কুমিল্লার ঐতিহ্যের মধ্যে অন্যতম রসমালাই। যেকোনও উৎসব-পার্বণে এই মিষ্টির আবেদন চিরন্তন। কিন্তু রসমালাই তৈরির উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠান মাতৃভাণ্ডারের রসমালাইয়ের ঐতিহ্য আর সুখ্যাতিকে পুঁজি করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মিষ্টি ও রসমালাই ব্যবসায় নেমে পড়েছেন। মাতৃভাণ্ডারের নাম ভিন্নভাবে ব্যবহার করছে তারা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার সুয়াগঞ্জ থেকে ক্যান্টনমেন্ট বাজার পর্যন্ত ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে শতাধিক রসমালাইয়ের দোকান। নিন্মমানের রসমালাই তৈরি ও বিক্রি করে গ্রাহকদের সাথে প্রতারণা করে আসছে তারা। নষ্ট করছে কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি ও রসমালাইয়ের সুনাম।
উনিশ শতকের প্রথম দিকে ত্রিপুরা রাজ্য তথা কুমিল্লার ঘোষ সম্প্রদায়ের দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে ক্ষীর বানিয়ে তাতে শুকনো ভোগ বা ছোট আকারের রসগোল্লা মিশিয়ে যে মিষ্টি তৈরি করা হতো তা ক্ষীরভোগ নামে পরিচিতি পায়। ক্রমান্বয়ে এই ক্ষীরভোগই রসমালাই নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খড়িয়ালার খনিন্দ্র সেন ও মনিন্দ্র সেন নামের দুই ভাই কুমিল্লায় এসে শহরের মনোহরপুর এলাকায় মাতৃভাণ্ডার নামের একটি দোকান দেন। বিক্রি শুরু করেন ক্ষীরভোগ বা রসমালাই। স্বাদে ভালো হওয়ায় অল্পদিনের মধ্যেই রসমালাইয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। কালক্রমে এই মিষ্টি কুমিল্লার ঐতিহ্যের অংশ হয়ে ওঠে। চিরকুমার মনিন্দ্র সেন মারা যান। খনিন্দ্র সেনও ১৯৪০ সালে মারা যান এক ছেলে দুই মেয়ে রেখে। পরবর্তীতে খনিন্দ্র সেনের ছেলে শংকর সেন বাবা-চাচার গড়া মাতৃভাণ্ডার পরিচালনার হাল ধরেন। শংকর সেনও এখন বয়সের ভরে ন্যুজ হয়ে পড়েছেন।
শংকর সেন জানান,তার বাবা খনিন্দ্র সেন ওয়াপদার চাকরি ছেড়ে মাতৃভাণ্ডার নামের এই দোকানটি শুরু করেন। এটি পাকিস্তান আমল থেকেই বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বর্তমানে মাতৃভাণ্ডারের নিজস্ব কারখানায় উত্তম দে ও ক্ষিতিশ মোদক নামের দুজন অভিজ্ঞ কারিগর এ রসমালাই তৈরি করছেন। আগ্রহী নতুন কারিগররা এ দুজনের কাছে উন্নতমানের রসমালাই তৈরির পাঠ নিচ্ছেন।
মাতৃভাণ্ডারের কারিগর রসমালাই তৈরির প্রক্রিয়া সর্ম্পকে জানান, একটি বড় কড়াইয়ে গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে দুই ঘন্টা জ্বাল দিতে হয়। এই দুধ ঘন হয়ে পরিমাণে কমে ক্ষীর হয়। সাধারণত এক মণ দুধে ১৩ থেকে ১৪ কেজি ক্ষীর তৈরি হয়। পরে এই ঘন ক্ষীরের সঙ্গে ছোট আকারের রসগোল্লা মেশানো হয়। ঠাণ্ডা হলেই স্বাদে পূর্ণতা পায় রসমালাই। অবশ্য ক্ষীর বা মালাইয়ের ঘনত্বের উপর রসমালাইয়ের স্বাদ ও দাম নির্ভর করে।
মানসম্পন্ন রসমালাই তৈরিতে প্রতি মণ খাঁটি দুধে ১৩ থেকে ১৪ কেজি রসমালাই হলেও ভেজাল রসমালাই তৈরি হয় প্রতিমণ দুধে ৩০ থেকে ৩৫ কেজি। এ রসমালাইয়ের ঘনত্ব ও স্বাদ কিছুই থাকে না। ভেজাল রসমালাই তৈরিতে ভারতীয় শক্তি ও মধু নামের নিন্মমানের পাউডার দুধ ব্যবহার করা হয়। অসাধু ব্যবসায়ীরা এসব দুধের গুঁড়া ব্যবহার করে। এতে উৎপাদন খরচ কম হলেও মান হয় নিন্মমানের। মানসম্মত রসমালাইয়ে দুধের ছানা দিয়ে রসগোল্লা বানানো হয়। এক কেজি দুধের ছানার সঙ্গে ৬৫ গ্রাম ময়দা মেশানো হয়। ভেজাল রসমালাই তৈরিতে এক কেজি ছানার সঙ্গে আড়াইশ' গ্রাম ময়দা মেশানো হয়। এতে রসমালাই তৈরিতে খরচ কমে আসে। অল্পদামে বিক্রি করা হয় এসব ভেজাল রসমালাই।
অসাধু ব্যবসায়ীরা কুমিল্লা ঐতিহ্যবাহী রসমালাইয়ের উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠান মাতৃভাণ্ডারের নাম ভিন্নভাবে ব্যবহার করছে। কুমিল্লা মাতৃভাণ্ডার,কুমিল্লার মাতৃভাণ্ডার, আদি মাতৃভাণ্ডার,কুমিল্লার বিখ্যাত মাতৃভাণ্ডার,কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী মাতৃভাণ্ডার, ময়নামতি মাতৃভাণ্ডার,খাঁটি মাতৃভাণ্ডারসহ বিভিন্ন নামে রসমালাইয়ের ব্যবসা করে আসছে। এসব দোকানীদের দাবি তাদের রসমালাই আসল ও উন্নতমানের।
মাতৃভাণ্ডারের নাম ব্যবহারকারী মিষ্টি ব্যবসায়ী আবদুস ছালাম বলেন,ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বছরখানিক আগে মিষ্টি ও রসমালাইয়ের দোকান দিয়েছেন তিনি। আশানুরূপ বিক্রি না হওয়ায় মাতৃভাণ্ডারের সাইনবোর্ড ব্যবহার করছেন। কারণ মাতৃভাণ্ডার নামে রসমালাই বেশি বিক্রি হয়।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়,মাতৃভাণ্ডারের রসমালাইয়ের স্বাদ সম্পর্কে যারা জানেন তারা এ প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনও দোকানের রসমালাই কেনেন না। প্রতিদিন এ দোকানে বিক্রি হয় ১ লাখ টাকার রসমালাই। সকাল ও বিকেলে লাইনে দাঁড়িয়ে রসমালাই কেনেন ক্রেতারা। ভাগ্য খারাপ হলে রসমালাই ছাড়াই ফিরতে হয় বাড়ি।
রসমালাই তৈরির উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠান মাতৃভাণ্ডার হলেও এর পাশাপাশি মনোহরপুরের ভগবতী পেড়া ভাণ্ডার,শীতল ভাণ্ডার, কান্দিরপাড়ের পোড়াবাড়ী,জেনিস, জলযোগ, আবদুল্লাহসহ হাতে গোনা কয়েকটি দোকান রসমালাই তৈরি করে থাকে। মানের দিকে মাতৃভাণ্ডার এগিয়ে থাকলেও এসব দোকান মাতৃভাণ্ডারের মান ধরে রাখার প্রয়াস চালিয়ে আসছে। মাতৃভাণ্ডারসহ এ সকল দোকানের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় রসমালাই ছাড়াও অন্যান্য মিষ্টি তৈরি হয়। মাতৃভাণ্ডারে রসমালাই প্রতিকেজি ২৬০ টাকা হলেও এসব দোকানে প্রতি কেজি ২২০ থেকে ২৪০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে রসমালাই। সস্তা উপাদান দিয়ে তৈরি রসমালাই বিক্রি হয় এর থেকে কম দামে।
কুমিল্লার সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি আলী আকবর মাসুম বলেন, খ্যাতি ও ঐতিহ্যের রসমালাই অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে পড়ে খ্যাতি হারাক সেটা কারোর কাম্য নয়। কুমিল্লার নামের সাথে জড়িয়ে থাকা এর ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোঃ জাহাংগীর আলম বলেন, ‘কিছুদিন আগে জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের খোঁজে মাতৃভাণ্ডার কর্তৃপক্ষের কাছে গেলে তারা রেজিষ্ট্রেশনের কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। রসমালাইয়ের উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠান মাতৃভাণ্ডার কর্তৃপক্ষ নিজেরাই চায় না নামটি রেজিষ্ট্রেশন করা হোক। মালিকপক্ষ যদি মাতৃভাণ্ডারের নামে রেজিষ্ট্রেশন বা কাগজপত্র করে তাহলে আমরা অবৈধ দোকানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবো।’