজতে ঝরনার উপরে যাব বলে ঠিক করলাম। ততক্ষণে আবারও মেঘে ঢাকতে শুরু করেছে সেভেন সিস্টার্স ঝরনা। ইকো পার্ক দিয়ে যাওয়া যায় ঝরনার কেন্দ্রস্থলে। গাড়ি নিয়ে চলে গেলাম ইকো পার্ক। প্রচণ্ড বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাঁটতে শুরু করলাম। তখন আমরা ঝরনা বয়ে চলা পাহাড়ে। পাহাড়ের ধারে আসতেই আরেকবারের মতো অদ্ভুত এক মুগ্ধতা ছেয়ে গেল। যে পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আমরা এতক্ষণ দেখেছি ঝরনা, সেই পাহাড়ের গায়েও ঝরনার ছড়াছড়ি! কি সুন্দর! নির্দিষ্ট দূরত্বে ছোট ছোট রেখার মতো সাদা লাইনে ঝরে পড়ছে পানির ধারা।

বিশাল অংশ জুড়ে বয়ে চলা এই পানি নেমে আসে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে

সেই রূপ দেখতে দেখতে সামনে আগাই আর দেখি বিস্মিত হওয়ার অসংখ্য উপকরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এখানে! ঝরে পড়া ঝরনার পানির উৎস খুঁজতে খুঁজতে চলে গেলাম এমন এক জায়গায়, সেখানে যতদূর চোখ যায় কেবল পাথুরে নদীর উচ্ছ্বাস। অজানা থেকে বয়ে আসা এই পানিই সেভেন সিস্টার্স ঝরনা হয়ে নামছে নিচে। এত বিশাল এলাকা ধরে বয়ে চলা পাথুরে নদী এর আগে দেখিনি। কি স্বচ্ছ সেই পানি!

স্বচ্ছ পানির উচ্ছ্বাস

মেঘালয়ের পাহাড়গুলো যেন এক একটা ঝরনার খনি। আনাচে কানাচে লুকিয়ে আছে উন্মাতাল ঝরনা। কতোগুলোই আর খুঁজে বের করা যায়? ঝরনা খোঁজার রণে ভঙ্গ দিয়ে আবার একই পথ ধরে ফিরতে গিয়ে দেখি আরেক পাহাড়ের ছোট ছোট সেই ঝরনাগুলো গায়েব! জানা গেল বৃষ্টির কারণে সৃষ্টি হওয়া এগুলো অস্থায়ী ঝরনা। বৃষ্টি থামার কয়েক ঘণ্টা মধ্যেই শুকিয়ে যায় এগুলো। ছোট ঝরনা না থাকলেও তখন মেঘের আনাগোনা পাহাড়জুড়ে। একরোখা মেঘগুলো তখন বড় বেপরোয়া। উড়ে উড়ে খুঁজে চলেছে যেন আপন ঠিকানা। আমরাও একটি সফল চেরাপুঞ্জি ভ্রমণ শেষে তখন শিলং এর পথে। সেভেন সিস্টার্স ঝরনা দেখার আনন্দ আরেকটু বাড়িয়ে দিল আমাদের ড্রাইভার হেব্রিতের বলা ‘তোমরা অনেক ভাগ্যবান’ কথাটি। আসলেই আমরা ভাগ্যবান। একদম ভরা মৌসুমে মেঘহীন সেভেন সিস্টার্স ঝরনা দেখার সৌভাগ্য গুটিকয়েক পর্যটকেরই হয়!

যেভাবে যাবেন

শিলং, চেরাপুঞ্জি যেতে চাইলে ডাউকি দিয়ে ভিসা করিয়ে নিন। সরাসরি শ্যামলী বাসের প্যাকেজে চলে যেতে পারেন মেঘালয়ে। তবে সেক্ষেত্রে খরচ একটু বেশি পড়বে। বন্ধুরা কয়েকজন মিলে যেতে চাইলে তাই নিজেরা যাওয়াই ভালো। সেক্ষেত্রে বাসে করে সিলেট চলে যান। সেখান থেকে সিএনজি নিয়ে সোজা তামাবিল বর্ডারে। বর্ডারের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে চলে যান ডাউকি। সেখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে চেরাপুঞ্জি। শিলং, চেরাপুঞ্জি ঘুরতে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ হবে। যদি শুধু চেরাপুঞ্জি ঘুরতে চান তবে খরচ কমে যাবে আরও। দলে সদস্য সংখ্যা বেশি হলেও খরচের পরিমাণ কমে যাবে। শিলং ও চেরাপুঞ্জিতে হোটেল রয়েছে অনেকগুলো। থাকা খাওয়ার খরচ সেখানে খুব বেশি না। ডাউকি থেকে চেরাপুঞ্জি যেতে সময় লাগবে আড়াই থেকে ৩ ঘণ্টা।  

/এনএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী