X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১
সূর্য উৎসব ২০১৬

সূর্যের সঙ্গে বর্ষবরণ

ফারুখ আহমেদ
০৫ জানুয়ারি ২০১৬, ২১:২১আপডেট : ০৫ জানুয়ারি ২০১৬, ২১:৩৫
image

সূর্য উৎসব সবাই বোল্ডারের ওপর দাঁড়িয়ে, এখানে বোল্ডার ফেলে নদী ভাঙ্গন ঠেকানো হয়েছে। সামনে যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু পানি আর পানি। নদীর শেষ কোথায় বোঝার উপায় নেই। নিবিষ্ট মনে চেয়ে চেয়ে এক সময় হলুদ গোলাকার একটি বস্তুর উপস্থিতি লক্ষ করতেই বোঝা হয়ে যায় সূর্যোদয় হচ্ছে! সূর্য ওঠার আলামত টের পেয়ে সবাই সচকিত। এবার দৃষ্টি প্রসারিত হয় দূর আকাশের গায়ে। পঞ্চাশ জনের দল। সবার মাথায় সূর্যের আদলে বানানো ক্যাপ, হাতে কাগজের নৌকা। কেউ কেউ বেলুন নিয়ে প্রস্তুত। যেই সূর্য তার তেজ ঢেলে দিল, সঙ্গে সঙ্গে কাগজের নৌকা, কেউ কেউ বেলুন ভাসালো সবাই মেঘনার জলে। সেই সঙ্গে চিৎকার ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার!’ এভাবেই বছরের প্রথম সূর্য বরণ হল।

সূর্য উৎসব ১

এরমধ্যেই সূর্যের আলোয় ঝলমল করে উঠেছে মেঘনার বুক। অপূর্ব সে দৃশ্য। একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে অভিযাত্রী দল। নগর সভ্যতার আধুনিক বর্ষবরণ উদযাপণ ধারাকে তুড়ি মেরে বছরের প্রথম সূর্যকে আলিঙ্গন করতেই এই উৎসব আয়োজন। যেখানে এই আয়োজন সে যায়গার নাম বেতুয়া। মেঘনা নদী যেখানে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে, তার কাছাকাছি মোহনা সংলগ্ন ছোট্ট স্থলভূমি। বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিনের চর ফ্যাশন এলাকায় অবস্থিত বেতুয়া বনকেন্দ্র। ম্যানগ্রোভ বন তৈরির কাজ শুরু হলেও নদীর প্রবল ভাঙ্গনে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১৬ সালের প্রথম দিনের সূর্যকে বরণ করে নিতে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনোমিকেল অ্যাসোসিয়েশন এই যায়গাটিই বেছে নেয়।

সূর্য উৎসব ২

যাত্রা শুরুর দিন ৩০ ডিসেম্বর। ফারহান-৫ লঞ্চ যাত্রা শুরু করে রাত ৮ টায়। সাড়ে ৮ টায় মহাকাশ মিলন নামে খ্যাত মশহুরুল আমীন মিলনের ব্রিফিং এবং পরিচয় পর্ব শেষে যে যার কেবিনে আশ্রয় নিল। স্থপতি আসিফুর রহমান, চিকিৎসক নাজমূল হক, আবুজাফর স্বপন, অজয় সরকারসহ আমি থেকে গেলাম লঞ্চের ডেকে। আড্ডায় আড্ডায় পোস্তাগোলা সেতুর পর মুক্তারপুর সেতু পার হতেই শীতের তীব্রতা বেড়ে গেল, আমরাও কেবিনের বাসিন্দা হলাম। এরমধ্যে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। তারপরের স্মৃতি বিস্মৃত। শুধুই দুচোখ রাজ্যের ঘুম দখল করা। সে ঘুম ভাঙ্গে লঞ্চ শ্রমিকদের হৈচৈ আর চেঁচামেচিতে। বুঝতে পারি আমাদের গন্তব্য বেতুয়া এসে গেছে। লঞ্চ থেকে নেমে সোজা আয়শাবাগের দিকে হাটা ধরি। বেড়িবাঁধ পর্যন্ত পুরো পথটাই চড়াই। সে পথ ধরে এক মাইল এগুলেই আয়শাবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এলাকার নাম আয়শাবাগ হলেও কেউ কেউ বদ্দার হাট বলেন। আয়শাবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিই হলো দুদিনের জন্য আমাদের আস্তানা। এলাকার আশেপাশে ধানক্ষেত আর বসতি। এখানে চর এলাকার কোনও সুবাস নেই। তাতেই বোঝা হল এই এলাকা উন্নত বা সমৃদ্ধ হয়েছে বহু আগে। অনেকের মতে সে প্রায় চারশ বছরের ঘটনা। এখানে নদী ফুলে ফেঁপে ওঠে বারবার, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এখানে স্বাভাবিক ঘটনা। আয়শাবাগের পাশেই বদ্দার হাট বাজার আর বেতুয়া বনকেন্দ্রের পাশে আসলামপুর ইউনিয়ন। পুরো এলাকায় নিম্ন আয়ের লোকজনের বসবাস। আসলামপুর আর বেতুয়ার আশেপাশের এলাকা জেলে পল্লী হিসেবে খ্যাত। আমরা ব্যাকপ্যাক রেখে সকালের নাস্তা খেয়েই বের হয়ে পড়লাম। সোজা বেতুয়ার দিকে গিয়ে বামে মোড় নিয়ে আধা ঘন্টা হেঁটে চলে আসি চরমাদ্রাজ।

সূর্য উৎসব ৩

চরমাদ্রাজে পা দিয়ে যে শব্দটা মনে পড়ল তা হলো ‘ভয়ংকর সুন্দর!’ প্রতিনিয়ত জীবন যেখানে বিপদসংকুল আর ঝুঁকিপূর্ণ তাকে ভয়ঙ্কর না বলে আর কি বলি! আর সে ভয়ঙ্করের পাশাপাশি সুন্দর ব্যাপারটা চলে আসলে ভয়ঙ্কর সুন্দরই তো হবে! আমরা মাদ্রাজ চরে পৌঁছে এখানকার জেলেদের জীবন-জীবিকা দেখি। তারপর মেঘনার তীরে গিয়ে বসি। এখানকার পরিবেশ মন শান্ত করে দেয় এক নিমেষেই। সেদিন বিকেলটা কাটাই আমরা বেতুয়া বনকেন্দ্রে। এখানে বসেই দেখি বছরের শেষ অস্তগামী সূর্য। পশ্চিম দিগন্তের বৈরাগী বেশ আমাদের মনেও। সূর্য অস্তাচলে যেতেই শুরু হয় বর্ষ বিদায় প্রস্তুতি। আজকের পর ২০১৫ হবে অতীত!

সূর্য উৎসব ৪

রাত ১১ টায় মঙ্গল দ্বীপ জ্বালানোর আগে একঘন্টার মহাকাশ নিয়ে আলোচনা ও কুইজ পর্ব চলে আনন্দমুখর পরিবেশে। রাত বারোটা বাজতেই শুরু হয় ফানুস ওড়ানো। সে রাতে ফানুস উড়ে চলে আর তার পেছন পেছন ছুটে চলে এলাকাবাসী। ফানুস ওড়ানো শেষ হলে স্কুলের মাঝখানে আগুন জ্বালিয়ে পোড়ানো হয় ৭ কেজি ওজনের বিশাল কোরাল মাছ। মাছটি কিনে আনা হয়েছিল ঢালচর থেকে। সে মাছ খেয়ে আর গানে গানে সবাই কখন ঘুমাতে গেলাম সে কথা মনে নেই। তবে ভোর ছয়টা বাজতেই সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হয় সে কথা বেশ মনে আছে। তারপর সদলবলে হন্টন মেঘনার তীরে। কুয়াশা ভেদ করে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে একদল অভিযাত্রী। মেঠো পথ ধরে ভোরে কতদিন পর সবাই এভাবে হাঁটলেন সেদিনের কথা অনেকেই মনে করতে পারলেন না। পথের শেষ প্রান্তের ডান দিকে নারকেল বাগান। তারপর মেঘনা নদী। পায়ে পায়ে সবাই চলে এলাম মেঘনার তীরে। সামনে এখন বিশাল মেঘনা নদী। তখনও সূর্যোদয় ঘটেনি। সবাই দৃষ্টি প্রসারিত করলাম আকাশ পানে। এভাবেই এক সময় সূর্যোদয় হলো। যে গল্প শুরুতেই বলেছি।

সূর্য উৎসব ৫

সূর্য উৎসব আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে নতুন সংস্কৃতি। বছরের প্রথম সূর্যকে বরণ করে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন কে জানা, নতুন কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয়। মেঘনার পারে বছরের প্রথম সূর্যকে বরণ করে নেয়ার পর পুরো বেতুয়া বনকেন্দ্র হয়ে ওঠে আমাদের বিচরণক্ষেত্র। প্রথমদিন লঞ্চ থেকে নামার সময় খেয়াল করিনি। সেই সকালে বেতুয়া বনকেন্দ্র দেখে সবাই মুগ্ধ। পুরো এলাকায় সারি সারি নারিকেল গাছ আর বোল্ডার ফেলে তৈরি বাঁধের সঙ্গে সামনে বিশাল মেঘনা নদী মুগ্ধতা জাগানো। আশেপাশে কোনও ঘরবাড়ি নেই। বহুদূরে বিন্দুর মত দেখা যায় মনপুরা দ্বীপ। অনেকেই সে দ্বীপে যাবার বায়না ধরে বসল। আজ বেতুয়ার শেষ দিন। সুতরাং দূরে কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে স্কুলে চলে এলাম। স্কুলের ছাত্রদের বছরের প্রথমদিনই নতুন বই দেয়া হচ্ছিলো। এমন উৎসবমুখর পরিবেশে আমরা আয়োজন করলাম চিত্রাংকন প্রতিযোগিতার। আকাশে উড়ল ঘুড়ি। তারপর যে যার মতো ঘুরতে বের হলাম। মিনার টাওয়ার দেখতে কেউ চলে গেলে চরফ্যাশন। কেউ কেউ আবার আসলামপুর জেলে পল্লীর পথ ধরলেন। ঘড়ির কাটায় সময় বেঁধে দেয়া ছিল। দুপুর দুইটার মধ্যে সবাই স্কুলে চলে এলাম। এবার ব্যাকপ্যাক গোছানো। তারপর দুপুরের খাবার খেয়ে আয়শাবাগকে পেছনে ফেললাম। বেতুয়া ও আয়শাবাগ ছিল এবার সূর্য উৎসবের জন্য নতুন যায়গা।

সূর্য উৎসব ৬

১৫ বছর ধরে চলছে সূর্য উৎসব, আগামী বছর ষোলকলা পূর্ণ হবে। এভাবেই চলার আনন্দে, জানার আনন্দে, শেখার আনন্দে দেখার আনন্দে চলবে এ উৎসব। নতুনকে জানা তবু শেষ হবে না।

সূর্য উৎসবের মিডিয়া পার্টনার ছিল চ্যানেল আই। এছাড়া বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে চাই দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক সমকাল, চ্যানেল আই, বাংলা ট্রিবিউন এবং চর কুকরি মুকরির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবুল হাশেম মহাজনের কাছে।

লেখক: কো-অর্ডিনেটর, সূর্য উৎসব ২০১৬

 

/এনএ/


সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী