X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

সর্পদেবী মনসা || তাবিশ খায়ের

অনুবাদ : তপন শাহেদ
০৪ মে ২০১৬, ১৪:৪১আপডেট : ০৪ মে ২০১৬, ১৪:৫৭

হক মনসার কাহিনীগুলোর একটা পাদটীকা-কণ্টকিত, নানান কাহিনীর আসল উৎস আর তাদের ঐতিহাসিক গুরুত্বের তালিকা সংবলিত পণ্ডিতি অনুবাদ প্রস্তুত করেননি। ওরকম কাজ আগেই অনেকেই করেছেন। বরং তার বদলে কায়সার যেটা করেছেন তা হলো, মনসার বহু কাহিনীকে একত্র করে সেগুলোকে একটার সঙ্গে আরেকটাকে জুড়ে বর্তমানের ঢঙে বলে গেছেন যাতে সেগুলো সাধারণ পাঠকের কাছেও উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারে।

বইয়ের প্রচ্ছদ লৌকিক পুরাণ যেভাবে মানুষকে তাদের ভীতি আর ভালোবাসার অর্থ বুঝতে সাহায্য করেছে।

ইউরোপে এই পা-বিহীন সরীসৃপ বেচারার ভাগ্য আর ফিরলো না, তা বাইবেলের সূত্রে খ্যাতি তার যতই থাকুক, তবে কপাল ভালো যে দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যাপারটা অন্যরকম হয়েছে। আমি বড়ো হয়েছি বিহারের একটা ছোটো শহরে, সেখানে একটা রাজগোখরা চোখে পড়লে মহাশোরগোল ওঠে। সেটা যে সবসময় কেবল ভয় তা নয়, একটা সমীহ আর দেবভক্তির ব্যাপারও তাতে থাকে। আমাদের মতো মুসলিম পরিবারেও বাগানে গোখরা দেখলে সেটাকে না মেরে তার আপন রাস্তায় চলে যেতে দেওয়া হয়; কারণ তার কোনো ক্ষতি করলে সেটা আমাদের অন্তত কিছু হিন্দু প্রতিবেশীর চোখে মহাপাপ বলে গণ্য হবে।
আমরা যারা এরকম গল্প-কাহিনী শুনে বড়ো হয়েছি যেখানে সাপ শুধু ভয় আর আকর্ষণের বস্তুই নয়, বরং সম্মান, সমীহ এমনকি ভক্তির পাত্র, তাদের জন্য কায়সার হকের The Triumph of the Snake Goddess অবশ্যপাঠ্য একটা বই। হকের সংগৃহীত এবং অনূদিত কাহিনীসংগ্রহটির ভূমিকায় ওয়েনডি ডোনিগার প্রশংসা করেছেন গল্পগুলোর; তাঁর ভাষায় গল্পগুলো দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে তার পূর্বাঞ্চলে, বহুলপ্রচলিত মনসার লোককাহিনীগুলোর একটা ‘অ-পণ্ডিতি সংস্করণ’ জোগান দিয়েছে।

ওয়েনডি যেটা বুঝিয়েছেন তা হলো, হক মনসার কাহিনীগুলোর একটা পাদটীকা-কণ্টকিত, নানান কাহিনীর আসল উৎস আর তাদের ঐতিহাসিক গুরুত্বের তালিকা সংবলিত পণ্ডিতি অনুবাদ প্রস্তুত করেননি। ওরকম কাজ আগেই অনেকেই করেছেন। বরং তার বদলে কায়সার যেটা করেছেন তা হলো, মনসার বহু কাহিনীকে একত্র করে সেগুলোকে একটার সঙ্গে আরেকটাকে জুড়ে বর্তমানের ঢঙে বলে গেছেন যাতে সেগুলো সাধারণ পাঠকের কাছেও উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারে।

মনসাকাহিনীর বেলায় এই ব্যাপারটা ভালোই ফল দেয় কেননা কোনো ধর্মপুস্তকের অপরিবর্তনীয় কথামালা থেকে তুলে আনা কাহিনী নয় এগুলো। বরং এগুলো চিরকালই ছিলো বহু লিখিত ও মৌখিক কাহিনীধারার অংশ হিসেবে। কখনো কখনো এক কাহিনী মিশে গেছে অন্য কাহিনীর সাথে, যোগ হয়েছে নতুন নতুন উপাদান, এই সেদিনের মুসলমান শাসনকাল অব্দি। অন্যভাবে বলতে গেলে, সর্পদেবী মনসাকাহিনীর বহু ‘লোক’-সংগ্রহের একটি হবার ক্ষমতা হকের অনুবাদগ্রন্থটির আছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হলেও পাণ্ডিত্য প্রায় এড়িয়েই চলেন কায়সার হক, আর স্পষ্টতই তাঁর ভিতরের কবিসত্তাটি প্রাঞ্জল গদ্যে যেন তারিয়ে তারিয়ে নতুন স্বরে আবার শোনায় মনসাকাহিনীগুলো।

হক যেমনটা লক্ষ্য বলেছেন, এই কাহিনীসংগ্রহে পাদটীকা শুধু ‘ভূমিকা’ এবং ‘পূর্বকথন’ অংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ―“মনসাকাহিনীগুলো যে কাব্যধারার অন্তর্ভুক্ত তা হলো মঙ্গলকাব্য, যার অর্থ এমন কাহিনীকাব্য যাতে দেবদেবীদের প্রশস্তি গেয়ে তাদের আশীর্বাদ বা মঙ্গল কামনা করা হয়।” বহু সংস্কৃতিতে প্রচলিত এই ঐতিহ্যের মূল দক্ষিণ এশিয়ার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসের মধ্যে প্রোথিত, মধ্যযুগের অগ্রগতির মধ্যে দিয়ে পরিবাহিত এবং আধুনিককাল পর্যন্ত বিস্তৃত। ভূমিকায় হক জানিয়েছেন মনসামঙ্গলের আদি রচয়িতা পঞ্চদশ শতাব্দীরও আগের মানুষ, যদিও বেশিরভাগ পূর্ণ কাব্য রচিত হয়েছে ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যে।

এই জীবন্ত ও বহু-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটা ভালো উদাহরণ হলো দেবী মনসার সঙ্গে ‘রাজা হাসান এবং রাজপুত্র হোসেনের’ লড়াইয়ের কাহিনী; এটা স্পষ্টতই মধ্যযুগের একটা প্রক্ষেপ। হাসান আর হোসেনকে দেখানো হয়েছে বাংলার মুসলিম শাসক হিসেবে, তাঁরা বন কেটে কৃষি বাড়ান, ফলে সর্পদেবীর গোয়ালা-পুজারিদের সাথে তাঁদের বিরোধ বাধে। যাই হোক, যুদ্ধে উচিত শিক্ষা পেয়ে রাজা হাসান যখন মনসার দেবীমাহাত্ম্য স্বীকার করে নেন, তখন উদারহৃদয় দেবী তাঁদের রাজ্য আর প্রজাপাট ফিরিয়ে দেন। তাঁদেরকে মনসার দুই ভাই বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ওয়াকিবহাল পাঠকমাত্রই জানেন যে মনসা হলেন প্রভু শিবের কন্যা।

আরো অনেকরকম মনসাকাহিনী আছে যাতে আদিবাসী কৃষ্টি (প্রতিষ্ঠিত ধর্মগুলো যাকে প্রায়শই উপেক্ষা করে কিংবা ছোটো করে দেখে) থেকে শুরু করে মুসলিম ঐতিহ্য―সকল উপাদানের মিশ্রণ ঘটেছে। এই মিশ্রণ এতই অদ্ভুত যে, শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলি ধর্মান্ধ আর রাজনীতিকদের অনুশাসনকে অতিক্রম করে গেছে।
সমন্বয়বাদের আলোকে এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলাটা অংশত ভুল দিকে চালিত করতে পারে, কেননা এতে অতীতকে বর্তমানের চোখে দেখার একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়। এ ব্যাপারে হক রিচার্ড ঈটনকে উদ্ধৃত করেছেন, আমার মতে সঠিকভাবেই: “এতে হয়তো পাঠকের চোখে ভাসবে, একেবারে অবিমিশ্র একদল বাঙালি গ্রামবাসী তাদের চলমান নিত্যকার জীবনযুদ্ধের মধ্যে আধিভৌতিক শক্তিকে পরাস্ত করার জন্য বিরাট সুপরিচিত সংগ্রহশালা থেকে যখন যেমন দরকার একেকটা হাতিয়ার তুলে নিচ্ছে―কখনো দেবতা, কখনো-বা একটা পবিত্র নদী।”

এই কথাটাই সর্পদেবীর কাহিনীগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়। তারা আরো মনে করিয়ে দেয় যে, ‘অলৌকিক’/পবিত্র-এর সমস্ত ধারণার অন্তরে আছে অদ্ভুত এক বৈপরিত্ব, এমনকি স্ববিরোধিতা : অলৌকিক/পবিত্র একই সঙ্গে হতে পারে মনোরম এবং ভয়ঙ্কর, সৃষ্টিশীল এবং বিধ্বংসী, প্রাণদায়ী এবং প্রাণ-সংহারক। আমাদের মানবসভ্যতা হয়তো এই দুই চরমসীমার মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যাপার। এইসব তত্ত্বচিন্তার কথা বাদ দিলে বলা যায়, বইটিকে স্রেফ রাক্ষস, যুদ্ধ, যখন খুশি রূপ পাল্টানো এসবের গল্প হিসেবেও পড়া যায়, সেসব এমনই সাংঘাতিক যে পড়লে আমাদের জাদুবাস্তবতাবাদী লেখকদের চোখও হিংসায় জ্বলে যাবে।

The Triumph of the Snake Goddess, Kaiser Haq, Harvard University Press, £25.95.  

সম্পর্কিত
সাঙ্গ হলো প্রাণের মেলা
২৫০ শিশু লিখলো ‘আমাদের জাতির পিতা, আমাদের শ্রেষ্ঠ মিতা’
আজকের প্রকাশিত বই
সর্বশেষ খবর
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
সর্বাধিক পঠিত
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!