X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১
জন্মদিনে

তাকে যেমন পেয়েছি

সুমাইয়া উর্মি
০৮ মার্চ ২০২৪, ০০:০০আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

জাহাঙ্গীরনগর থেকে বের হওয়ার সময় অন্তত দুজন নিজের মানুষ সঙ্গে নেওয়ার চেষ্টা করো—আমাদের স্বাগত বক্তব্যে কথাগুলো বলেছিলেন শামীম রেজা স্যার। প্রথমবারের মতো সেদিন বিভাগে পা রেখেছি। সুন্দর ছিমছাম এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাস। জাহাঙ্গীরনগরের শীত জড়িয়ে শিশিরে পা গলিয়ে উপস্থিত হয়েছি বিভাগে। চটের উপর অদ্ভুত সুন্দর সব নকশা করে সাজানো হয়েছে বিভাগ। দেয়ালে ঝুলছে নানান মনীষীর বক্তব্য আর পায়ের নিচে আলপনা। এমন শুভ্র, স্নিগ্ধ স্বাগত পেয়ে সত্যিই অভিভূত হয়েছিলাম। উপহার হিসাবে পেয়েছিলাম হুমায়ুন কবিরের লেখা ‘বাংলার কাব্য’। ছোট্ট করিডোরে গুটিকয়েক মানুষের আনাগোনা দিয়ে শুরু হয় বাংলাদেশের তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক পথচলা। সকলের আন্তরিকতা আর ভালোবাসার জন্যই বোধহয় এতো বছর পরও প্রথম দিনের সেই অনুভূতিগুলো আজও এতো সতেজ! সেদিন স্যারের ঐ কথাটার অর্থ বুঝতে পারিনি ঠিকই কিন্তু মনে গেঁথে গিয়েছিল। তারপর দিন যত গিয়েছে ততই স্যারের শব্দগুলো ধোঁয়াশা পেরিয়ে বাস্তব হয়ে ধরা দিতে শুরু করে। জাহাঙ্গীরনগরের মতো এমন বৈচিত্র্যময় গোলকধাঁধায় নতুন এক প্রাণের আগমনে এরচেয়ে ভালো আর কী বলা যেতো আমার জানা নেই। আজ প্রায় ৬ বছর পর বুঝি অন্তত দুজন আপন মানুষ নিয়ে বের হওয়া কতটা কঠিন। স্যার হয়ত কথাগুলো নিজ যাপনের অভিজ্ঞতা থেকেই বলেছিলেন। বন্ধু পাগল মানুষ তিনি। মানুষজনের সাহচর্যে থাকা, তাদের নিয়ে নতুন কিছু করা, সাহিত্যচর্চা, কবি ও কবিতার আলোচনা—এসব দিয়েই ঘিরে রাখেন নিজেকে। নিভৃতচারী শুধু কবিতার টেবিলে, দরজা খুলে বেরিয়ে আসলেই তিনি হয়ে ওঠে অনেকের অভিভাবক, কারো বড়ভাই বা স্নেহের অনুজ। গুণী মানুষের সঙ্গও যে মানবমনের তৃপ্তির যোগানদাতা তার সন্ধান পেয়েছি এখানে আসে। সাহিত্যের সাক্ষাৎ পূর্বে পেয়ে থাকলেও এমন অন্তরঙ্গতার সূচনা এখান থেকেই। নানান লেখক, তাদের নতুন বই, জীবনকে যাপন, সাহিত্যের প্রতি ভাঁজে লুকিয়ে থাকা রসের সন্ধান পেতে প্রয়োজন যোগ্যতর কোনো গুরুর। যিনি নিজ যাপনের অভিজ্ঞতার ছোঁয়ায় উন্মোচন করেন অন্তর্দৃষ্টি, প্রজ্ঞার তৃষ্ণা।

ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসে প্রশ্নপত্রের উপর দুটো লাইন দেখে চোখ আটকে গেল—

‘চোখে দেশ নাই ঘরে দোর নাই মাটি পরদেশি
দেহে মন নাই মনে খুন খোঁজে খুনি প্রতিবেশী।’

সেদিন পরীক্ষার হলে বসে লাইনগুলো মুখস্থ করেছিলাম এই ভেবে যে, বাড়ি ফিরে লেখককে খুঁজে বের করে তার অন্যান্য লেখা পড়তে হবে। পরে বুঝতে পারি সেই কবির বিভাগের শিক্ষার্থী হয়েই এসেছি। ভাইবাতে স্যার বলেছিলেন—শুধু বাংলা বা ইংরেজি নয়, পড়তে হবে কিন্তু বিস্তর। উত্তরে ঘাড় নেড়ে সায় দিয়েছিলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম, সত্যিই বুঝি বিস্তর পড়াশোনা না থাকলে ওমন লাইন লেখা যায় না। কোনো কবির লেখাকে অনুভব করে স্বয়ং কবিকে সামনে থেকে দেখা, এ অনুভূতি এতো অদ্ভুত। ভাষায় প্রকাশ করার সাধ্য কী তার!

তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগে পড়তে আসে এক অন্য জগতে প্রবেশ করি। সাহিত্য বলতে তখন বইয়ের মলাটের কালো শব্দের ভেতর ধীরে ধীরে প্রাণপ্রতিষ্ঠা পেতে থাকে। কোনো দিনও আমার মনে হয়নি আমি ভুল জায়গায় এসে পড়েছি। তবে সর্বক্ষণ এক অতৃপ্তির তাড়নায় ঘুরে ফিরেছি। কত কম জানি! কত কী জানার বাকি!

এই যে জ্ঞানতৃষ্ণা, এ তৃষ্ণা জাগানোই তো একজন শিক্ষকের মূল কাজ। শামীম স্যার প্রথম বর্ষে আমাদের কবিতা পড়িয়েছেন। হাফিজ, রবীন্দ্রনাথ, ওমন খৈয়াম, নজরুল, ইয়েটস, জীবনানন্দসহ আরো কত কত নাম, কবি, কবিতা ও তাদের গল্প। স্যারের ক্লাসের বিশেষ আকর্ষণ তার গল্প বলার ঢং। কবি সাক্ষাৎ, বিভিন্ন ভ্রমণ, ব্যক্তি হিসাবে কাকে কেমন পেয়েছেন, তাদের লেখার ধরণ এসবই উনি গল্পাকারে এতো সাবলীল ভাবে বলেন! তখন বুঝতে পারিনি যে বড় হতে হতে টের পাবো এসব গল্প একেকটা সোনার খনি। কবিতার ‘টেক্সট’ পড়া যেমন জরুরি তেমনি সে কবির জীবনে ভ্রমণের চেষ্টা করাও খানিক মন্দ নয়। কবিতার এরূপ পাঠ শুধু আমাদের শ্রেণিকক্ষেই সীমাবদ্ধ ছিল না। আমাদের স্বাগত জানানোর সেই সুন্দর, ছোট্ট, ছিমছাম অনুষ্ঠানের মূল আয়োজক যেমন ছিলেন শামীম স্যার, তেমনি আমরা আসার পর থেকে আমাদের হাত দিয়ে আরো অসংখ্য অনুষ্ঠান আয়োজন করিয়েছেন তিনি। কবি শামীম রেজার  সংগঠক হিসাবে সফলতার মাঠকাঠিতে নির্দ্বিধায় আমাদের বিভাগের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। শুধু পড়াশোনা করে যে সাহিত্য ও সংস্কৃতি পাঠ সম্ভব নয় তা তিনি জানতেন। তাই লোকবল যত কমই হোক প্রথম একটা বছর আমরা অসংখ্য অনুষ্ঠান আয়োজন করেছি। তা হোক বই দিবস উদ্‌যাপন বা পহেলা বৈশাখ। বসন্ত বরণ বা যেকোনো বিষয়ের সেমিনার৷ জাহাঙ্গীরনগরের শুরুটা হয়েছিল যে জায়গাকে ঘিরে, সেই মায়াময় স্নিগ্ধ জায়গাটাতে হাতে গোনা কয়েকটি কক্ষ নিয়ে শুরু হয়েছিল আমাদের তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা। শুধু কবিতাই নয়, আমরা মহাভারতও পড়েছি স্যারের কাছে। পাশ্চাত্যের স্বকীয়তার ধারক মহাভারত নিজগুণে কতটা শ্রেষ্ঠ তার স্বরূপ স্যার আমাদের বেশ ভালোভাবেই অনুভব করিয়েছেন। তাই শুধু ক্লাস বা কোর্সে আবদ্ধ থাকিনি আমরা কেউই। নিজ নিজ আগ্রহের জায়গা থেকে প্রত্যেকেই নিজের মতো করে পাঠ করছি এ মহাকাব্য। মিল্টনের বা মধুসূদন, ইলিয়ড বা ওডিসি, যুধিষ্ঠির বা রাম কারো আলোচনায় বাদ যায়নি সেখান থেকে৷ তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগ হিসাবে সবসময়ই আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলা অঞ্চলের সাহিত্যকে আরো গাঠনিক ও শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবে পাঠ করা। আমাদের বাংলা ঘরানাকে আরো বেশি প্রতীয়মান করে তোলা। এসব যেমন একদিনের কাজ নয় তেমনি এর পেছনের আগ্রহকে বাঁচিয়ে রাখারও তেমন সহজ নয়। শামীম স্যার তার ‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’ এর মধ্যদিয়ে যেমন বাংলার ভাষাকে নিজ কবিতায় ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন, তেমনি বিভাগীয় চর্চার জায়গায় আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাংলা অঞ্চলের সাহিত্য সম্পদকে তুলনামূলক সাহিত্য পাঠপদ্ধতির মধ্য দিয়ে উপস্থাপন ও এর শক্তি অনুসন্ধান করছেন।

বকা, শাসন, স্নেহ কমবেশি সবই পেয়েছি আমরা স্যার থেকে। শিক্ষক অনেকটা বন্ধুর মতো৷ এই পরম বন্ধু আসলে জীবনের চলার পথকে আরো দৃশ্যমান করে তোলেন। শিক্ষক হিসাবে শামীম স্যার তেমনি একজন কর্মমুখী মানুষ৷ প্রথম ব্যাচ হিসাবে সবসময়ই কিছুটা বেশি আদরই পেয়েছি বোধহয়। কখনো আবার আদরে বাদুড় হয়ে গেলে তৎক্ষণাৎ কান মলে দিতেও ভুল করেননি তিনি। স্যারকে কখনো স্পষ্টস্বরে ‘না’ বলতে শুনিনি। সহনশীলতা কবি মননের অন্যতম গুণ। মানুষ শামীম রেজা, কবি শামীম রেজা, শিক্ষক শামীম রেজা বা সংগঠন শামীম রেজা তাই একে অপরের থেকে ভিন্ন। এক পরিচয়ের সাথে আরেককে না মেলানোই ভালো। বৈচিত্র্যই মানুষকে সংবেদনশীল ও গভীর করে।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
দেশ ও জাতির মুক্তির একমাত্র উপায় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন: ড. কামাল হোসেন
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
আওয়ামী লীগের অপরাধটা কী?
সর্বশেষ খবর
ডনেস্কের একটি গ্রাম দখল করলো রাশিয়া
ডনেস্কের একটি গ্রাম দখল করলো রাশিয়া
১১ অঞ্চলে বইছে তীব্র তাপপ্রবাহ, ঢাকায় বেড়েছে ২ ডিগ্রি
১১ অঞ্চলে বইছে তীব্র তাপপ্রবাহ, ঢাকায় বেড়েছে ২ ডিগ্রি
ঢাকা-রাজশাহীর ২ হাসপাতালে দুদকের অভিযান
ঢাকা-রাজশাহীর ২ হাসপাতালে দুদকের অভিযান
সরকারি চাকরির বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটিতে আবেদন করা যাবে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত
সরকারি চাকরির বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটিতে আবেদন করা যাবে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক