X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১
হামীম কামরুল হকের কুন্দেরা পাঠের অভিজ্ঞতা

উপন্যাস হলো অস্তিত্বের তদন্ত

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : হেমায়েত উল্লাহ ইমন
১৪ জুলাই ২০২৩, ১২:২১আপডেট : ১৪ জুলাই ২০২৩, ১৪:৫৩

হামীম কামরুল হক নব্বই দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে লিখে চলেছেন গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও সমালোচনা; করেছেন অনুবাদ ও গবেষণামূলক কাজও। ২০০৭ সালে ‘রাত্রি এখনো যৌবনে’ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপির জন্য পেয়েছিলেন ‘কাগজ তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার’। বিশ্বাস করেন, ভালোবাসাই হলো জগতের সমস্ত প্রশ্ন, সমস্যা ও সংকটের একমাত্র উত্তর। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। মিলান কুন্দেরা পাঠের অভিজ্ঞতা তিনি তার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছেন। গত ১২ জুলাই কুন্দেরা ৯৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। 

হেমায়েত উল্লাহ ইমন : মিলান কুন্দেরার মৃত্যুতে লেখক ও পাঠক হিসেবে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
হামীম কামরুল হক : কুন্দেরা সব সময়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ লেখক। ঔপন্যাসিক হিসেবে বা উপন্যাস নিয়ে তার যে চিন্তাভাবনা, তার দর্শন—এসবের জন্যই তাকে দরকার হবে।
কুন্দেরাকে উপন্যাস-তাত্ত্বিক বলব না, তবে কেউ চাইলে বলতেও পারেন। ঔপন্যাসিক হিসেবে তার ভূমিকা বারবার ফিরে আসবে। মৃত্যুর পর তার গুরুত্ব কোনো অংশেই কমবে না, বরং আগের মতো থাকবে এবং বাড়বে।
কুন্দেরা মারা গেছেন এতে দুঃখ করার কিছু নেই। কেবল খারাপ লাগছে, একজন শক্তিশালী লেখক পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। বিদায় নিলেন মানে, দেহ রাখলেন। এর বাইরে আর কিছুই না।

ইমন : কুন্দেরা পাঠের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
হামীম : উপন্যাস ‘জোকস’-এর বাংলা অনুবাদ করেছিলেন আবদুর রহমান ‘ঠাট্টা’ নামে, মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। আমি উপন্যাসটা পড়েছি ছাত্রজীবনে। সেটা ছিল ভিন্ন ধারার লেখা; আমরা যেভাবে উপন্যাস পড়ি, বা ধারণা করি, তিনি ছিলেন এ ব্যাপারে নিরাকার। তিনি নতুন ধরনের লেখক হিসেবে আমাদের সামনে এসেছিলেন। কুন্দেরা বলেন, উপন্যাস হলো অস্তিত্বের তদন্ত। উপন্যাস হলো, ব্যক্তি এবং তার অস্তিত্বের সাথে যে দ্বন্দ্ব, যে আত্নপরিচয় তার উন্মোচেন করা এবং একইসঙ্গে নিজের অবস্থান চেনা। আমি পৃথিবীতে কোথায় কেন এবং কীভাবে আছি—এই বিষয়টিই ব্যক্তিকে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে পারে।
কুন্দেরা উপন্যাসে ব্যক্তির জন্ম থেকে শুরু করে তার জৈবিকতা, প্রবণতা বা প্রকৃতি, যৌনতা, বা তার তীব্র বিষয়গুলো—তিনি তা সাবলীলভাবে এনেছেন। অনেকে বলেন, জয়েস কিংবা হেনরি মিলারের তুলনায় কুন্দেরা যৌনতাকে সেভাবে সামাল দিতে পারেন নাই। আমার কাছে মনে হয়েছে, কুন্দেরা নিজের মতো করেই লিখেছেন। তিনি জয়েসের মতো লিখতে যাবেন কেন? কুন্দেরা যেভাবে যা বোঝেন তিনি তা সেভাবেই দেখিয়েছেন। আগামীতে যারা উপন্যাস নিয়ে কাজ করবেন, তারা যদি কুন্দেরার উপন্যাস বাদ দিয়ে কাজ করতে চান, তাহলে উপন্যাসের বড় একটা অংশ—খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ এড়িয়ে যাবেন—যা তাদের জন্য ক্ষতিকর হবে বলে আমি মনে করি।

ইমন : বিশ্বসাহিত্যে মিলান কুন্দেরাকে আমরা কীভাবে চিহ্নিত করতে পারি?
হামীম : বিশ্বসাহিত্যে মিলান কুন্দেরার ভূমিকা দুরকম। প্রথমত, তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ ঔপন্যাসিক। দ্বিতীয়ত, উপন্যাস বিষয়ে তার চিন্তা-ভাবনা। তার ‘দ্য আর্ট অব দ্য নভেল’—বইতে  উপন্যাস সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে যে কতভাবে দেখা যায় এবং একই বিষয়কে কত বিচিত্র উপায়ে যে ব্যাখ্যা করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা করেছেন। ইউরোপীয় মানসিকতায় সৃষ্টি উপন্যাসকে তিনি যেভাবে জাস্টিফাই করেন বা হাজির করেন তা সত্যিই আমাদের সচকিত করে তোলে।
আমরা তো আর বলতে পারি না, এশিয়া মহাদেশের মানুষের চিন্তায় উপন্যাসের ভূমিকা কী, আমরা তীব্রভাবে দাবি করতে পারি না, কারণ একেক রকম ভাষা বিনিময়ের আর ভাষার সংযুক্তির বিষয়টিতে আমরা ইউরোপের তুলনায় একটু পেছানো। কুন্দেরার সুযোগ ছিল ইউরোপীয় মানুষ হিসেবে সেদিকটা দেখানোর। এ কারণে ইউরোপীয় উপন্যাসের ভাবুক হিসেবে কুন্দেরা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ।
ইউরোপীয় উপন্যাসের ভাবুক হিসেবে কুন্দেরাকে রাখতে হবে আর এজন্যই উপন্যাসের গড়ন, গঠন ও উপন্যাসের হালনাগাদ বিষয়টি কোনদিক থেকে কোনদিকে গেল সেটা জানতে কুন্দেরাকে আমাদের দরকার হবে।
কুন্দেরা সংগীতের চর্চা করতেন, এছাড়াও নানা কারণে একজন আদর্শ লেখক হিসেবে তাকে আমরা পাই। তিনি যেটা করেছেন, সেটা হচ্ছে আত্মগোপন—আত্মগোপন বলতে একজন লেখককে আসলে আত্মগোপনের মাধ্যমেই আত্মপ্রকাশ ঘটাতে হয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হচ্ছেন মিলান কুন্দেরা।

কথাসাহিত্যিক হামীম কামরুল হক

ইমন : ডায়াসপোরা সাহিত্যের কথা বললে সালমান রুশদি বা অন্যান্যদের সাথে মিলান কুন্দেরার নাম চলে আসে। এই দিক থেকে তাকে কীভাবে পাঠ করতে পারি?
হামীম : মিলান কুন্দেরা দ্বি-ভাষিক লেখক। তিনি চেক ও ফরাসি ভাষায় লিখেছেন। তার রচনাশৈলী, তার উপন্যাসের যে প্রবণতা তাকে বলা যায় ‘কুন্দেরীয়’; পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ ঔপন্যাসিক, যেমন দস্তয়েভস্কি, তলস্তয় তাদের মতো তার লেখায় নিজস্ব একটি প্রবণতা রয়েছে—বলা যায়, কুন্দেরীয় প্রবণতা; এ বিষয়গুলো আমরা কিন্তু সব লেখকের লেখায় পাই না; আমরা যেমন বলি ‘কাফকীয় ম্যানার’ ঠিক তেমন একটি বিষয় তার লেখায় আমরা পাই। আলাদা ধরন, দৃষ্টিভঙ্গি, শৈলী তিনি গড়ে তুলতে পেরেছেন।
তার লেখায় আধুনিক মানুষ একদম আধুনিক জীবন-যাপনের জায়গা থেকে কীভাবে হাজির হচ্ছে তা দেখতে পাই; অনেকের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি দৈনন্দিন জায়গা থেকে উঠে আসে।
অনেকে বলবেন, দৈনন্দিন জীবনে সাহিত্যের ভূমিকা কী? সাহিত্য আসলে বাস্তব সম্পর্ক বিচারের বিষয় না যে, বাস্তবতা কতটা উঠে আসলো তা দেখাতে হবে। সাহিত্য সৃষ্টিশীলতার বিষয়; নির্মাণের জায়গা থেকে একে দেখতে হবে। বাস্তবতার নিরিখে সাহিত্যকে বিচার করা যাবে না।
কুন্দেরা হলেন আর্টিস্ট, লেখকদের মধ্যে আর্টিস্ট। সব লেখক কিন্তু শিল্পী নন, সব লেখকের সাহিত্যিক প্রকাশ শৈল্পিক নয়, আমার কাছে কুন্দেরা একজন বড় মাপের উপন্যাসের আর্টিস্ট।

ইমন : কুন্দেরার লেখার ভিত্তি কি কমিউনিজম বিরোধীতাই? যদিও শেষদিকের লেখায় বলা হয়, ফ্রেডরিখ নিৎসের প্রভাব রয়েছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাচ্ছি?
হামীম : কুন্দেরা সম্পর্কে দীর্ঘসময় ধরে মনে করা হতো—তিনি কমিউনিস্ট বিরোধী, সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদ যা মার্কসবাদের নামে ইউরোপকে এক ধরনের কব্জা করে রেখেছিল। সেই কমিউনিজম বা মার্কসবাদের বিরুদ্ধের লেখক হচ্ছেন কুন্দেরা। কুন্দেরাকে মার্কসবাদীদের একটি বড় অংশ পুরোপুরি বাতিল করেন না, আবার গ্রহণও করেন না। অনেকে আবার বলেন, কুন্দেরার লেখার স্টাইল যদি মার্কসবাদ বিরোধী হয় তবে কী তা পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ বা মৌলবাদকে সমর্থন করে? আমার মতে, এই দেখার জায়গাটি সমস্যাজনক এবং সংকীর্ণতায় জর্জরিত। কুন্দেরা চেক সাহিত্যের সমৃদ্ধিকে তুলে এনছেন, তাকে পড়ে আমরা আগামী দিনের চেক সাহিত্যের উপন্যাসের মাত্রা ও গতিবিধিটা ধরতে পারি, যদিও তিনি লিখেছেন ফরাসি ভাষায় তবুও আমরা বলতে পারি, তিনি ফরাসি ভাষায় চেক উপন্যাসই লিখেছেন।

ইমন : কুন্দেরা বারবার মনোনয়ন পাওয়া সত্ত্বেও নোবেল পুরস্কার পাননি; এটা পাঠকের মনে কেমন প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে?
হামীম : তিনি দীর্ঘজীবন পেয়েছেন। বিখ্যাত লেখক হিসেবে সারা পৃথিবীতে পরিচিতি পেয়েছেন। নোবেল প্রাইজটা হয়ত পাননি—এটা কোনো ব্যাপার না, অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখকই নোবেল প্রাইজ পাইনি, তাই বলে তারা অগুরুত্বপূর্ণ রয়ে যাননি। তলস্তয় বলি কিংবা আন্তন চেখব বলি, অনেক বড়ো বডড়ো লেখকই পান নাই। বোহের্স কিংবা জেমস জয়েস আর যাদের কথা বললাম তারা তো নোবেল প্রাইজ না পাওয়ার জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যান নাই। কুন্দেরা ওই ধারারই একজন লেখক যিনি পুরস্কারের মুখাপেক্ষী নন। তার টিকে থাকার জন্য তার চিন্তাভাবনা আর লেখালেখিই যথেষ্ট। 

শ্রুতিলিখন: জাকিয়া খান জ্যোতি

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
কান উৎসব ২০২৪স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার
খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার