X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

আসাদ চৌধুরীর সাক্ষাৎকার

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : জাহেদ সরওয়ার
০৫ অক্টোবর ২০২৩, ১৫:৫৬আপডেট : ০৫ অক্টোবর ২০২৩, ১৫:৫৬

কবি আসাদ চৌধুরী ষাটের দশকের অন্যতম কবি। কবিতা, অনুবাদ, জীবনী, ইতিহাস, সম্পাদনা ও শিশুসাহিত্য মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশের অধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। তার কবিতা সহজ, বোধগম্য, প্রাকৃতিক ও সমাজ-সচেতন। প্রথম কবিতা লিখেছিলেন ‘প্যাট্রিক লুলুম্বা’কে নিয়ে। আসাদ চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি।
তিনি ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ২০১৩ সালে একুশে পদক লাভ করেন। তিনি আজ ৫ অক্টোবর, কানাডায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।

জাহেদ সরওয়ার : আপনার শৈশব কীভাবে, কোথায় কেটেছে জানতে চাই। ফ্রয়েডকে স্মরণ করে বলা যায়, আপনার কবি হওয়ার বীজ শৈশবে রোপিত হয়েছিল কি না?
আসাদ চৌধুরী : আমার শৈশব কেটেছে অনেক জায়গায়। আমার জন্ম বরিশালের উলানিয়ায়। আমাদের পরিবারটাকে বলা হতো বড়ো হিসসা। বিরাট জমিদারি। গ্রামে কেটেছে আমার অনেক দিন। একবার খুব পাগলা জ্বর হওয়ায় আমাকে বরিশাল নেয়া হলো; সেখান থেকে কলকাতা। এটা ৪৭ সালের কথা বলছি। কলকাতায় আমি মাস দেড়েকের মতো ছিলাম সে সময়। আমি বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম, ৪৭-এর দাঙ্গার আবহটা দেখলাম। আব্বা তখন এমএলএ ছিলেন। মোঃ আরিফ চৌধুরী। যুক্তবঙ্গের শেষ এমএলএদের একজন। পুলিশ পাহারায় থাকতো। তারা আমাকে ধরে নিয়ে আসে।
ক্লাস টুতে যখন উঠলাম তখন আমাকে ঢাকা আসতে হলো। বাবার অ্যাসেম্বলি ছিল। জগন্নাথ হলের উল্টোদিকে যে দালানটা ছিল তখন ওখানেই অ্যাসেম্বলি হলো। থাকতাম শহিদ মিনারের প্রায় উল্টো দিকে। প্রথমে ২২/২৩ দিনের মতো নৌকাতে ছিলাম। পরে কলতলায় একটা বাড়ি পাওয়া গেল সেখানে আমরা মাস সাতেক ছিলাম। পরে বাবু বাজার চলে আসলাম। ওই একটা বছর আমার পড়াশোনা হয়নি। সেন্ট গ্রেগরিতে বাবা পড়াতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমার ভেতরে ভেতরে ইংরেজ বিদ্বেষের কারণে তা হয়নি। আমি আব্বাকে বললাম, আমি ইংরেজি স্কুলে পড়ব না। আব্বা খুব খুশি হয়ে বললেন, পড়তে হবে না তাহলে, থাক। তবে এতে বাসায় পড়ার চাপটা বাড়ল। তবে তখন আমার প্রচণ্ড স্বাধীনতা ছিল। আমরা কার সঙ্গে খেলছি কোথায় যাচ্ছি মা-বাবারা এখনকার মতো এত কড়াকড়ি করত না। তারপর ক্লাস ফোরে পড়ার সময় আমি পুরান ঢাকার পুরাটাই চিনে ফেলেছিলাম। তবে কয়েক মাস থাকার পরপরই গ্রামে যাওয়ার জন্য আমার মনটা কেমন কেমন করত। গ্রামে কয়েক মাস থাকার পর আবার শহরে আসার জন্য পাগল হয়ে যেতাম।

জাহেদ সরওয়ার : সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক কীভাবে এলো?
আসাদ চৌধুরী : সাহিত্যের ঝোঁক পারিবারিকভাবেই ছিল। আবদুল গাফফার চৌধুরীকে কাছ থেকে দেখেছি; তার আকর্ষণ, কালাপাহাড়, সুপারহিট উপন্যাস এগুলো। উনি ছিলেন আমার নানির আপন ছোটোভাই। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের জামাতা। সবচেয়ে বড় কথা তখন আমাদের বাসায় অনেক পত্রিকা রাখা হতো।
প্রবাসী, মোহাম্মদী, ভারতবর্ষ, মাহে নও, সওগাত। আমার এক মামা শিশু সওগাত রাখত। যতটা মনে পড়ে শিশুসাথী বলেও একটা পত্রিকা ছিল। আরো অনেক পত্রিকা থাকত বাসায়। নাম মনে পড়ছে না। আমার খুব প্রিয় ছিল মোহন সিরিজ।
আমাদের পারিবারিক পরিবেশটাও বিশাল, জমিদার বাড়ি, খুবই সেক্যুলার। ক্লাস ফোরে আমি প্রথম নজরুলের ‘বিষের বাঁশি’ বইটা পাই। পাগলের মতো পড়েছিলাম। এরপর ‘অগ্নিবীণা’ পাই। এগুলো কিন্তু ব্রিটিশরা নিষিদ্ধ করেছিল। ৬৪-এর প্রথম শেরেবাংলা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। আর আমাদের গ্রামে আমার কাজিন আজিম ভাই বিরাট একটা ব্যাটারি চালিত রেডিও এনেছিলেন। অনেক বড়ো, টেলিভিশনের তিনগুণ সাইজ হবে। ব্যাটারিটাও অনেক ওজন ছিল। দুজনকে বহন করতে হতো। নাটক, আবৃত্তি আমরা তখনই শুনি। ক্লাস ফোরে আমি নজরুলের বইগুলো পড়লাম। এরপর কবিতা পড়লেই ওগুলো আমি পড়ি। কবিতাগুলো জোরে জোরে পড়তাম। ফলে ছন্দটা তখন মনে হয় কানে গেঁথে গিয়েছিল। যখন ‘আবোলতাবোল’ পেলাম তখন আমি ক্লাস সেভেনে। তখন আমাকে আর পায় কে? সুকুমার রায় আমার অসম্ভব প্রিয় কবি। রবীন্দ্রনাথ নজরুল এরা না। আর মেট্রিক পরীক্ষা যখন দেই তখনই আমি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা পড়ি। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা পড়লাম। আর সমর সেন আমার ভাইয়ের খুবই ফেভারিট ছিল। তার পরামর্শে আমি সমর সেন পড়ি। কিন্তু তখন অসম্ভব ভালো লেগে যায় জীবনানন্দ দাশ। এই ভালো লাগার আমি ব্যাখ্যা দিতে পারব না। জীবনানন্দ দাশ পড়ার পর আমার মনে হলো, আমিও তো ইচ্ছে করলে লিখতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়ি বাংলা বিভাগে, তখন আগা সুলতান রোডে এমদাদিয়া লাইব্রেরির মালিক ছিলেন বরিশালের। উনি আমাকে বললেন, প্যাট্রিক লুলুম্বার ওপর একটা কবিতা লিখতে হবে। প্যাট্রিক লুলুম্বার মৃত্যু আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। যদিও বিশ্বায়নের চাপের ভেতর ঢুকিনি তখনো আমরা। আমার মনে হয়েছিল আমার কোনো কাজিন মারা গেছে। খুবই অপমানিত বোধ করছিলাম তখন। স্টেডিয়ামে বুকস অ্যান্ড ম্যাগাজিনস বলে একটা দোকান ছিল। ওটা ছিল খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের। ওখানে এক ভদ্রলোক এলেন, দেখলেন, কোনো মন্তব্য করলেন না, কবিতাটা নিয়ে চলে গেলেন। পরে জানলাম উনি ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। এই কবিতাটা পরে ‘আফ্রিকার হৃদয়ে সূর্যোদয়’ বলে লুলুম্বাকে নিয়ে একটা সংকলনেও ছাপা হলো। পরের দিনই সংবাদে কবিতাটা এডিটোরিয়াল পেইজে ছাপা হলো। এর আগে আমার কোনো কবিতা সাহিত্যপাতায় ছাপা হয়নি। একেবারে এডিটোরিয়াল পেইজে। পরে খবর পেলাম, তখন তো আর এখনকার মতো ছিল না। সাহিত্যপাতা আগে ছাপা হয়ে যেত। আমি রাতারাতি কবি খ্যাতি পেয়ে গেলাম। এটা খুব কম লেখকের ভাগ্যে জোটে। তখন থেকেই এটা আমার কবিতার প্রবণতা। সমাজ এবং মানুষ আমার কবিতার বিষয় হয়ে উঠল। সংগীতের ক্ষেত্রে আমার রুচি একেবারেই এলোমেলো। আমি রাগ পছন্দ করি, লোকসংগীত আমার অসম্ভব প্রিয়। একবার আমরা হাওরে গেলাম। আমরা সেখানে শুনলাম রাধারমণ ও শাহ আব্দুল করিমের গান। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমরা শাহ আব্দুল করিম শুনলাম।

জাহেদ সরওয়ার : হাওরের সঙ্গে মানে ওইসব আবহে থেকেই তো শাহ আব্দুল করিমের বাউলগিরি। হাওর আর শাহ আব্দুল করিম একসঙ্গে হলে পাগল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। আমি দিরাই নদী পার হয়ে আব্দুল করিমের বাড়িতে গিয়েছিলাম উনার জীবদ্দশায় একবার।
আসাদ চৌধুরী : হ্যাঁ, তা-ই। শাকুর মজিদের সঙ্গে গিয়েছিলাম তার বাড়িতে তারই কল্যাণে। একটা পরিপূর্ণ সন্ধ্যা কাটালাম বলতে গেলে শাহ আব্দুল করিমের সঙ্গে। যা হোক এভাবেই শুরু হলো বলা যায়। ব্রজমোহন কলেজে একসময় ছাত্রলীগ করতাম। বদরুল হক পরে সুপ্রিম কোর্টের জজ হন, ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন কলেজে। আমার দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। একসময় ছাত্র ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকলাম। একসময় বাম রাজনীতির দিকে ঝুঁকলাম। তারপরও আসলে রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত হইনি কখনো। পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে যখন পড়াই তখন কৃষক-শ্রমিকদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম। এর আগে আমি কখনোই ভাবতে পারিনি কৃষকরা সন্ধ্যার সময় খেয়ে ফেলে কুপির তেল বাঁচানোর জন্য। আরেক বাড়িতে গিয়েছিলাম, পাশের বাড়ি থেকে গ্লাস এনে তারপর আমাকে পানি দিয়েছিলেন। তাদের বাড়িতে কোনো গ্লাস ছিল না। বিশ্বাস করো, এ সমস্ত ব্যাপার আমার আগে জানা ছিল না। এটা চৌষট্টি পঁয়ষট্টির দিকের কথা বলছি। ছয় দফা আসছে তখন। এগারো দফা তো ঊনষট্টিতে। তখন আমি ঢাকায় ছিলাম না। তবে এই বাইরে থাকাটা আমার নিজেকে বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এরকম আরেকটা অভিজ্ঞতা হয়েছে আমাদের কৃষক-শ্রমিকদেরই এক কর্মীর কাছ থেকে। তার বাড়ি ছিল খরোলের দিকে। একটু জঙ্গিমার্কা লোক মানে অতিবিপ্লবী আরকি। সে এসে উদাসীনভাবে কথাবার্তা বলছে। আমি ভাবছি কারণ কী? এই লোক তো এ রকম ছিল না। এ কয়দিনে কী এমন হলো উনি আধ্যাত্মিক কথাবার্তা বলছেন কেন প্রতিনিয়ত? তারপরই বুঝলাম কোনো একটা বিয়ে বাড়িতে আবদুল আলীমের গান বেজেছিল। ‘এই যে দুনিয়া কীসের লাগিয়ে’ এই জাতীয় গান। অনেকগুলো শুনেছে তারপর তার ভেতর এটার প্রভাব পড়েছে। তখন আমি আবার নতুন করে সংস্কৃতিকে আবিষ্কার করলাম। সংস্কৃতির শক্তিটাকে। এটা শুধু বিনোদনের ব্যাপার না। সংস্কৃতির যে সোল পাওয়ার আছে, সেটা। এটা শুধু মানুষকে কমিউনিকেট করে না, মানুষকে ভেতর থেকে নাড়িয়েও দিতে পারে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থাকতে এই অভিজ্ঞতাটা হয়েছিল। এরপর তো ঢাকায় চলে এলাম। স্বাধীন বাংলা বেতারের সঙ্গে যুক্ত হলাম। জয়বাংলা পত্রিকায় কাজ করলাম। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত হলাম। এবার বিয়ে করলাম। আমার স্ত্রীর পরিবারের পাল্লায় পড়ে ঢাকায় পার্মানেন্টলি চলে এলাম। আবার সেই গাফফার চৌধুরী। দৈনিক আওয়াজ পত্রিকা বের করলেন। আমাকে নিয়ে এলেন।
যদিও আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না সাংবাদিকতা করার। পরে জার্মানিতে যাওয়ার কথা ছিল বিবিসিতে যোগ দিতে। কিন্তু পরে উনি আবার বললেন, খবরদার সাংবাদিকতা করো না। কারণ পত্রিকার মালিকের স্বার্থ রক্ষা করতে করতে কলমটাও সেরকম হয়ে যাবে। তোমার কোনো স্বকীয়তা থাকবে না। নিয়ত আপোস করতে হবে তোমাকে। পারবে না তুমি। আর তোমাকে আমি চিনি যতটা তোমার খুব কষ্টকর হবে ব্যাপারটা। বরং তুমি লেখালেখি করো। তুমি বাংলা একাডেমিতে যোগ দাও। আমি বাংলা একাডেমিতে যোগ দিলাম।

জাহেদ সরওয়ার : আচ্ছা এখানে একটা ব্যাপারে একটু বলি। আপনি সেই যে লুলুম্বাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখলেন। এরপর লেখাটা কন্টিনিউ করেননি। মানে নিয়মিত লিখছিলেন তো?
আসাদ চৌধুরী : না। কন্টিনিউ হচ্ছিল না তবে লেখা থেমে ছিল না। সৃজনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সৃজন একটা সংকলন করবে। ফ্রাঙ্কলি বলছি আমার অধিকাংশ লেখাই সম্পাদকদের তাগিদে লেখা। এখানে লিখলাম ‘এজমালি শান্তির সপক্ষে’ নামের একটা কবিতা। এরপর এই কবিতাটা আর কোথাও ছাপা হয়নি। আমার কাছেও সংকলনটা নেই যে অগ্রন্থিত কবিতা বলে এটাকে চালিয়ে দেব। এরপর যখন রফিক আজাদ টাঙ্গাইল থেকে এলেন। প্রশান্ত ঘোষাল ছিলেন মুন্সীগঞ্জের। ইমরুল চৌধুরী মুন্সীগঞ্জের। অর্গানাইজ করলেন। ‘স্বাক্ষর’ বের হলো। স্বাক্ষরে যখন লেখালেখি করি তখনি আমার ভেতরও তাগিদ পেলাম। স্বাক্ষর ৪টি বেরিয়েছে সারাজীবনে। আমি যখন ৭১-এ কলকাতায় গেলাম এটা আমার কাছে বিস্ময়কর ছিল যে বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায় আমাকে চেনেন। আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল না কী এমন লিখেছি তাই না। কটাই বা লেখা ছাপা হয়েছে।.
বছর খানেক পর ঢাকায় ফিরে এলাম। এরপর আসলে লেখালেখিটা নিয়মিত হলো। সমাজের প্রভাব সম্ভবত আমার ওপর সবচাইতে বেশি। সমাজকে আমি সবচাইতে বেশি গুরুত্ব দিই। স্বাভাবিকভাবেই সমাজকে গুরুত্ব দেয়া মানে হচ্ছে রাজনীতি প্রসঙ্গটা আসবেই। আমার পক্ষে রাজনৈতিক আনুগত্য কোনো দলের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হলো না। যে দলই ক্ষমতায় গিয়ে যখন উল্টাপাল্টা কাজ করে তখন আর সহ্য হয় না; বিরক্ত লাগে।

জাহেদ সরওয়ার : রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না হওয়া কি স্বাভাবিক কবি-স্বভাব? অনেক কবিকেই দেখা যায় তারা মতামত দেয় কিন্তু তাদের রাজনৈতিক কোনো প্লাটফর্ম থাকে না। বা শেষপর্যন্ত সেই প্লাটফর্ম তাদের ধরে রাখতে পারে না।
কবিতা যে আসলে একটা শক্তি। যে শব্দের স্তম্ভের ওপর ভর করে দাঁড়ায়। কবিতার শক্তির ব্যাপারটা কখন উপলব্ধি করলেন?
আসাদ চৌধুরী : হ্যাঁ, কবিতার শক্তির ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারলাম প্যাট্রিক লুলুম্বাকে নিয়ে কবিতাটা যখন ছাপা হলো। জেলখানা থেকে আমি অভিনন্দন পেয়েছিলাম। ওরা বন্দী কমিউনিস্ট। আর সংবাদও তখন বহুল প্রচলিত সংবাদপত্র। আধুনিক ও প্রগতিশীল দুই পক্ষই সংবাদ পড়ে। এবং আমি এটাও বলব ধনী-গরিবের পার্থক্য। গরিব হওয়াটা যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করে। এটা কোনো উত্তরাধিকার নয়। এটা আমার বুঝতে খুব দেরি হয়নি। এটা আমি সেভেন এইটেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। যদিও জমিদার বাড়ির ছেলে বলে আমি অনেক বেশি ফেভার পেয়েছি। আব্বা এমএলএ ছিলেন সেই জন্যও আমরা মনোযোগ পেয়েছি। তারপরও বলব সাম্প্রদায়িকতা আমাদের পরিবারে ছিল না।

জাহেদ সরওয়ার : আচ্ছা আমার মনে হয় আমরা কবিতা নিয়ে কথা বলতে চেয়ে একটু ভিন্ন দিকেই চলে যাচ্ছি। কবিদের তো অনেক রাষ্ট্রচিন্তকরা তাদের আদর্শ রাষ্ট্র বা ইউটোপিয়া থেকে বহিষ্কার করেছেন। সেটা রিপাবলিক বা ধর্মগ্রন্থগুলোতেও আছে। প্লোটোনীয় সক্রেটিস রিপাবলিকে বলেন যে কবিতার নাটকীয়তা যেখান থেকে মানে মানবমনের যে স্তর থেকে উৎপন্ন হয় সেটা নাকি নিম্নমুখী আবেগ। তা আদর্শ রাষ্ট্রকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে বলে মনে করেছেন তিনি। আপনি কীভাবে দেখেন ব্যাপারটাকে?
আসাদ চৌধুরী : একজন কবি যখন লেখালেখি করেন সেখানে তার চিন্তা তার সৃজনশীলতা এসবের বাহন হচ্ছে কবিতা। তিনি সমকালীন কাব্যভাষায় সমকালীন পরিবেশে তিনি যখন লেখেন তখন তার বিশ্বাসের জায়গা থেকে লেখেন। বা তার কাছে গ্রহণযোগ্য বলে তিনি সেটা নিয়ে লেখেন। এর ফলে হয় কী তার ব্যক্তিগত অনুরাগ অনুভূতি যখন শিল্পরূপ পায় তখন কিন্তু এটা সম্মোহনিক অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়। তাই পরাধীন ভারতে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনা সম্ভব হয়েছে। এবং বিদ্রোহী কবি বললেই এক নজরুল ইসলামকেই মনে করি। তার বয়স তখন কত? কিন্তু তিনি অনুভব করেছিলেন যে মানুষের ভেতর প্রচুর সম্ভাবনা আছে। তিনি সেই সময়ের প্রতিটি মানুষের ইচ্ছে বাসনাকে এক আমির মধ্যে ধারণ করেছিলেন। এখন এই আমি যদি আরো বেশি সর্বপ্লাবী হতে পারে। যেমন কোনো একটা সমাজে স্বাভাবিক কোনো ঘটনা নিয়ে যদি লিখি তাহলে কয়জন মানুষ গ্রহণ করবে, আবার যদি ইসলাম নিয়ে লিখি তাহলে সেটার এরিয়া আরো বড় হবে। যেহেতু মুসলমানের সংখ্যা বেশি। কিন্তু আমি যদি মানুষকে নিয়ে লিখি সেটা আরো বেশি বড় হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এটা এতটা হবে না। কথা হচ্ছে কবির সবচাইতে বড় দায়িত্ব হচ্ছে জাতি যখন দুঃস্বপ্নে নুইয়ে পড়ে কবি তখন স্বপ্ন দেখান। স্বপ্ন সে দেখে না শুধু, দেখায়। এটি কোনো অত্যাচারী শাসক কখনোই পছন্দ করবে না। র‍্যাঁবো যেমন বোদলেয়ার সম্পর্কে বলেছিলেন, স্বপ্নদ্রষ্টা। স্বপ্নের দেবতা। স্বপ্ন দেখার বা দেখানোর ব্যাপারটা কিন্তু অনেক বড় ব্যাপার। সুনীলের একটা কবিতা আছে সম্ভবত, ক্ষমতা কি আমার হাতে? ক্ষমতা তো আসলে কবির হাতে না। এটা হয়ত কবির কাজও না। এটা রাজনীতিবিদদের কাজ। সুভাষ বসু স্পষ্ট বলেছিলেন আমরা যখন যুদ্ধে যাব তখন নজরুলের গান সঙ্গে নিয়ে যাব। কারণটা কী? কারণ হচ্ছে নজরুলের গান তাকে প্রেরণা দেয়। উৎসাহিত করে, অনুপ্রেরণা জোগায়।

জাহেদ সরওয়ার : শহীদ কাদরীর একটা কবিতা আছে ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’। এই কবিতায় তিনি অনেক বাহাস করেছেন একদিকে কবিতা ফুল ভালোবাসা অন্যদিকে যুদ্ধ বিমান, লেফটরাইট, সীমান্তে কাঁটাতার।
আসাদ চৌধুরী : হ্যাঁ। ঠিক। এটা কেন? তার কারণটা হচ্ছে গণহত্যার সামনে মানুষের নির্মম নিষ্ঠুর মৃত্যুর সামনে শহীদ কাদরী স্বপ্ন বুনে দিলেন। অসাধারণ স্বপ্ন বুনে দিলেন। এই যে একটা বিপরীত জায়গায় দাঁড়ালো। আসলে কি বিপরীত জায়গা? মানুষ তার অধিকারের জায়গায় দাঁড়ালো। এবং এটা স্বাভাবিকভাবে কোনো প্রশাসকই আশা করে না। আরেকটা হচ্ছে কবিতা সময় দেশ এসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ না। অতীতের সভ্যতার যতগুলো ভাঁজ আছে, যতগুলো স্তর আছে, যেমন আমাদের লোকগানে যখন ফিউডাল যুগে ছিল বা যখন আমরা যাযাবর সমাজে বাস করতাম। এই যে ধারাবাহিকতা এতে যে সংগীত আসলো তার প্রতিটি সুরে সুরে সেসব দিনের কাহিনি গাঁথা আছে। কান্তজির মন্দিরে সেই সময়ের যত পেশা ছিল সব শ্রেণির পেশাজীবীকে আমরা পাব।

জাহেদ সরওয়ার : দেশে বিদেশে অনেক কবিতা সম্মেলনে আপনি গিয়েছেন। মিশেছেন অনেকের সঙ্গে। কবিদের জন্য কোন পেশাকে অধিকতর ভালো বলে মনে করেন?
আসাদ চৌধুরী : এটা আসলে কারো পক্ষেই বলা সম্ভব না। আমার মনে হয় নিজের পেশাকে নিয়ন্ত্রণ করেই কবিকে লিখতে হবে। টমাস মান ব্যাংকার ছিলেন। টিএস এলিয়ট ব্যাংকার ছিলেন। হেমিংওয়ে সাংবাদিকতা করতেন। বাংলাদেশে যারা কবিতা লেখেন বা সাহিত্য করেন তাদের অধিকাংশেরই পেশা মনে হয় অধ্যাপনা আর সাংবাদিকতা। ত্রিশের দশকের প্রায় সবাই অধ্যাপক ছিলেন। কিন্তু ইউরোপে একটা বই যদি কোনো প্রকারে হিট হয়ে যায় তাহলে তাকে আর কিছু করতে হয় না।  যেমন হ্যারল্ড রবিন এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ লেখক না। কিন্তু তাকে টাকা-পয়সা দিয়ে অভিজাত হোটেলে রুম বুকিং করে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গিনী প্রয়োজন হলে তাও দিয়ে প্রকাশক বলে যে, এবার লেখো। এটা মহৎ সাহিত্য কিছু না। আবার জে কে রাওলিংয়ের ক্ষেত্রে এ কথা বলা যাবে না। তিনি মূলত বাচ্চাদের জন্য লেখেন। আমি দেখেছি তার দ্বিতীয় বইটা যখন বের হয় তখন আমি আমেরিকায় ছিলাম। ভার্জিনিয়া থেকে আমার নাতনিকে নিয়ে আমার ভাগনে যাবে ওয়াশিংটনে। কেন? বইটা কিনতে। লাইনে দাঁড়িয়ে অনেক মানুষের পেছনে পেছনে দাঁড়িয়ে সে বইটা কিনল। এবং হ্যারি পটারের বইগুলো বয়স্ক লোকেরাও আমেরিকাতে কাভারটা কাগজে মুড়ে নিয়ে তারপর পড়ে। কিন্তু এটা তো কোনো বাস্তবতা না। এটা এক ধরনের ম্যাজিক। স্বপ্ন দেখানো। এর মধ্যে হয়তো একটা নীতিকথা থাকে যে সত্য কখনো পরাজিত হয় না। অনেকটা বাজারি সিনেমাগুলোর মতো মারপিট যা-ই ঘটুক শেষে সত্যের জয় হবে। আমাদের এখানে আব্দুল করিম নামে একটা লোককে চিনতাম। ইন্দিরা গান্ধী মারা গেল তাকে নিয়ে একটা বই লিখে ফেলল। ভুট্টো মারা গেল তাকে নিয়ে একটা বই বেরিয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু মারা গেল তিনদিনের মধ্যে তার বই বেরিয়ে গেল। আবার তিনজনকে নিয়ে লেখাগুলোকে একত্র করে আলাদা একটা বই বেরিয়ে গেল। এগুলোকে পথুয়া সাহিত্য বলে। কাজেই লেখকের কাজ কী হবে তা বলা মুশকিল।

জাহেদ সরওয়ার : বাংলাদেশে কাদের কবিতা মনোযোগ আকর্ষণ করে আপনার?
আসাদ চৌধুরী : আমি তরুণদের কবিতা পছন্দ করি সব সময়। আমাদের কালের যারা তাদের মোটামুটি সবার লেখাই ভালো লাগে। নির্মলেন্দু গুণ এখনো লিখে যাচ্ছেন। আল মাহমুদ এখনো চোখে দেখেন না। কানে শোনেন না। তারপরও বিস্ময়কর কিছু কবিতা লিখছেন। তরুণদের মধ্যে অনেকেই ভালো লিখছে তবে আমার একটা নালিশ যেটা তরুণদের মধ্যে হয়। পরপর চিত্রগুলো যে দেয় সেগুলোর পরম্পরা অনেক সময় তৈরি হয় না। গ্রন্থনার মধ্যে কোথাও একটা খাদ থাকে। কবিতাটা ঠিক পূর্ণতা পায় না। আমি ঠিক ধরতে পারি না। পিছলে পিছলে পড়ে যায়। টোকন ঠাকুর, মুজিব ইরমের কবিতা ভালো লাগে।  আবার সরকার আমিনের কিছু কিছু চিত্রকল্প আমার ভীষণ পছন্দের। আরেকজন কবির লেখা আমার খুবই ভালো লাগে ময়ূখ চৌধুরী চট্টগ্রামে থাকে। আমি যে লেখা পড়ি তারা হাততালির জন্য লেখে না। আমাদের এখানে আবৃত্তির জন্য একধরনের কবিতা বেছে নেয়া হয়। তারা হাততালির জন্য পড়ে। মহৎ কবিতা তারা কখনোই নির্বাচিত করে না।

জাহেদ সরওয়ার : বোদলেয়ার একবার বলেছিল, কবিতা যা, তা আবৃত্তিযোগ্য না। বা, যা আবৃত্তি করা যায় না, তাই কবিতা।
আসাদ চৌধুরী : না। আমি তা মনে করি না। হয়ত আবৃত্তিওয়ালারা অন্যের কবিতা বেশি পড়ছে। আর তাই রেগেমেগে বলেছিলেন। হতে পারে। যারা আবৃত্তি করে তারা তো আসলে পরের ধনে পোদ্দারি করে। দেখা গেল যে কবি না খেয়ে মরছে আর আবৃত্তিওয়ালা তারকা হয়ে গেছে। এ রকমই তো হয়। (সংক্ষিপ্ত) পুনর্মুদ্রণ

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
কান উৎসব ২০২৪স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে