পাহাড়ের মুগ্ধতা, সমুদ্রের বিশালতা, পুরনো শহরের মায়া আর নতুন শহরেরঝলমলে আলোয় ঘেরা চমৎকার দেশ ভিয়েতনাম। দেশটিতে পা দেওয়ার আগ পর্যন্ত আপনিঠিক গুছিয়ে চিন্তা করতে পারবেন না যে কী অপেক্ষা করছে আপনার জন্য। অবশ্য পাদেওয়ার পর আরও বেশি এলোমেলো হয়ে যেতে পারেন! কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখবেন এইচিন্তায়। অসম্ভব সুন্দর সাজানো গোছানো দেশটির পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে ভীষণমুগ্ধতা। সম্প্রতি ভিয়েতনামের বেশ কয়েকটি শহর ঘুরে এসেছি। ভিয়েতনামবাসীরাখুবই অতিথি পরায়ন, অন্তত আমার অভিজ্ঞতা সেটাই বলে। হ্যাঁ, ভিয়েতনাম ভ্রমণেরপর্বগুলোতে আমার অভিজ্ঞতাই ভাগ করবো পাঠকদের সঙ্গে। পাশাপাশি জানাবো কোথায়থাকবেন, কী খাবেন, কোথায় ঘুরবেন। এর আগের পর্বগুলোতে জানিয়েছিলাম ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয় শহর, হা লং বে এবং হই আন শহর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। আজকে জানাচ্ছি ভিয়েতনামের অন্যতম আকর্ষণ বা-না হিলস ভ্রমণের গল্প। ভিয়েতনামে গেলে অবশ্যই মিস করবেন না এই ফ্রেঞ্চ কলোনিতে ঢুঁ মারতে।
সাঁই করে যাত্রা শুরু করলো ক্যাবল কার। এক ধাক্কায় দুই পাহাড়ের মাঝে! আঁতকে উঠতে উঠতে দেখি পাহাড়ের বুকে ঝরনা ঝরছে। দূরে রৌদ্র ঝলমলে পাহাড়, সবুজের সে কত রং! নিচে গহীন জঙ্গল। যত দূর চোখ যায় লম্বা ক্যাবল। একটির পর একটি কার যাচ্ছে। প্রকৃতি দেখতে দেখতে পথ চলেছি। প্রচণ্ড গতির ক্যাবল ক্যারের থামার নাম নেই! কখনও উঁচুতে উঠছি, কখনও নেমে যাচ্ছি। কখনও মেঘের মধ্যে হারিয়ে কাঁপছি ঠকঠক, আবার কখনও ঝলমলে রোদ ছুঁয়ে যাচ্ছে। প্রায় বিশ মিনিট একই গতিতে চলার পর মনে হলো এই কার কি আদৌ থামবে! তখনই দেখি সামনে স্টপেজ। পরে জেনেছি, এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় এক তারে ভর দিয়ে চলা ক্যাবল কার। বলছিলাম ভিয়েতনামের বা-না হিলস ভ্রমণের গল্প। যে চমকটা শুরু হয়েছিল ক্যাবল কার থেকে, সেটা সারাদিনই ফিরে ফিরে এসেছে। এক অসম্ভব সুন্দর আর সাজানো গোছানো রাজ্যের নাম বা-না হিলস।
পাহাড়ের পর পাহাড় পাড়ি দিয়ে আমরা যখন বা-না হিলসে নামি, তখন সকাল সাড়ে এগারোটা। সবুজ দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়া আমরা হঠাৎ দেখি চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আস্ত এক শহর। যেন পাহাড়ের চূড়ায় মাটি ফুঁড়ে হঠাৎ বেরিয়ে আসা ইট-পাথরের এক আধুনিক দুনিয়া! বিশাল বিশাল অট্টালিকাগুলো দেখে মনে হবে যেন মেঘের উপর বাড়ি সাজানো।
হ্যাট মাথায় ইতিউতি ঘুরে বেড়ানো মেমসাহেব, ধূলিকণাহীন ঝকঝকে রাস্তাঘাট, ফুলে ফুলে ছেয়ে যাওয়া বাড়ি কিংবা সেই পুরনো আমলের গাড়ি। ঠিক যেন সিনেমায় দেখা বিলেতি কলোনি। আবার সেই ছোটবেলায় পড়া রূপকথার গল্পের বইয়ের রাজা-রাণীর বিশাল রাজ্যের সঙ্গেও মিল পাবেন বেশ। অসংখ্য অট্টালিকা আর ক্যাথেড্রাল রয়েছে এখানে। মধ্যযুগের ফরাসি অধ্যুষিত গ্রামের ছোঁয়া পুরো বা-না হিলস জুড়ে।
হিল স্টেশনটি ১৯১৯ সালে ফরাসি উপনিবেশবাদীরা প্রতিষ্ঠা করেছিল। ২০১৩ সালে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয় বা-না হিলস। ভিয়েতনামের ডা নাং শহরের পশ্চিমে অবস্থিত এই পর্যটক স্থানটি। এখান প্রবেশ করতে আপনাকে গুণতে হবে সাত লাখ ডং।
বা-না হিলসের পরতে পরতে আনন্দের সব উপকরণ ছড়ানো ছিটানো। একদিকে চলছে নাচ-গান। দর্শকরাও অংশ নিতে পারবেন এ আয়োজনে। পাশেই রণপা লাগিয়ে হেঁটে যাচ্ছে কেউ। আবার একটু সামনে গেলেই হয়তো দেখতে পাবেন জোকারের অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা।
ফুল যে কত রঙের হতে পারে, সেটা বুঝি বা-না হিলসে পা না দিলে জানতামই না! প্রতিটি অট্টালিকার সামনে ফুলের ঝাড়। পুরনো সব গাড়ির বনেটে ফুটেছে রঙিন ফুল। রাস্তা দিয়ে হাঁটলে দেখবেন লাল, নীল, গোলাপি ফুলেরা কতভাবেই না সাজিয়ে রেখেছে জায়গাটিকে। পুরো বা-না হিলসের ভিউ পেতে চাইলে চার্চের সিঁড়ি বেয়ে আপনাকে উপরে উঠতে হবে।
উঁচুতে দাঁড়িয়ে দেখবেন কীভাবে অট্টালিকার পর অট্টালিকা সাজানো শহরকে কখনও ঢেকে দেয় মেঘ, কখনও মেঘ সরে গিয়ে ঝলমলে রোদ এসে পড়ে। পাহাড়ের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে দেখতে পারবেন ছন্নছাড়া মেঘের দলের ছুটাছুটি। বাগান আর ভাস্কর্যে চমৎকার সাজিয়ে রাখা বা-না হিলসের প্রতিটি কোণা। এখানে রয়েছে রেস্টুরেন্ট, পার্ক। রয়েছে রিসোর্টও। তবে কেবল ভিয়েতনামের নাগরিক হলে তবেই সেখানে রাত্রিযাপনের সুযোগ মিলবে।
মুগ্ধ হবেন পাহাড় ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা পাথুরে হাতের উপর দাঁড়িয়ে থাকা গোল্ডেন ব্রিজ দেখে। ব্রিজটি তখনও নির্মাণাধীন ছিল, সম্প্রতি পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে ব্রিজটি। বা-না হিলসের এই সেতুটি ৪৯০ ফুট দীর্ঘ। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে গিয়ে থেমেছে সেটি।
পড়ন্ত বিকেলে বা-না হিলস থেকে ফিরলাম একইভাবে তার বেয়ে। শেষ বিকেলের রোদ্দুরে তখন ঝলমল করছে পাহাড় জুড়ে ছড়িয়ে থাকা আশ্চর্য এক সভ্যতা- বা না হিল।
আরও পড়তে পারেন: রঙিন বাতির শহরে...
মুগ্ধতার নাম হা লং বে
যে শহর ঘুমায় না কখনও