X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাইকেলে পাহাড় জয়

ছোটন হক
১৩ মার্চ ২০১৬, ১৮:৩৫আপডেট : ১৩ মার্চ ২০১৬, ১৯:০০
image

সাইকেলে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পথে

পাহাড় আমার খুবই পছন্দের। অনেকদিন ধরে বান্দরবান যাওয়ার ইচ্ছা ছিল,আগে কখনও যাওয়াও হয়নি। ঠিক করেছিলাম গেলে সাইকেলসহ যাব। এর মাঝে একদিন খবর পেলাম থানচি থেকে আলীকদমের ২৫০০ ফিট উচু রাস্তাটা বানানো শেষ হয়েছে। প্ল্যান করছিলাম যাওয়ার। এরমধ্যে দেখি আমার প্রিয় গ্রুপ ট্রেকারস অফ বাংলাদেশের ইভেন্ট- সাইকেলে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পথ পাড়ি দিয়ে বান্দরবন থেকে কক্সবাজার। সঙ্গে সঙ্গে আমি আর আমার বড় ভাই রায়হান ২ জনই কনফার্ম করে ফেললাম। ২ জুন রাতের বাসে আমরা সাইকেল বাসে নিয়ে রওনা হয়ে গেলাম বান্দরবানের পথে। ভোরে পৌঁছলাম। রাইড শুরু হলো একটা ছোট আপহিল দিয়ে। এটা পার হওয়ার পর বুঝলাম খবর আছে! একটু সামনে যাওয়ার পর দেখলাম রাস্তা উপরের দিকে চলে গেছে। সাইকেল নিয়ে উপরের দিকে উঠতে হবে। শুরু হলো আপহিল উঠা। রাস্তা ঘুরে ঘুরে শুধু উপরের দিকে উঠছে। এ ওঠার যেন শেষ নেই। প্রচণ্ড গরমে সামনের ও পেছনের গিয়ার ১/১ রেখে উঠতে গিয়ে সবার হাঁসফাঁস অবস্থা। এক এক কিলোমিটার পার হতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। আবার কয়েক কিলোমিটার পরপরই বিশ্রাম নিতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে একটু ডাউনহিল পেলেই সবার মাঝে আনন্দের উল্লাস শুরু হচ্ছে। এভাবে আমি, আলাউদ্দিন ভাই, রানা ভাই ও রঞ্জু ভাই এগিয়ে চলছিলাম। দলের অন্য সবাই যার যার সুবিধা মত চলছিল। কেউ আপহিল হেঁটে উঠছে আর আমরা চালিয়ে উঠছি। এভাবে অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে ২৪ কিলোমিটার পরে পৌঁছলাম চিম্বুক পাহাড়। যেহেতু আমরা থানচি ও লামায় তাঁবুতে থাকবো তাই সবার তাঁবুসহ বাবু ভাই, রুহুল ভাই ও ফাহিমা শিপু ভাবী আগেই চান্দের গাড়িতে করে রওনা দিয়েছিলেন। চিম্বুক পার হয়েই উনাদের সাথে দেখা হয়ে গেল। পায়ে আঘাত পাওয়ার কারণে সাইকেল নিয়ে আসেননি বাবু ভাই। তাই মন খারাপ করে গাড়িতে বসে আছেন। এভাবে আরও উঁচু পাহাড়ে উঠতে উঠতে ৪৫ কিলোমিটার পাড়ি দেওয়ার পর নীলগিরিতে  পৌঁছলাম। নীলগিরির রূপ দেখে পাগল হয়ে যাওয়ার অবস্থা। বহুদূর পর্যন্ত শুধু খোলা দিগন্ত দেখা যাচ্ছে। এখানেই দুপুরের খাবারের আয়োজন করা হলো। এর মধ্যে তুরিন ভাই অসুস্থ হয়ে হাল ছেড়ে দিলেন। খাওয়া শেষে একটু রেস্ট নিয়ে আমি আর আলাউদ্দীন ভাই রওনা দিলাম। গ্রুপের অনেকেই তখন নীলগিরি পৌঁছেছে। বাবু ভাই ঠিক করলেন তুরিন ভাইয়ের সাইকেল চালাবেন। একসঙ্গে  ৩ জন রওনা হয়ে গেলাম। একটু সামনে গিয়ে জীবননগর পাহাড় দেখে তো অবাক! এত খাড়া আপহিল! যাই হোক, গিয়ার ১/১ করে জিকজ্যাক করে ওঠা শুরু করলাম। একটা ট্রাক আসছে পুরা রাস্তা জুড়ে। ট্রাককে সাইড দিতে গিয়ে পড়ে গেলাম। অবশেষে ১ মিনিট হেঁটে পা একটু ঠিক হলে আবার ওঠা শুরু করলাম। অনেক কষ্টে পৌঁছলাম পাহাড়ের উপরে। এবার একটু এগিয়ে ডাউনহিল দেখে দমে গেলাম। খুব ঢালু, তার মাঝে রাস্তা বাঁক নিয়েছে একটু পরপর।খুব সাবধানে টানা ১৫ মিনিট ব্রেক ধরে ধরে নেমে একেবারে নিচে পৌঁছে গেলাম। নেমেই রোটরে পানি ঢাললাম। সমতলে এক আদিবাসীর দোকানে কলা চা খেয়ে আবার রওনা হলাম। ছোট বড় আপহিল ডাউনহিল পাড় হয়ে সারাদিনে ৭৭ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে থানচি পৌঁছলাম। রাতে থানচিতে তাঁবুতে রাত্রিযাপন করলাম। পরদিন সকাল ৬টায় থানচি থেকে রওনা হয়ে গেলাম। প্রাণ ভরে চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখে রওনা হয়ে গেলাম আলীকদমের পথে। মাইলস্টোনে লেখা আলীকদম ৩৩ কিলোমিটার। এখান থেকে একটু সামনে যেয়েই একটা ডাউনহিল শুরু হলো।

সাইকেলে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পথে

ডাউনহিল শেষেই শুরু হলো সেই দীর্ঘ আপহিল। অনেক দূর থেকে পাহাড়ের শরীর বেয়ে ওঠা আপহিল দেখে রক্ত হিম হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। কোন রকমে এভাবে আপহিল ও একটু ডাউনহিল শেষ করে  ৪ কিলোমিটার পার হলাম। এরপরে যে আপহিল পেলাম এটা এত বেশি খাড়া উঠতে গিয়ে চাকা স্লিপ করে পড়ে গেলাম। আবার চেষ্টা করে দেখি সাইকেলের ব্যালেন্স রাখা যাচ্ছে না। এই খাড়া জায়গা ১০ মিটারের মত হেঁটে পার হয়ে দেখি সামনে ঝিরি থেকে ঠান্ডা পানি বের হচ্ছে। পানি দেখে সবাই থেমে পানি সংগ্রহ করলাম। তীব্র গরমে এত ঠান্ডা পানি দেখে সবাই প্রচুর পানি পান করলাম। তারপর আবার উপরে ওঠা শুরু। প্যাডেল মেরে মেরে কয়েকবার রেস্ট নিয়ে টানা ৬ কিলোমিটারের মতো আপহিলে উঠলাম, এরপর শুরু হলো বৃষ্টি। সবাই যেন স্বস্তি পেলাম। আরো ১কিলোমিটারের মতো আপহিল এগিয়ে দেখি মেঘের দেশে এসে পড়েছি। আমাদের চারপাশে মেঘ। মুগ্ধ হয়ে মেঘ দেখার জন্য চা দোকানে বসে পড়লাম। অনেকটা সময় মেঘের সাথে কাটিয়ে মেঘের ভেতর দিয়েই ডিম পাহাড়ের চূড়ার দিকে উঠা শুরু করলাম। আবার আপহিল চালিয়ে ওঠা শুরু হলো। একটু পর একটি সমতল যায়গায় পৌঁছলাম। চারপাশে মেঘ আর একটা কুড়েঘরের মতো বানানো , সামনে পেছনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আমরা এটাকে ডিম পাহাড় ভেবে বসে থাকলাম। ভাবলাম সামনে ডাউনহিল, তাই মেঘ সরার অপেক্ষায় থাকলাম। মেঘ সরে যেতেই সামনে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম! কোথায় ডাউহিল! বিশাল এক আপহিল অপেক্ষা করছে। হতাশ মনে কষ্ট করে আবার এই আপহিল চালিয়ে ওঠার পর বুঝতে পারলাম আমরা ডিম পাহাড়ে পৌঁছেছি। সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম। আমরা সাইকেলে ডিম পাহাড় সামিট করছি। একটু পর রুহি ভাই আসলেন। রুহি ভাইয়ের জিপি এস দিয়ে মেপে দেখলাম প্রায় ২৮২২ ফিট উপরে আছি। কিছুক্ষণ পর আবার রওনা হলাম এবং নিজেকে প্রস্তুত করলাম জীবনের সবচেয়ে বিপদজনক মূহূর্তের জন্য। এত উপর থেকে সাইকেলে নামতে হবে! যাই হোক আমি, বাবু ভাই আর আলাউদ্দিন ভাই ব্রেক চেপে পাহাড়ি বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় ঢাল বেয়ে নামা শুরু করলাম।

সাইকেলে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পথে

গ্রুপের সবাই তখনও একটু পেছনে। ঢালগুলো খুব খাড়া। দুইটা ব্রেক একসাথে ধরেও গতি সামলানো যাচ্ছে না। এরমধ্যে আবার কখনও রাস্তা বিপদজনকভাবে বাঁক নিয়েছে। মাঝে মাঝে সোজা ডাউনহিল পেয়ে একেবারেই ব্রেক ছেড়ে দিয়েছিলাম।সর্বোচ্চ গতি হয়েছিল ৫৯ কিমি/ঘণ্টা। এভাবে প্রায় ৬-১০ কিলোমিটার শুধু নিচের দিকেই নেমেছি। বুঝতে পারছিলাম অনেক নিচে নেমে যাচ্ছি। আবার অল্প একটু উঠছি,আবার নেমে যাচ্ছি। এভাবে করে দুপুর ১টায় ৩৩ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে আলীকদমে  পৌঁছলাম। সবার মধ্যে একটা আনন্দ অনুভূতি কাজ করছিল। এটা সাইকেলে পাহাড় জয়ের অনুভূতি। আমরা পেরেছি। বিশেষ করে আমার লক্ষ্য ছিল আমি সব পাহাড়ই সাইকেল চালিয়ে উঠবো। সেটা পেরেছি আমি। আমরা আলীকদমের একটু সামনে পরিচিত এক রেস্ট হাউজে দুপুরের খাবার খেয়ে বিকেলে লামাতে পৌঁছলাম। লামাতে একটা রেস্ট হাউসের ছাদে তাঁবু খাটিয়ে ঘুমালাম। পরদিন রওনা হয়ে গেলাম কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। ভেবেছিলাম আপহিলের হাত থেকে বেঁচেছি। পথে নেমে শুনি আরো ১৫০০ফিট উচু একটা পাহাড় পার হতে হবে! সবার মুখ কালো হয়ে গেল। একটু এগিয়ে সেই আপহিলের দেখা পেলাম। শরীফ ভাই, আমি, বাবু ভাই, রাহাত ভাই, রিদয়- আমরা সবাই দাঁতে দাঁত চেপে আপহিলে উঠতে শুরু করলাম। একটু উঠে নাস্তার পর্ব সেরে নিয়ে পানি ভরে নিয়ে রওনা হলাম আবার। অনেকটা পথ ওঠার পর ডাউনহিলের দেখা পেলাম। মুখে হাসি নিয়ে সবাই নামা শুরু করলাম। হঠাৎ একটা মোড় পার হয়ে দেখলাম একটি বাস এগিয়ে আসছে। আমি জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। থানচি আলীকদম রোডে কোন গাড়ি না চললেও এই রোডে চলে, আমরা সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম। আমার পেছনে থাকা রেজা ব্রেক করে থামতে পারলেও বাবু ভাই পারলেন না। হার্ডব্রেক করে তাল হারিয়ে পড়ে গেলেন। বাবু ভাই কে সবাই ধরাধরি করে উঠালাম। একটু এগিয়ে ফাসিয়াখালিতে ফার্মেসি পাওয়া গেল ঐ পর্যন্ত বাবু ভাইকে ব্যথা পাওয়া পা নিয়েই কষ্ট করে চালাতে হল সাইকেল। তারপর বাবু ভাই গাড়িতে উঠে গেলেন। আমি, মিনহাজ ভাই, রাহাত ভাই, আলাউদ্দিন ভাই ও তুরিন ভাই কক্সবাজারের দিকে রওনা দিলাম। তখনো ৫৩ কিলোমিটার বাকি। রঞ্জু ভাই আর রেজা আগেই রওনা হয়ে গিয়েছিল। আমি মিনহাজ ভাই ,তুরিন ভাই একটা এভারেজ গতিতে চালানোর কারনে ১২টায় কক্সবাজার পৌঁছে গেলাম। সাইকেল নিয়ে একেবারে সী-বিচ চলে গেলাম। সারাদিন কাটিয়ে রাতের গাড়িতে ঢাকা রওনা হলাম।

সাইকেলে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পথে



/এনএ/ 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ইউক্রেনের অন্তত ৭টি প্যাট্রিয়ট সিস্টেম প্রয়োজন: ন্যাটোকে জেলেনস্কি
ইউক্রেনের অন্তত ৭টি প্যাট্রিয়ট সিস্টেম প্রয়োজন: ন্যাটোকে জেলেনস্কি
শিশু হাসপাতালে তিন দিনের ব্যবধানে দুবার আগুন!
শিশু হাসপাতালে তিন দিনের ব্যবধানে দুবার আগুন!
ব্যাংককে চীনের দাবাড়ুকে হারালেন মনন
ব্যাংককে চীনের দাবাড়ুকে হারালেন মনন
ব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
এনার্জি মাস্টার প্ল্যান সংশোধনের দাবিব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
সর্বাধিক পঠিত
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান