X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ছন্দময় শুভলং ঝরনা

শাওলী মাহবুব
০৮ অক্টোবর ২০১৭, ১৬:১৮আপডেট : ১০ অক্টোবর ২০১৭, ১৮:৫১

ছন্দময় শুভলং ঝরনা খাড়া পাহাড়ের বৃষ্টিস্নাত সিঁড়ি ভেঙে আমাকে যখন কাপ্তাই লেকে নামতে বলা হলো, সমতলীয়-সাবধানী মন আছাড় খাবার ভয়ে বিদ্রোহ করে বসল। কিন্তু আমি নাচার ছিলাম। ঘোরানো প্যাঁচানো যে পথ পাহাড়ের গা ছুঁয়ে নিচে নেমে গেছে, সেখানে আগেই অপেক্ষা করছিল আমার ন’বছর বয়সী মেয়ে। মেয়ের উৎসাহেই নামতে হলো কাপ্তাই লেকে। লেকে ভাসা নৌকা আমাদের নিয়ে যাবে শুভলং পাহাড়। কাপ্তাই থেকে শুরু হওয়া পুরো যাত্রাই ছিল জলপথে। খুব সংক্ষেপে বললে কাপ্তাই থেকে পেদাটিংটিং রেস্তোরাঁ হয়ে শুভলং পাহাড়। কিন্তু এতেই অভিযানের বর্ণনা শেষ হয়ে যায় না। কারণ এ যাত্রার আমেজ ছিল আরও গভীর।

এবার জুন-জুলাইয়ের তীব্র বৃষ্টি বাংলাদেশে পাহাড় ধ্বসের মাত্রা বাড়িয়েছে। বর্ষার এই ভরা মৌসুমে, কাপ্তাই যাবার পথে, সেসবের চিহ্ন, অল্প হলেও আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম। চট্টগ্রাম থেকে কাপ্তাই যাবার পথে, ধ্বসে যাওয়া রাস্তার পাশগুলোকে মেরামত করতে ব্যস্ত দেখা গেলো শ্রমজীবী মানুষদের। কাপ্তাই যাবার রাস্তাও বোধকরি অনেকদিন মেরামত করা হয়নি,  শুধুমাত্র কাপ্তাইয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে, শেষ ২৬ কিলোমিটার নিরবিচ্ছিন্নভাবে যাবার মসৃণ পথ মিলল। কাপ্তাই পৌঁছে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো বাংলাদেশ নৌবাহিনীর শাহমোয়াজ্জেম ঘাটির ‘বনকুটিরে’। ছিমছাম গোছানো ছোট ঘর, পাশে ডাইনিং। সবচেয়ে সুখকর হলো বারান্দা বা ডাইনিং হলে বসে মনোমুগ্ধকর কাপ্তাই লেক দেখা। নাগরিক জীবনের শ্রান্তি দূর করার জন্য সেখানে কিছুক্ষণ বসে থাকাই যথেষ্ট। যে পাহাড়ে বনকুটিরের ঘর তোলা, তার গা থেকেই নেমে গেছে জেটির সিঁড়ি। জেটিতে দাঁড়ানো ছোট এক বোটে করে সকাল ১১টা রওনা হলাম শুভলংয়ের উদ্দেশ্যে। ছন্দময় শুভলং ঝরনা

যাত্রা শুরু হলো পাহাড়ের মধ্য দিয়ে চলা কর্ণফুলীর ভেতর দিয়ে। পাহাড়ী ঢলে একদম ঘোলাটে হয়ে ছিলো কর্ণফুলীর পানি। প্রবল বর্ষায় ফেনিয়ে ওঠা জলরাশি সুর তুলে তুলে নেচে যাচ্ছিল। এই জলরাশিকে দু’পাশে বেঁধে রেখেছে বৃষ্টিধোয়া সবুজ পাহাড়। যদিও নিন্দুকেরা বলেন পাহাড়ের বাইরের দিকটাতেই শুধু সবুজ গাছ আছে, ভেতরে সবখানে গাছধোয়া ন্যাড়া পাহাড়। আপাতত; নিন্দুকের মুখে ছাই।

খোলা দৃষ্টিতে যা দেখা যাচ্ছে, তা হলো সবুজ রঙের পাহাড়গুলো পূর্ণ রাতে আনন্দিত কর্ণফুলীর দুপাশ ঘিরে রেখেছে। পাহাড়ের গায়ে বাঁধা পেয়ে পেয়ে স্রোতস্বিনী আরও যেন উদ্বেলিত;  নেচে নেচে ফেরে এধারে ওধারে। পাহাড়ী কন্যা হয়ে পাহাড়ের কোলে কোলে ফেরে কর্ণফুলী। এরই সাথে বাড়তি আনন্দ ছিলো ঝরে পড়া বৃষ্টি। দূর পাহাড়ে শুরু হচ্ছিল ঘোলাটে বৃষ্টি, তারপর আস্তে আস্তে সরে আসছিল নদীর দিকে। ঝমঝম শব্দে জানান দিয়ে আবারও উড়ে চলে মেঘেরা। কোথাও বা দেখা গেলো ঠিক একটু জায়গা জুড়ে মেঘ ছুঁয়েছে নদী। আসলে মেঘ নয়, ঠিক ওই অংশটুকুতেই তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। দূর থেকে মনে হচ্ছিল যেন ঘন মেঘ-ধারা। শুভলং যেতে যেতে পাখি খুব একটা চোখে পড়েনি। তবে দলছুট দুটো বীর পাখি বেশ মন কাড়ল। এর একটা ধবল সাদা বক। কনকর্ড প্লেনের মতোই রাজকীয় তার ভঙ্গি। গ্রীবা তুলে, সাদা পাখা মেলে দিয়ে মাছ খুঁজতে বেড়িয়েছে সে। আর একটা নাচুনে সোয়ালো- যান্ত্রিক নৌকার সাথে পাল্লা দিয়ে পাশাপাশি উড়ে চলল কিছুক্ষণ। ভাবলাম ক্লান্ত হয়ে থেমে যাবে । কিন্তু থামার লক্ষণ দেখা গেলো না। বরং মধ্য কর্ণফুলী নাচুনে ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে উড়ে চলল সে। আর কিছুক্ষন পর আমাকে অবাক করে দিয়ে, আমাদের যান্ত্রিক নৌকার গতিও অতিক্রম করে দূরে চলে গেল। ছোট্ট শরীরে এতো ‘এনার্জি’ কোথা থেকে পেলো সে চিন্তা করে আমিও কিছু সময় পার করে দিলাম।

ঘন্টা খানেকের মধ্যে আমরা পেদা টিং টিং পৌছুলাম। একটা ছোট দ্বীপ। পুরোটাই রেষ্টুরেন্ট। চাকমা ‘পেদা টিং টিং’ এর ভাষান্তর হলো পেটপুরে খাওয়া। সেখানে দুপুরের খাবারের অর্ডার দিয়ে আবার যাত্রা শুরু হলো। পুরো নদীপথে স্থানীয় বাসিন্দাদের নৌকা চলাচল করে বেশ। তাতে আদিবাসী এবং স্থানিক বাঙালীদের চেহারা দেখা গেল। এরা নিত্য দিনের যাত্রী। কোন কোন নৌকায় বাজার সদাই ভর্তি।  নৌকো বোঝাই শাকসবজি, ফলমূল আর নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যে পূর্ণ নৌকো। যেতে যেতে দূর থেকে নজর কাড়ে রাঙামাটি শহর। অথবা পাহাড়ের চূড়ার ধ্যানী বুদ্ধের সোনালী মূর্তি। যাবার পথে বেশ কিছু নৌকো দেখা গেলো যেগুলো কিনা আদিবাসী এবং সেটলার তরুণদের ভর্তি। উচ্চ শব্দে গান ছেড়ে পাশাপাশি চলছিল। শুভলঙে পৌঁছে বুঝলাম তারাও ছিলো শুভলঙমুখী। ছন্দময় শুভলং ঝরনা যাত্রা শুরুর প্রথম দিকে কাপ্তাই লেকের আশপাশের পাহাড়গুলো একটু নরম মাটির ছিল। শুভলং পৌঁছুতে পৌঁছুতে রুক্ষ পাথুরে পাহাড়ের সৌন্দর্য মিলল। এইসব পাথুরে পাহাড়ের গা বেয়ে ছোট ছোট ঝিরি নিঃশব্দে নেমে আসছিল কর্ণফুলীর কোলে। এই পাহাড়গুলোও সবুজ ছিলো, কিন্তু পাথুরে গায়ের খাঁজকাটা সৌন্দর্যকে কোনভাবেই সে সবুজ ঢেকে রাখতে পারছিল না। সবুজের ফাঁকে ফাঁকে বহুকালের সাজানো চিহ্নচিত্র আমাদের যেন পুরাকালেই ফিরিয়ে নিয়েছিল।

শুভলং পাহাড় এবং ঝরনা বরকল উপজেলায় অবস্থিত। রাঙামাটি শহর থেকে পঁচিশ কিলোমিটার দূরে। জলপথই ওখানে পৌঁছুবার একমাত্র পথ। শুভলং বাজারের ঠিক আগে এই ঝরনা। বর্ষার ভরা মৌসুমে প্রায় তিনশ ফুট ওপর থেকে পানি পড়ে। তাই দূর থেকেই চোখে পড়ে শুভলং ঝরনার ধারাগুলো। শুভলং পাহাড়ে পৌঁছে টিকিট কেটে নিলাম। ছোট এক টিলায় টিকেট কাটার ঘর। স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। জনপ্রতি পনের টাকা করে টিকেট আর কোনও এক আদিবাসী শুভলংকে দেখার টিকেট দিচ্ছেন। টিকিট ঘরের পাশেই টিলার ওপর ছোট একটা আদিবাসী দোকান রয়েছে, যেখানে চা, কফি বা হালকা খাবার পাওয়া যায়।

সব পেরিয়ে ঝরনামুখী হলাম। এইবার ঝরনা তার পূর্ণ সৌন্দর্যসমেত হাজির। টিলার ওপর থেকেই, গাছের ফাঁক দিয়ে বেশ বোঝা যাচ্ছিল তার সৌন্দর্য। সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো সিঁড়ি রয়েছে ঝরনার কাছে যাবার। পৌঁছে বুঝলাম কেন শুভলং লোকপ্রিয়। তিনশ ফুট ওপর থেকে যে পানি আছড়ে পড়ে পাথরের চাঁইয়ের ওপর, নীচের দিকে তা বেশ প্রসারতা দিয়েছে ঝরনাকে। মাঝে কয়েকপ্রস্থ পাথরের স্তরে বাঁধা পেয়ে উপরের ক্ষীণ ধারাগুলো ব্যাপ্তি লাভ করেছে। পাথরের বুকে উছলে পড়ে পড়ে, সহস্র নূপুরের ঝুমঝুম নিক্বণে মন কেড়ে নিচ্ছে সবার। অনেক দূর থেকে শুভলঙের পানি এসে চোখমুখ ছুঁয়ে স্বাগত জানায় সবাইকে। এমনই মাদকতা যে আপনি বুঝি ছবি তোলার কথাও ভুলে যাবেন। দীর্ঘসময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর আপনার মনে হবে আপনি শুধু দেখে যাচ্ছেন। তাই এবার পানি ছোঁয়ার পালা। আমাদের দলের ছোটসদস্য গৌতমবুদ্ধের মতো ঝরনা নীচে ধ্যানে দাঁড়িয়ে গেলো চোখ বুজে। আর তারপর, বড়রাও নিজেদের গাম্ভীর্য ঠেলে দিতে বাধ্য হলেন। ঘন্টাখানেক নিমেষে কেটে গেল।

ফেরার পথে আমরা ছোট একটা দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করলাম। পাশের নৌকার এক আদিবাসী ছেলে সাতাঁর না জেনেই লেকে নেমেছিলো। সবার অগোচরেই সে লেকের পানিতে ডুবে যাচ্ছিল। ডুবে যাবার আগে দৃষ্টি আকর্ষণের প্রাণান্তকর চেষ্টা করে সে।  কিন্তু তার দলের অন্য সদস্যরা বিকট শব্দে গান শুনছিলো বলে সেই ডাক কেউ শুনতে পায়নি। ডুবন্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে নেভির নৌচালকরা। কাজেই আনন্দে উদ্বেল হবার সাথে সতর্ক হবার প্রয়োজনও রয়েছে। এরপরও, সব বাঁধা পেরিয়ে পায়ের তলায় সর্ষে দিয়ে ঘুরতে ভালোবাসেন যারা, বর্ষার শুভলং আর সবুজ পাহাড়ি ব্যঞ্জনা তাদের মুগ্ধ করবে সন্দেহ নেই। 

এফএএন
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা