X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রেমের কবিতায় কবির শক্তিমত্তার পরীক্ষা : আমিনুল ইসলাম

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : ম্যারিনা নাসরীন  
১৫ জুন ২০২৩, ২৩:২২আপডেট : ১৬ জুন ২০২৩, ১১:০৩

আমিনুল ইসলাম একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক। তিনি ১৯৬৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের টিকলীচর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৭।
আমিনুল ইসলাম তার সৃষ্টিকর্মের জন্য পেয়েছেন ‘বগুড়া লেখক চক্র স্বীকৃতি পুরস্কার’; ‘নজরুল সংগীত শিল্পী পরিষদ সম্মাননা’ ‘এবং মানুষ সাহিত্য পুরস্কার’; ‘দাগ সাহিত্য পুরস্কার’; ‘কবিকুঞ্জ পদক’; ‘পূর্বপশ্চিম সাহিত্য পুরস্কার’; ‘আইএফআইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার’ এবং ‘বিন্দু বিসর্গ পদক’।



ম্যারিনা নাসরীন : পাঠক আপনাকে কী হিসেবে বেশি পছন্দ করেন? এবং কেন?
আমিনুল ইসলাম : আমি কবি হিসেবেই পরিচিত। আমার কবিতার বইয়ের সংখ্যা অন্যান্য বইয়ের চেয়ে বেশি। শিশুসাহিত্য, প্রবন্ধ ও গবেষণার প্রতি আমার সমান মনোযোগ আছে। ‘নজরুল সংগীত : বাণীর বৈভব’-এর মতো গ্রন্থও পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে।

 

ম্যারিনা নাসরীন : লেখালেখির শুরুটা কীভাবে?
আমিনুল ইসলাম : খুব ছোটোবেলায় আব্বার কাছে শুয়ে শুয়ে তার কণ্ঠে পুঁথি, কবিতা ও ছড়া শুনতাম। ক্লাসের সব কবিতাও মুখস্থ। নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় এক সহপাঠীকে ভালো লাগতো। কিন্তু বলতে পারতাম না। তাকে নিয়েই অগ্রিম বিরহের কবিতা লিখতাম। ভার্সিটি জীবনেও কবিতা ও গান লিখে ডায়েরি ভরেছি, সেটার পেছনেও প্রেমের তাড়না ছিল।

আমি চাকরি জীবনে এসে নতুন উদ্যমে লেখালেখি শুরু করি এবং সেসব ছাপার জন্য বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন, আঞ্চলিক দৈনিক ও সাহিত্য পত্রিকায় পাঠাই। তারপর কবিতার বই প্রকাশিত হয়।

 

ম্যারিনা নাসরীন : প্রথম প্রকাশিত লেখার বিষয়ে পাঠকদের কিছু বলুন।
আমিনুল ইসলাম : দৈনিক করতোয়ায় প্রকাশিত প্রথম কবিতাটির নাম ছিল ‘ঝামেলা’। এটি ছাপা হওয়ার পর অনেক প্রশংসিত হয়। কবিতাটি রংপুরের সাহিত্য সংগঠন ‘অভিযাত্রিক সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংসদ’-এর কবিতাপাঠের আসরে পাঠ করি এবং প্রচুর হাততালি পাই। কবিতাটি টেলিভিশনে এবং আরও বহু অনুষ্ঠানে পাঠ করেছি।

দুজন বাচিকশিল্পী কবিতাটি আবৃত্তি করেছেন, যা ইউটিউবে পাওয়া যায়। এটি আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তন্ত্র থেকে দূরে’-তে আছে। পরে ‘বাছাই কবিতা’তেও ঠাঁই পায়। এছাড়াও নানাজনের সংকলনে কবিতাটি স্থান পেয়েছে।

 

ম্যারিনা নাসরীন : আপনি সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। সৃজনশীল মানুষরা সাধারণত লেখার মাধ্যমেই সমাজ, রাষ্ট্র বা নানা অনৈতিক ও অনাচারের বিরুদ্ধে নিজের অব ব্যক্ত করেন। আপনি সেই সত্য প্রকাশে কতটুকু স্বাধীন ছিলেন?
আমিনুল ইসলাম : সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯–তে লেখালেখির ক্ষেত্রে কোনো বাধা রাখা হয়নি। কিন্তু সেটা কাজির গরু—খাতায় আছে, বাস্তবে নেই। কবিতা লিখে চাকরি গেছে একাধিক সরকারি কর্মচারীর।

সরকারি চাকরি করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় বহু ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেসব নিয়ে মুখ খোলা তো চাকরি-বিধিতেই নিষিদ্ধ। যখন ভেবেছি, কবিতায় সেসব তুলে ধরবো, বুঝতে পেরেছি সেটা করতে গেলে বিপদ অনিবার্য। কেবল দেশের রাজনীতি বা সরকারের কাজকর্ম বিষয়কই নয়, আন্তর্জাতিক বা ভিন রাষ্ট্রীয় অনেক বিষয়ও আছে যেসব দেখেশুনে ইচ্ছা জাগলেও তা সাহিত্যে আনা যায় না।
আমি আজ থেকে ১৯/২০ বছর আগেই একটা কবিতা লিখি ‘শৃঙ্খলিত কোকিলের গান’ নামে। এটা আমার আত্মাভিজ্ঞানের কবিতারূপ। কোকিল হচ্ছে কবি আর শৃঙ্খল হচ্ছে আইন, বিধিবিধান এবং অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ও ভীতি। সরকারি কর্মচারীর সাহিত্যচর্চা শৃঙ্খলিত কোকিলের গান করার সমতুল্য।

তারপরও আমি বহু ‍কবিতা লিখেছি দেশে-বিদেশে সংঘটিত অনিয়ম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তবে সেসব লিখেছি প্রতীকায়িত করে। কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন বিষয়টি লক্ষ্য করে আমার কবিতা নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন ‘প্রতীকী প্রতিবাদের কবি : আমিনুল ইসলাম’ শিরোনামে।

আমার কবিতার ভেতরে ‘বর্গীর রেকর্ড মোছে বিশ্বব্যাংক ধূর্তহাতে জলে ও ডাঙায়’, ‘গরিবের ঘামে রোদ লেগে চিকচিক করছে ভ্যাট’, ‘রাতরঙা ব্যাগ হাতে এক্সটার্নাল অডিট যাক মেগা প্রজেক্টের বাড়ি’, ‘মাননীয় অর্থমন্ত্রী, রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মহোদয়, দয়া করে আমাদের চুমুর ওপর ট্যাক্স বসাবেন না’, ‘আকবরের তখতে বসে শান দেয় বিভেদের দাঁত’, ‘মেরুদণ্ড এখন আল মাহমুদের কবিতার মতো বাতিল মাল’, ‘এদেশের সরকারি চাকরিতে কখন কীভাবে কেন পদোন্নতি হয়, আর কেন যে হয় না’, ‘হলমার্ক-বান্ধব সোনালী ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিট আমাদের ঠিকানা জানে না’, ‘এখন রাষ্ট্রই নবাব–রাষ্ট্রই জগৎশেঠ’ ইত্যাদি বহু প্রতীকী প্রতিবাদের লাইন আছে আমার কবিতায়।
আমি কোনো পার্টিকুলার রাজনৈতিক দল কিংবা বিশেষ কোনো রাষ্ট্রকে সরাসরি সমালোচনা করে কিছু লিখি না। সরকারি চাকরি করে সেটা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি তা শিল্পসাহিত্যের নান্দনিক সৌকর্যের পক্ষেও যায় না।

 

ম্যারিনা নাসরীন : কবিতা লিখতে গিয়ে লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো বাধা পেয়েছেন? বা প্রকাশিত লেখা সম্পর্কে কোন অভিযোগ শুনতে হয়েছে?
আমিনুল ইসলাম : বিগত ২০/২৫ বছরে আমার প্রচুর লেখা ছাপা হয়েছে। আমার জন্মদিনে বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশিত হয়েছে। তবে দু-একজন সাহিত্য সম্পাদকের অসহযোগিতা প্রায় বাধার সমতুল্য। কোনো একটি দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদক আজ অবধি আমার একটি কবিতাও ছাপেননি। অথচ তিনি আমাকে চেনেন-জানেন।

আরেকটি কথা, সাহিত্য সম্পাদকদের অফিসে আমার যাওয়া হয় না। ফলে দুএকজন সাহিত্য সম্পাদক অসহযোগিতামূলক আচরণ করেন। পেশায় আমি আমলা ছিলাম, সম্ভবত এটা তাদের ভালো লাগেনি। আমি তাদের কারো নাম বলতে চাই না।

এছাড়া আমার বেশ কিছু কবিতা দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদকরা ছাপতে অপারগতা জানিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। আমি প্রতিবাদী, কখনো-বা স্যাটায়ারধর্মী কবিতা লিখতে পছন্দ করি। ফলে দৈনিকে ছাপাতে সমস্যা তো হয়ই। দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদকরা তো চাকরি করেন। তারাও কোনো সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ নন। অবশ্য সেই ক্ষতি পুষিয়ে দেয় লিটলম্যাগ ও ওয়েবজিনগুলো।

 

ম্যারিনা নাসরীন ও আমিনুল ইসলাম ম্যারিনা নাসরীন : কবিতায় আপনি নানা ধরনের অফিসিয়াল শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন তলবীসভা, নোটিশ, এজেন্ডা, প্রজ্ঞাপন ইত্যাদি। এই সমস্ত শব্দ ব্যবহারের বিশেষ কোনো কারণ রয়েছে কী?
আমিনুল ইসলাম : আমি লক্ষ্য করেছি অফিস আদালতে খুবই পাওয়ারফুল কিছু পরিভাষা আছে অথচ সেসব কবিতায় ব্যবহৃত হয় না বললেই চলে। আমি সেগুলো সচেতনভাবে ব্যবহার করেছি প্রতীকী ব্যঞ্জনায়, নতুন চিত্রকল্প নির্মাণে এবং কবিতায় নতুন মাত্রা আনার জন্য। যেমন:

‘একবার, দুইবার, তিনবারও এসেছো কোনো কোনো দিন।

লাল ফিতা বাঁধিয়াছে সব; আমাদের বাহানা বাঁধেনি।’

আরেকটি উদাহরণ দেই:

‘কালো ঋণে দেউলিয়া ব্যাংকের মতো

আমি হারিয়ে ফেলেছি ভালোবাসার পুঁজি

দুঃখের প্রহরীরা পাহারা দিচ্ছে লুণ্ঠিত ভল্টের হাহাকার।’

অযৌক্তিক কারণে অফিসিয়াল পরিভাষাসমূহকে বাংলা সাহিত্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রথা ভেঙে কবিতার ভাষাকে সম্প্রসারিত করতে চেয়েছি আমি।

 

ম্যারিনা নাসরীন : সমালোচকেরা আপনাকে ‘শিকড়বৈভবের কবি’, ‘প্রতীকী প্রতিবাদের কবি’, ‘স্বাধীন কবি’, ‘ডিজিটাল যুগের প্রথম কবিতা রচয়িতা’ এমন আরও উপাধি দিয়ে চিহ্নিত করেছেন, বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
আমিনুল ইসলাম : আমি কবি হিসেবে এতটুকু ভাগ্যবান যে, অগ্রজ, সমসাময়িক ও অনুজরা আমার কবিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন। তারা অনেকেই আমাকে উপাধী দিয়েছেন। যেমন ড. সফিউদ্দিন আহমদ বলেছেন ‘ শিকড়বৈভবের কবি’, হাসনাত আবদুল হাই বলেছেন ‘ডিজিটাল যুগের প্রথম কবিতা রচয়িতা’, অসীম সাহা বলেছেন, ‘আধুনিকতম কবি’, জাকির তালুকদার বলেছেন ‘স্বাধীন কবি’, রেজাউদ্দিন স্টালিন বলেছেন ‘প্রতীকী প্রতিবাদের কবি’। এতে আমি আনন্দিত হয়েছি। আমার কবিতার নানা ডাইমেনশন তারা চিহ্নিত করেছেন যা আমি নিজেও করতে পারতাম না। এতে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়েছে।

 

ম্যারিনা নাসরীন : আপনি বহু কবিতায় অত্যন্ত রোমান্টিকভাবে প্রেমের উপস্থাপন করেছেন। এই প্রেমের উৎস নিশ্চয় রয়েছে। আমি আপনার সেই উৎসটি বা যার প্রতি নিবেদন হিসেবে এসব প্রেমের কবিতা সৃষ্টি, তার সম্পর্কে আপনার ভক্তকুলের কৌতূহল নিবারণ করুন।
আমিনুল ইসলাম : আসলেই আমি প্রচুর প্রেমের কবিতা লিখেছি এবং এখনও লিখে যাচ্ছি।
আমার কবিতা লেখার শুরুতে বিষয়ই ছিল প্রেম, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে একতরফা কৈশোরিক প্রেম এবং অসফল প্রেম। আমি মনের দিক থেকে প্রেমিক মানুষ। প্রেমের কবিতা ও গান আমার নিত্যদিনের সঙ্গী। সম্ভবত সেকারণে আমার অনুভবে প্রেমের ছায়া ও ছোঁয়া বেশি। আর প্রেমের কবিতা লেখাটা হচ্ছে একজন কবির শক্তিমত্তার সবচেয়ে বড়ো পরীক্ষা। ক্রিকেটারের জন্য যেমন টেস্ট ম্যাচ, কবির জন্য তেমনি প্রেমের কবিতা।

আমার জীবনটা আক্ষরিক অর্থেই প্রেমময়। নবম-দশম শ্রেণি থেকেই মূলত সহপাঠীদের ভালোবাসতে প্ররোচিত বোধ করেছি। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি শুধু এই দুবছর প্রেম ছিল না। কারণ আমাকে এইচএসসি পরীক্ষায় বোর্ডে স্ট্যান্ড করতে হবে, এমন একটা চাপ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আবারও প্রেমে পড়া। চূড়ান্ত ফল বিচ্ছেদ। চাকরিজীবনের শুরুতেই দুর্দান্ত প্রেম এবং অসাফল্য। অবশেষে অনেকটা দেরিতে বিয়ে। যাকে বিয়ে করেছি, তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। তারপরও আমার মনটা প্রচুর বদমাশ। অর্থের নেশার সঙ্গে প্রেমের নেশার একটা মিল আছে বলে আমার মনে হয়। প্রয়োজন না থাকলেও পাওয়ার নেশা উদ্গ্রীব করে রাখে মানুষকে। আমার মনটাও কেন যেন শুধু প্রেম-প্রেম করে।

 

ম্যারিনা নাসরীন : আপনার কবিতার কোন বিষয়টি আপনাকে স্বাতন্ত্র্য দান করেছে বলে মনে হয়
আমিনুল ইসলাম : আসলে এটা চিহ্নিত করবেন পাঠক ও সাহিত্য সমালোচকগণ। আমার নিজের মুখে বলা শোভন হবে না জেনেও বলছি, পাঠক-সমালোচক সকলেই আমার কাব্যভাষার স্বাতন্ত্র্যের কথা বলেছেন। শব্দ, উপমা ও চিত্রকল্প প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমার কবিতায় এক ধরনের অভিনবত্ব আছে বলে তারা বলেছেন এবং প্রচুর উদাহরণ দিয়েছেন। ড. সফিউদ্দিন আহমদ, হাসনাত আবদুল হাই, অসীম সাহা, সৌম্য সালেক, জোয়ানা জেসমিন প্রমুখ লেখকগণ এ বিষয়ে খুঁটিনাটি আলোচনা করেছেন।

আমি নিজেও মনে করি, আমার কবিতার ভাষা সমসাময়িক কোনো কবির কাব্যভাষার সঙ্গে মিলবে না। তাছাড়া আমার নিজস্ব কাব্যভাবনাও আছে।

 

ম্যারিনা নাসরীন : আপনার লেখায় অন্য কোনো কবির প্রভাব আছে বলে মনে হয়?
আমিনুল ইসলাম : আমি সচেতনভাবে চেষ্টা করি যাতে আমার কবিতা কারো কবিতার মতো না হয়। সেজন্যই নব্বই দশকের কবি হওয়া সত্ত্বেও আমি নব্বই দশকের ফতোয়া হুবহু অনুসরণ করিনি। কিন্তু কোনো কবিই সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো নয়। তিনি নয় কোনো আনকোরা নতুন অস্তিত্ব। তার পেছনে এবং সাথে আছে কবিতার বহু বিস্তৃত ভূগোল। মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, ফররুখ আহমদ, জসীমউদদীন, আল মাহমুদ, আবুল হাসান, আবিদ আজাদ, জয় গোস্বামী, রহমান হেনরী প্রমুখদের কবিতার অনুরাগী আমি। তার সাথে পড়েছি মূল ভাষায় অথবা অনুবাদে প্রচুর বিদেশি কবিতা—বিশেষত পারসিয়ান, ইংরেজি, ফরাসি ও উর্দু কবিতা। সেসব কবিতা আমার কাব্যবোধকে শানিত করেছে। তাদের কারো প্রভাব ব্যাপকভাবে না পড়লেও তাদের কারো কারো প্রভাব আমার কোনো কোনো কবিতায় পড়া তো স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে আমি আমার নিজস্ব কাব্যভাষা দিয়ে সেই প্রভাবকে ন্যূনতম স্তরে রাখার চেষ্টা করি।

 

ম্যারিনা নাসিরীন : অনেকেই মনে করেন কবিতার উন্নয়নে বিশ্বসাহিত্যে পাঠ জরুরি। আপনার কী মনে হয়, আসলেই জরুরি?
আমিনুল ইসলাম : এ প্রসঙ্গে আমি বলিউডের প্রখ্যাত অভিনেতা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর একটি মন্তব্য শোনাতে চাই : "Acting School helps to know 'What is Acting?', but there's no School or University to make you Mr. Shah Rukh Khan." তো বিশ্বসাহিত্য পাঠ করলেই যে কবিতার বড় ধরনের উন্নয়ন ঘটবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। কবিতা প্রথমত প্রতিভার ব্যাপার। শক্তিশালী প্রতিভা না থাকলে কারও পক্ষে উন্নতমানের কবিতা রচনা করা সম্ভব নয়। তাহলে তো সাহিত্যের অধ্যাপকরাই এক একজন রুমি-হাফিজ-গ্যেটে-রবীন্দ্রনাথ হয়ে যেতেন। আসলে ধার করা ভাবনা আর ঘষামাজা কারিগরি বিদ্যা দিয়ে বড়োজোর গড়পড়তা কবিতা হতে পারে। কিন্তু ‘বলাকা’, ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’, ‘বিদ্রোহী’, ‘অবসরের গান’, ‘আটবছর আগের একদিন’, ‘কবর’ ‘সোনালি কাবিন’, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’, ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’—এধরনের কবিতা মূলত প্রতিভার ফসল।

তবে যার প্রতিভা আছে, তার জন্য বিশ্বসাহিত্যের পাঠ অবশ্যই কাজে লাগতে পারে। তিনি বিশ্বসাহিত্য ছেনে কবিতার নতুন উপকরণ সংগ্রহ করতে পারেন। জীবনানন্দ দাশের অনেক কবিতাই বিশ্বকবিতা থেকে পাওয়া উপকরণে রচিত।

 

ম্যারিনা নাসরীন : বিশ্বসাহিত্যের নানা শাখার অসংখ্য গ্রন্থ বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়েছে বা হচ্ছে। কিন্তু বাংলা থেকে অন্যান্য ভাষায় অনূদিত গ্রন্থের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। এমনটি কেন হচ্ছে বলে মনে হয়
আমিনুল ইসলাম : বাংলাদেশের সাহিত্য বিদেশি ভাষায় অনূদিত হয়নি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। ফলে বাংলাদেশের সাহিত্য রয়ে গেছে মায়ের ঘরে বন্দি। একটি কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের লেখকরা এবং সাহিত্যের অধ্যাপকরা অনুবাদের জন্য প্রয়োজনীয় হালনাগাদ ইংরেজি-ফরাসি-আরবি-পারস্য-চিনা ভাষা জানেন না। বাংলা একাডেমির কোনো তৎপরতাও চোখে পড়েনি এযাবৎ। প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাতৃভাষা প্রীতি আমাদের অনেককিছুই দিয়েছে কিন্তু একইসঙ্গে আমাদের করে রেখেছে বিদেশি ভাষাবিমুখ। ভাষার ব্যাপারে এক ধরনের কূপমণ্ডূকতা আমাদের আটকে রেখেছে। কিন্তু পাশের দেশে ভারতে এই সমস্যাটি নেই। আরেকটি সমস্যা হলো, আমাদের দেশে অনুবাদক তৈরি হয়নি।

 

ম্যারিনা নাসরীন : সম্প্রতি আপনি নজরুল সংগীত নিয়ে গবেষণাধর্মী গ্রন্থ লিখেছেন। সংগীত নিয়ে আপনার আগ্রহ কীভাবে তৈরি হলো?
আমিনুল ইসলাম : আমি কবিতা ও সংগীতের ভক্ত। এবং সেটা যেদিন থেকে কান হয়েছে, সেদিন থেকেই। রেডিও ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। তার সাথে কলের গান বা মাইকের গান। আর স্থানীয় যাত্রাপালা, আলকাপ, কবিগান, মারফতী গান এসব। ভারত উপমহাদেশের বাংলা, উর্দু ও হিন্দি ভাষার সকল বিশিষ্ট শিল্পীর গান শুনে এসেছি সারাজীবন ধরে। এভাবেই রবীন্দ্র-নজরুলের গানও। একসময় নজরুলের কিছ কিছু গান—যে গানকে কাব্যগীতি বলা হয়, তা আমার আবেগে ও ভাবনায় দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করে। যেমন ‘আমি চাঁদ নহি অভিশাপ’, ‘জনম, জনম গেল আশাপথ চাহি’, ‘তোমার আঁখির মতো আকাশের দুটি তারা’, ‘দীপ নিভিয়াছে ঝড়ে’ ইত্যাদি। আমি এই গানগুলি নিয়ে ছোটো ছোটো প্রবন্ধ লিখি অর্থ ও সৌন্দর্য উদ্ধার করতে। সেগুলো দৈনিকের পাতায় ছাপা হতে থাকে মাঝে মাঝে। সেটা করতে গিয়ে নজরুলের গানের বাণীর ঐশ্বর্য আমাকে মুগ্ধ করে। আমার মনে হতে থাকে, কেবল সংগীতকার নজরুলকেই নয়, কবি নজরুলকে তার আসল শক্তিমত্তায় ও সৌন্দর্যে বুঝতে হলেও তার গানের বাণীর নিবিড় পাঠ আবশ্যক। খোঁজ নিয়ে দেখলাম এ কাজটি কেউ করেননি। আর প্রশাসন দীর্ঘ ৫ বছরের জন্য আমাকে একটা ডাম্পিং পোস্টিং দিয়ে রেখেছিল যেখানে কাজকর্ম ছিল না বললেই চলে। অন্য কেউ হলে সেখান থেকে বদলি হয়ে চলে যেতো কোনো গুরুত্বপূর্ণ পোস্টিংয়ে। আমি সেট না করে ভাবলাম, বেতনভাতা তো পাচ্ছিই, তারচেয়ে নজরুলের গানের বাণী নিয়ে একটা বই লেখার চেষ্টা করি না কেন! সেভাবেই বইটির পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়ে যায়। আমার পানিশমেন্ট পোস্টিংটা শেষপর্যন্ত আমার জন্য প্রাইজ পোস্টিং হয়ে যায়।

 

ম্যারিনা নাসরীন : ধারণা করা হয়, যে কোনো সফল ব্যক্তির পেছনে একজন নারী শক্তি এবং প্রেরণা দাত্রী হিসেবে কাজ করে। আপনার জীবনে এমন কোনো নারীর অবদান আছে কী?
আমিনুল ইসলাম : কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘নারী’ কবিতায় বলেছেন, ‘কোনো কালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি/শক্তি দিয়েছে প্রেরণা দিয়েছে বিজয়লক্ষ্মী নারী।’

আমার সাহিত্যজীবনে প্রথম প্রভাব আমার আব্বার। তিনি গ্রামের কবি ছিলেন। তার কাছ থেকেই আমি পেয়েছি কাব্যপ্রেম ও কাব্যশক্তি যা আমার রক্তে প্রবাহিত।

বাকিটা পেয়েছি বাংলার নারীদের কাছে। অবশ্য তুরস্কের একজন নারীরও বড় অবদান আছে। বিয়ে হওয়ার আগপর্যন্ত এবং পরেও যারা আমার প্রেমানুভূতির চুলোয় জ্বালানি সরবরাহ করেছেন, মূলত তারাই আমাকে দিয়ে কবিতা লিখিয়েছেন। তাদের দুচারজন এখনও আমার কবিতার অনুরাগী পাঠক, কখনো কখনো আলোচক-সমালোচকও। তবে সবার ওপরে একটি নাম, লীনা। তিনি আমার জীবনসঙ্গিনী। প্রায় ৩০ বছর যাবত। আমার প্রায় প্রতিটি কবিতার প্রথম পাঠক তিনি। কখনো কখনো সমালোচক বা পরামর্শদাতাও। আমার কবিতা লেখার পেছনে মূল সহায়ক শক্তি আসলে তিনিই।

আমার বেশ কজন বান্ধবী ছিল। তাদের কারো কারো সাথে আমার নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তাদের কেউ কেউ আমার বাসায়ও এসেছেন দু-একবার। লীনা নিজহাতে রান্না করে তাদের আপ্যায়ন করেছেন। একসময় তারা তার বান্ধবী হয়ে গেছে। তিনি কোনো সন্দেহপরায়ণতার কাছে নিজেকে ছোটো করেননি। এমন গভীর মন, এত উদারতা কোথায় মিলবে?
আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তন্ত্র থেকে দূরে’ প্রকাশ করার সময় বইটি তাকে উৎসর্গ করার কথা বললে তিনি নাকচ করে দিয়ে আমার বাব-মাকে তা উৎসর্গ করতে বলেছিলেন। আমি অনেক ভেবেচিন্তে বইটি তাকেই উৎসর্গ করি। ‘শেষের কবিতা’র ২টি লাইন উদ্ধৃত করে আমি উৎসর্গপত্রে লিখি, ‘লীনাকে—‘যে আমারে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায় ভালো-মন্দ মিলায়ে সকলি’। লীনাকে নিয়ে আমার বেশকয়টি কবিতাও আছে।

 

ম্যারিনা নাসরীন : আপনার কি মনে হয় সাহিত্য সৃষ্টিতে পুরস্কারের কোনো প্রভাব রয়েছে?
আমিনুল ইসলাম : আমার কাছে সাহিত্য-পুরস্কার পাওয়ার অনুভূতি অবশ্যই ইতিবাচক। আমি তো একজন সাধারণ মানুষ। বিশ্বখ্যাত কথাসাহিত্যিক জ্যা পল সার্ত্রে কিংবা সেতার সম্রাট ওস্তাদ বিলায়েত খাঁর মতো মহামানব ধরনের কেউ হতে পারিনি। তাই পুরস্কারকে না করতে পারি না। পুরস্কার পেলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে এবং পরিচিতি বা জনপ্রিয়তা সম্প্রসারিত হয় বলে আমার মনে হয়। তাছাড়া পরিবারের লোকজন এবং সাহিত্যবন্ধুরাও খুশি হয়। কিন্তু পুরস্কার কাউকে মহৎ সাহিত্য রচনায় শক্তি জোগাতে বা পথ দেখাতে পারে না। আগে সৃষ্টি, পরে পুরস্কার। রবীন্দ্রনাথ আগে ‘গীতাঞ্জলি’ রচনা করেছেন, পরে পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার। বিসমিল্লাহ খান আগে সানাই বাদনকে অনন্য শিল্পে উত্তীর্ণ করে বিশ্বের মানুষের কাছে উপস্থাপন করেছেন। অতঃপর পেয়েছেন ভারতরত্ন পুরস্কার।

নোবেল পুরস্কার, পুলিৎজার পুরস্কার, ম্যাগসাইসে পুরস্কার পাওয়ার সাথে সাথে সেই সাহিত্যিকের রচনা অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বপাঠকের কাছে ছড়িয়ে যায়। সেটা একটা বিরাট ইতিবাচক ফ্যাক্টর।

 

ম্যারিনা নাসরীন : কবি আমিনুল ইসলাম তার কোন কোন লেখার মধ্যে পাঠকের কাছে বেঁচে থাকবেন বলে মনে করেন?
আমিনুল ইসলাম : আমার মনে হয়, আমার কিছু ইতিহাস-ঐতিহ্যের কবিতা, কিছু প্রেমের কবিতা টিকে থাকবে। আমার ‘মহানন্দা এক সোনালি নদী নাম’ কবিতাটি অন্তত ততদিন টিকে থাকবে যতদিন মহানন্দা নদীটি এবং তার দুপাশের ভূগোল থাকবে।

আর আমার গভীর বিশ্বাস, ‘নজরুল সংগীত : বাণীর বৈভব’ গ্রন্থটি ততদিন থাকবে যতদিন মানুষ নজরুলের গান শুনবে। কিন্তু এই অমরত্বের ধারণাটি আমার কাছে একইসঙ্গে হাস্যকরও মনে হয়। আমার মৃত্যুর পর পরজীবন থাক অথবা নাই থাক, আমি তো জানবো না, আমার কোনো লেখাটিকে থাকলো নাকি থাকলো না। মৃত্যুর পর টিকে থাকা না-থাকার ভাবনায় সময় ব্যয় করার কোনো যুক্তি নেই।

 

ম্যারিনা নাসরীন : বর্তমানে কী লিখছেন?
আমিনুল ইসলাম : এখন আমার পড়ার মৌসুম চলছে। প্রচুর পড়ছি। একাধিক বই। একইসাথে অথবা এবলা ওবেলা। পড়ছি বিক্রম সম্পত সম্পাদিত ‘আমার নাম গওহরজান’, অতনু‍চক্রবর্তীর বই ‘প্লেব্যাক’, বিভিন্ন ছোটোগল্পের বই এবং বিদেশি কবিতার অনুবাদ। কেবলই পড়া শেষ করেছি দিলীপ কুমারের আত্মজীবনী ‘ The Substance And The Shadow’, ইমরান খানের আত্মজীবনী ‘পাকিস্তান : আমার ইতিহাস’, মান্নাদের আত্মজীবনী ‘জীবনের জলসাঘরে’ এবং মুহম্মদ রফির জীবন নিয়ে শুভংকর গুহর বই ‘রাফিয়ানা’। সেগুলো নিয়ে লিখতে চাই। ফাঁকে ফাঁকে দু-চারটি কবিতা তো লিখছিই।

 

ম্যারিনা নাসরীন : আপনার মূল্যবান সময়ের কিছুটা আমাকে দেবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই
আমিনুল ইসলাম : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মাটি কাটার সময় 'গরমে অসুস্থ হয়ে' নারী শ্রমিকের মৃত্যু
মাটি কাটার সময় 'গরমে অসুস্থ হয়ে' নারী শ্রমিকের মৃত্যু
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
কান উৎসব ২০২৪স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে