X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফরিদ কবিরের কবিতা ও পাঠ অনুভূতি

.
০৯ মে ২০১৬, ১৩:০৩আপডেট : ০৯ মে ২০১৬, ১৫:৩৫

ফরিদ কবিরের কবিতা ও পাঠ অনুভূতি ফরিদ কবির ৮০’র দশকের অগ্রগণ্য কবি। তাঁর কবিতার বই- হৃদপিণ্ডে রক্তপাত, ওড়ে ঘুম ওড়ে গাঙচিল, অনন্ত দরোজাগুচ্ছ, মন্ত্র, ওঁ প্রকৃতি ওঁ প্রেম। এছাড়া প্রকাশিত হয়েছে কবিতা সংকলন, ‘আমার কবিতা’ ‘প্রেমের কবিতা’ এবং প্রবন্ধ সংকলন ‘আমার গদ্য’। এখানে গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত থেকে ২০টি বাছাই কবিতা প্রকাশ করা হলো। সঙ্গে পাঠ অনুভূতি। লিখেছেন, ফেরদৌস মাহমুদ, সৌম্য সরকার ও জিনাত জাহান খান। 


 

 

ট্রেন


ট্রেন আমাদের নামিয়ে দিয়ে গেল
মাঝপথে, অচেনা স্টেশনে

মানুষ যেখানে যেতে চায় সেটাই কি গন্তব্য?
নাকি, তারা যেখানে নামে?
নাকি, গন্তব্যই খুঁজে নেয় তার নিজস্ব মানুষ!

বিহ্বল স্টেশনে নেমে আমরাও ভাবি-
এখানেই কি নামতে চেয়েছি
নাকি, ট্রেনই নামিয়ে দিয়ে গেছে আমাদের
এই ঘন কুয়াশারাত্রিতে!

যেখানে নেমেছি, কিংবা যেখানে যাওয়ার কথা ছিল
কিছুই আসলে সত্য নয়

আমাদের চোখের সামনে শুধু ছবি হয়ে থাকে
ট্রেনের জানালা
আর, খুব দ্রুত ছুটে চলা যমুনা ব্রিজ...



সাপ-লুডু

সাপ-লুডু বেশ বিপজ্জনক!
খেলতে গেলেই দেখি, সাপগুলি জ্যান্ত হয়ে যায়
ছোবলের ভয়ে আমি লুডুর এ-ঘর থেকে অন্য ঘরে
ক্রমাগত ছুটতে থাকি!

ওপরে যাওয়ার জন্য মইগুলি খুঁজি
একটু আগেও পড়ে ছিলো, যত্রতত্র

কিন্তু তোমাদের মধ্যে কেউ একজন
সিঁড়িগুলি সরিয়ে ফেলেছো

আমি যে ধরবো, নেই তেমন একটা হাতও
অথচ পাশেই ছিলে তুমি
অথবা তোমার মতো অন্য কেউ!

সাপগুলি আস্তে আস্তে ঘিরে ফেলেছে চারপাশ থেকে
আর, আমি ছোবল খাওয়ার জন্য তৈরি হতে থাকি...




আয়না

আমি দেখি?
নাকি আয়নাই আমাকে দেখায়?
নিজেকেই দেখছি হয়তো
যদিও সামনে যাকে দেখি- দেখতে আমারই মতো
কিন্তু আমি নই

কেননা, আমি তো মৃত
বিধ্বস্ত আমার মুখ, ভয় দুই চোখের পাতায়

আয়না রহস্যময়, ভার্চুয়াল আরেক দুনিয়া
সেখানে আমার বিম্ব বরাবর ঝকঝকে, জীবন্ত
বরং কিছুটা স্মার্ট

যেমন আজ সে বাইরে এসেই
আমাকে পাঠিয়ে দিলো আয়নার ভেতরে

আয়নার ওপাশে ভয়ানক অন্ধকার
অথচ এপাশ থেকে সব সময় উজ্জ্বল দেখায়!

 

গণিত

গণিত বড়ই রহস্যময়
শেখায় দুয়ে দুয়ে চার...
কিন্তু বাস্তবে এ হিসাব কখনো মেলে না
দুয়ে দুয়ে ২, ৩ এমনকি
৫ কিংবা ৭ হয়
৪ কিছুতেই নয়

কী কী বর্ণ যোগ অথবা বিয়োগ করলে
অংকটা মিলবে, জানা নাই

আমি দুয়ের সঙ্গে ২ যোগ করি, ৩ যোগ করি
লাল এমনকি নীল যোগ করি

তুমি দুই থেকে দুঃখ বিয়োগ করেও পাও ৫ অথবা ৭
আমি দুয়ের সঙ্গে তোমাকে যোগ করেও ২ অথবা ৩

বিয়োগ করলেও তোমার যোগফল মেলে
আমি যোগ করলেও বিয়োগফল

আমি দুয়ে দুয়ে পাই ২ বা ৩
তুমি ৫, ৭ কিংবা ৯

একথা তো আজ বলতেই পারো
দুয়ে দুয়ে তুমিও চারই চেয়েছিলে
৫, ৭, ৯- কিছুতেই নয়...

 

শূন্য

এক শূন্য থেকে ঢুকে যাচ্ছি
অসংখ্য শূন্যের মধ্যে
আর, সরে যাচ্ছি ডান দিকে, ক্রমাগত
মানে, অন্ধকারে...
মানে, কিছুক্ষণ আগেও তুমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলে
ফোঁটা ফোঁটা আলোকবৃষ্টিতে...

আদ্যোপান্ত যেন এক বাতাসপ্রতিমা,
ছড়িয়ে চলেছ বর্ণহীন কিংবা
বর্ণিল বুদ্বুদ, চারপাশে

তবু আমি নিঃশ্বাসে তোমাকে নেই
প্রশ্বাসে নিজেকে ছাড়ি

শূন্যে...

 

ফুল

 

ঘ্রাণেই সম্পূর্ণ স্নান, তবু খোঁজো তুমি জল-সাবানের ফেনা

কী আছে রোমাঞ্চ স্নানঘরে
চামড়ার নিচে যদি রয়ে যায় অন্ধকার
আর, কালো ময়লার স্তূপ
সহস্র বুদ্বুদ থেকে ফিরে
কীভাবে নিজেকে ভাবো তুমি শতভাগ পরিষ্কার

যে-কারণে বলি, ফুলই প্রকৃত সমুদ্র
কেননা, তাকেই আমি ঘ্রাণসহ বর্ণিল রেখেছি

কাঁটার সংঘাতে যদি ঝরে কিছু রক্তের গরম
তুমি কাটো সাঁতার গোলাপে
আর, পাপড়ির বর্ণে করো জন্মোৎসব

আজ বলি, ঘ্রাণের জন্যই
এতোকাল পুষ্পপূজা নিষিদ্ধ করিনি

 

পাখি

উড়লেই পতনের ডাক, তবু উড়ে যাও
তুমি পাখি ভাবছো নিজেকে
মাটি দখলের পর রক্তচিহ্ন এখনো ডানায়
আজকে নেমেছো তুমি আকাশ দখলে
শিরোস্ত্রাণে হেসে উঠছে নক্ষত্রমণ্ডলী

আকাশকে পাখিমুক্ত রেখে তুমি কেবল ঘুমোবে
আর, জেগে উঠে প্লাস্টিকের স্বপ্ন সাজাবে টেবিলে
প্রকৃত তোমার স্বপ্ন এতোকাল পাখিরাই বহন করেছে

নিজেকে যতোই ভাবো দীর্ঘ, আজ বলি-
পাখিদের চোখে তুমি সর্বদাই ছোট
নিজেকে জানার জন্য মাঝে-মধ্যে তোমার বাড়িতে
তাদেরকে নিমন্ত্রণ কোরো

 

গাছ

কাঠের শরীরে গাঢ় নীল দাগ দেখলে বুঝবে
দুঃখে ছিলো বৃক্ষ-সম্প্রদায়
কীভাবে মুছতে হয় বেদনার জল
সেই মন্ত্র তোমাদের জানা হয়ে গেছে

বৃক্ষকুল কিছুই ভোলে না
কবে তুমি নদীগর্ভে পিছলে পড়েছো
তোমাকে উল্লেখ করে গোল দুঃখ এঁকে রাখে মনে

বলি আজ, তোমাদের জন্য নয় এই গাছপালা
গাছের জন্যই তুমি ধীরে ধীরে যুবক হয়েছো

হৃদয়ের চর্চা তুমি কীভাবে করবে
জেনে নাও বৃক্ষদের কাছে

 

পাহাড়

বিশ্বাসে মেলে না যদি তবে খোঁজো তর্কে
সেখান থেকেই শুরু হোক বৃক্ষরোপণের ধুম
অবিশ্বাসে সকল মহিমা!

তোমার চাইতে উঁচু নয় কোনো গর্বিত পাহাড়ও
তুমি ছোট হতে হতে তাকে এই উচ্চতা দিয়েছো
মানবিক ঝর্ণাধারা ঢুকিয়ে দিয়েছো মৃত পাথরের দেহে

তোমার অজ্ঞাতে সবুজ পাহাড়গণ
হয়ে উঠছে মনুষ্যপ্রবণ
পর্বতই মানুষ যদি, অধীনতা মেনে নাও তার

পাহাড়ের পরিচর্যা হোক আজ তোমার নিয়তি

 

ঘ্রাণ

তোমার ঘ্রাণেও আছে আলাদা সৌন্দর্য
সামান্য কথার পর সমুদ্র-দূরত্বও যেন নিমিষে উধাও
আর, সেই ঘ্রাণ এসে মিশে যায় আমার শরীরে

দ্বৈত গন্ধ নিয়ে আমি উন্মাতাল
যেন এইমাত্র শেষ হলো সম্পূর্ণ সঙ্গম
তোমার রঙিন ঘ্রাণ টের পায় এতো দূরে গাছের পাতাও

আজ বুঝি- রূপে নয়, ঘ্রাণে আছে সকল রহস্য
এর টানে ফুলের কাছেই
বারবার ফিরে যায় সকল মৌমাছি

নিজেকেও মৌমাছি বলেই মনে হচ্ছে আজ
ঘ্রাণ থেকে খুলে নিচ্ছি অসামান্য মধু...

 

খুন

করো চলাফেরা ধমনিতে, উপশিরায়, শিরায়
এই স্রোত চলুক নির্জনে
আমাকে রঞ্জিত করে আপাদমস্তক তুমি বয়ে চলো
টগবগ ফুটতে থাকো হৃদয়ে, মস্তিস্কে
আমাকে পুড়িয়ে দাও তোমার গরমে

বল, কেন হলে তুমি এতোটা আগ্রাসী!
মিশে যাচ্ছ রক্তের প্রচণ্ড লালে, শুভ্র কণিকায়
ছুটে যাচ্ছ শরীরের আনাচে-কানাচে!

তোমাকে ছিনিয়ে নিতে এখন তৎপর
ভয়ঙ্কর আলপিন, ঘাতক ছুরিও...

গোপনে তোমাকে বলি-
তোমার একটা ফোঁটাও আমি কাউকে দেব না...

 


শরীর

 

বন্দি নয়, তোর হাত নিজে এসে আশ্রয় নিয়েছে
এই করতলে
তোর কাছে নিরাপদ নয় কোনো কিছু
তোর হাত, হাতের আঙুল

সামান্য যে গাছ, সেও অরক্ষিত রাখে না পাতাকে
তুলে ধরে যতোটা সম্ভব শূন্যে, স্পর্শের বাইরে
যে কারণে পাতা থাকে নিতান্ত সবুজ

স্পর্শাতীত কিছু নেই তোর
যে রকম হাতের ইশারা বুঝে তোর হাত
ঢুকে পড়ে আমার মুঠোয়
কথা হয় আঙুলে আঙুলে

শরীরও যথেষ্ট জ্ঞানী তোর
ভাষা বোঝে আরেক দেহের...

 

পোকা



ঝরছে সর্বত্র পোকাবৃষ্টি; অনর্গল
লাল-নীল; কেউ কেউ প্রচণ্ড সবুজ
যে কোনো বৃষ্টিই মৃত্তিকায় নেমে নদী হয়ে যায়
পোকাদেরও আছে মৃদু ঢেউয়ের স্বভাব
তাদের কয়েকজন বিনা উস্কানিতে
ঢুকে পড়ছে এমনকি আমার স্বপ্নের ভেতরেও

তুমি মানছ না এই কীটের সন্ত্রাস
চাইছ নিশ্চিহ্ন হোক তাদের তরঙ্গ
অথচ জানো না-
মানুষেরা কীটের সমষ্টি
মরে গেলে তারা সব জ্যান্ত হয়ে ওঠে

বলি আজ, মানুষেরা বেঁচে থাকলেই
শরীরের পোকাগুলি জাগতে পারে না।

 

যদি ভাবে কেউ

 

যদি ভাবে কেউ এই রাত্রি যাবে সকালে
এই চন্দ্র শাদা মার্বেল সেজে গড়াবে নীল চাদরে
কালো রাত্রি গিলে খাবে সেই লাল রৌদ্র
সেটা ঠিক নয়
কার নিঃশ্বাস হবে নিঃশেষ
কার দরোজায় কার নিষেধের তালা ঝুলবে
কেউ জানে কি?

এই নৌকো এই পারাপার আজ বন্ধ
এই বর্ষণ ফিরে যাবে সেই মহাশূন্যে
চিতাবাঘও তার শেষ আশ্রয় ছিঁড়ে বেরোবে
দূর নগরী পরিভ্রমণে!
(অসম্ভব বলে সত্যি কোন কথা নেই)

এতো ভুল দিন কে যে রাত-দিন বোনে মগজে
কে যে করে কার লোনা জল পান ভুল স্বপ্নে
কেউ জানে কি
কেউ জা নে না

কারও ছায়া তার ঘরে ঘুমুবে- সে ঘুরবে
নাকি ছায়া তার টো টো ঘুরবে
শুধু দেহটা ঘরে ঘুমুবে নিশ্চিন্তে!
(অসম্ভব বলে সত্যি কোন কিছু নেই)।

 

পরিস্থিতি-৬

 

টোকা দিলে শব্দ হয় শূন্যে
বিভ্রম কাটেনি, এই ভয়ে চুপচাপ বসে থাকি
পকেটে অগ্নির বাক্স খুঁজতে গিয়েই এতো বিপত্তি বেঁধেছে

বারবার উঠে আসে তোমার আঙুল
তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে
চুম্বন-মুহূর্তে আমি সতর্ক থাকি না
তোমার একটি চোখ আমার পেটের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলো

এখন শরীরভর্তি চোখ
পেটে, পিঠে, হাতের তালুতে
ফলে আমি বাইরে বেরোলে তুমি সব দেখতে পাও

কিন্তু তুমি বেরোলেই আমি কিছু দেখতে পাই না
তুমিও তো আমার একটা চোখ খেয়ে ফেলেছিলে!

 

বাড়ি

 

একটি বাড়ির দিকে উঁকি দিলো আরেকটি বাড়ি
ভেতরে মানুষ নেই, সিগারেট ঠোঁটে
বসে আছে জানালার কাঁচ
বুক-শেলফ হেঁটে গেলো পয়মন্ত চেয়ারের দিকে
দুলছে চেয়ার

বিছানায় শুয়ে আছে বালিশের প্রেত
জানালার পাট চোখ তুলে
দেখে নিলো চন্দ্রের আলোকে
মৌমাছির মতো টেবিলের ওপর উড়ছে ঘুম
ডায়েরির পাতা

কার্নিশে কার্নিশ ছুঁয়ে শাদা বাড়িটিকে
চুমু খেলো দোতলা বাড়িটা

বাড়িতে কেউ কি আছে? সারা রাত জেগে
খুব ভোরে ঘুমিয়ে পড়লো আলনায় ঝুলে থাকা
মুণ্ডুহীন শার্ট
পা কোথায়? হাতের আঙুল?
বাতাসে ডানার গন্ধ, আর
বাড়ির ভেতরে ফিসফিস
হাত-পা আঙুল খুলে আলনায় ঝোলে মুণ্ডুহীন শার্ট
একবার শুধু বুক-শেলফ
হেঁটে গেলো পয়মন্ত চেয়ারের দিকে
দুলছে চেয়ার
মৌমাছির মতো
টেবিলের ওপর উড়ছে ঘুম, ডায়েরির পাতা

একটি বাড়ির দিকে হেঁটে এলো আরেকটি বাড়ি...

 

এখন রাস্তাকে এখন ছায়াকে

 

আমি নিচে, রাস্তা ছিলো আমার ওপরে
উঠে দাঁড়াতেই রাস্তা মুখোমুখি হলো

আমিও সছায়া, সর্বভুক
সমুদ্রের মতো বাড়ালাম সম্মুখে পা
আমার শরীর থেকে ঝনঝন ছিটকে পড়লো
এক শত অগ্নির টুকরো
সে তার তরল জিভে তুলে নিলো রাস্তার শরীর

রাস্তা কি নিঃসঙ্গ ছিলো?

চুলে-চোখে যন্ত্রণার চিহ্ন
গেঁথে নিয়ে রাস্তা তাকালো আমার দিকে
চোখে টলটলে লাল খুন
তারপর মৃত বেড়ালছানার মতো
আমার ছায়াকে দাঁতে গেঁথে
চলে গেলো নির্জন শহরে

এখন রাস্তাকে
এখন ছায়াকে আমি কোথাও দেখি না!

 

রাস্তা

 

রাস্তাকে যতোটা সহজ মনে হয়, আসলে সে ততো সরল না
পথে নেমে আমিও বুঝেছি রাস্তামাত্র রমণীস্বভাবী
সঙ্গে আছে, কিন্তু সঙ্গে নেই
ঘুরপাক খেতে থাকি রাস্তার সন্ধানে

রাস্তাও আদতে এক নারী
তোমাকে ডাকবেই
ডেকে নিয়ে ফেলে দেবে তুমুল বিভ্রমে
না রাস্তা না পথ তুমি কাউকেই পাবে না

পাবো না জেনেও আমি বারবার রাস্তায় নেমেছি
এ পথে সে পথে খুঁজছি এখনো

রাস্তাও মানুষ খোঁজে, সেও জানে
যে পথে যায় না কেউ, সে পথ কখনো পথ নয়...

 

নতুন কবিতা

 

পড়তে পড়তে ধরো, কবিতার তিনটি অক্ষর খসে মাটিতে পড়েছে
তুমি কি কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে ঢোকাবে?

রাত্রির বর্ণনা- ধরো, দুধশাদা বকের শরীর
তুমি তার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে
টের পেলে রক্তের উষ্ণতা
রাত্রি কি গরম নাকি!

দিনকে বলছি আমি রোমশ ভালুক
তুমি হাত বাড়াতেই কামড় বসালো
এখন রাত্রি না দিন, তুমি স্থির করো

রাত্রি হলো বক, আর দিন-
তোমার চোখের মতো নিকশ ভালুক

ধরো, এই বক উড়ে গেলো ভালুকের দিকে
শুয়েছিলে, তুমি ঘুম থেকে উঠে দেখো-
সামনেই ভালুক দাঁড়ানো!

এখন প্রকৃতপক্ষে সন্ধ্যা
তুমি একে সকাল বলছো
আর আমি- রাত্রি

এখন চেয়ারে বসে আছো
যদিও সেটাকে আমি বিছানা বলছি
বিছানা চেয়ার হলে তুমি দ্বিধাগ্রস্ত
আসলে কোথায় তুমি?

তুমি ঘরে আছো
আসলে কি ঘরে? নাকি, বাইরে রয়েছো?
বাইরে থাকলে ধরে নাও ঘরে আছো
ঘর মানে, আসলে বাইরে

পড়তে পড়তে ধরো, বই ফেলে আচম্বিত বাইরে বেরোলে
একটু খেয়াল করে দেখো-

বাইরে বেরিয়ে তুমি আসলে তো ঘরেই রয়েছো!

 

বৃষ্টি

 

তোমার প্রতিটি ঘরে বাঁধিয়ে রেখেছ এই দৃশ্য-
জানালার ওপাশ থেকে ঝরছে তীব্র বৃষ্টি, এমনকি
দু’একটি লাল-নীল বৃষ্টির ফোঁটা ফুটে আছে জানালার শিকে
ফোঁটাগুলি এমন জীবন্ত
আসল বর্ষণ, নাকি জানালায় বর্ষণের ছবি
বুঝতে পারো না

মেঘের জরায়ু ছিঁড়ে তবু বৃষ্টি নামে
তোমাকে ভিজিয়ে দেবে এই আশঙ্কায়
তুমি রাস্তা ছেড়ে ঘরে পালিয়ে গিয়েছো
বৃষ্টি নয়, তোমার পছন্দ-
বর্ষণের বর্ণিল পতন

ভাবো একবার- ঘরের কঠিন ছাদ থেকে ঝরছে তীব্র বৃষ্টি
আর, ধুয়ে দিচ্ছে ঘরদোর
আর, ভিজে যাচ্ছ তুমি
তোমার সংশয় ধুয়ে দিতে
তোমার শরীর ফুঁড়ে ঢুকে যাচ্ছে বৃষ্টির মায়াবী ফোঁটা...

বলি আজ, মাঝেমধ্যে তোমার বাড়িতে বৃষ্টিকেও নিমন্ত্রণ কোরো


 

পাঠ-অনুভূতি

আজকের প্রেক্ষাপটে ফরিদ কবিরের কবিতাকে হয়ত নতুন কিছু মনে হবে না, তবে এটা নিশ্চিত তিনি যখন লিখতে শুরু করেছিলেন তখন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কবিতাগুলো নতুন ধরনেরই মনে হত

ফেরদৌস মাহমুদ
চিত্রকল্পের চেয়ে কথা বা ভাবটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে
ফরিদ কবির যখন কবিতা লিখতে শুরু করেন, বাংলাদেশের কবিতা তখন শাসন করছিলেন পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কবিরা। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বাংলাদেশে তখন বিশেষ এক ধরণের কবিতার আধিপত্য চলছিল। ওই কবিতাগুলোকে বলা যায় বর্ণনাত্মক কবিতা, অতিকথনের কবিতা, রাজনৈতিক উচ্চকণ্ঠের কবিতা বা প্রেমের অনুভূতিকে তরলভাবে উপস্থাপনের কবিতা। ফরিদ কবিরের সামনে তখন বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, ওই ধারার বাইরে গিয়ে নিজেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার। তিনি যে সেই চ্যালেঞ্জ জোড়ালোভাবেই গ্রহণ করেছিলেন, তা তার কবিতার দিকে তাকালেই টের পাওয়া যায়।

আজকের প্রেক্ষাপটে ফরিদ কবিরের কবিতাকে হয়ত নতুন কিছু মনে হবে না, তবে এটা নিশ্চিত তিনি যখন লিখতে শুরু করেছিলেন তখন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কবিতাগুলো নতুন ধরনেরই মনে হত। আর এই নতুন কবিতার কাছে পৌঁছানোর জন্য তিনি অনুসন্ধানী হাত বাড়িয়েছিলেন যেমন পশ্চিমা বিশ্বের কবিতার দিকে, তেমনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কবিতার দিকেও। বলা যায় উৎপলকুমার বসু, বিনয় মজুমদার, জয় গোস্বামী, রণজিৎ দাশ বা মৃদুল দাশগুপ্তরা তাকে নতুন পথ খোঁজার ক্ষেত্রে অনেক বেশি অনুপ্রাণিত করেছেন। নিজের অজান্তেই হয়ত বিশ্বকবিতার অনেক চেনা পঙক্তির ভাব ঢুকে পড়েছে তার কবিতায়, যেমন-

রাস্তাও মানুষ খোঁজে, সেও জানে
যে পথে যায় না কেউ, সে পথ কখনো পথ নয়...
[রাস্তা: ফরিদ কবির]

তার এই লাইন দুটো পড়ে আমাদের মনে পাড়ে যায় রবার্ট ফ্রস্টের ‘দ্য রোড নট টেকেন’ কবিতার কয়েকটি লাইন, যেখানে ফ্রস্ট বলেছেন,

Two roads diverged in a wood, and I—

I took the one less traveled by,

And that has made all the difference

[The road not taken]  

তবে একজন খাঁটি কবি যেমন বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজের পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে যান, ফরিদ কবির তার সময়ে নতুন কবিতা নিয়ে সেভাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন।
‘নতুন’ শব্দটি এমন এক শব্দ যার জন্মই হয়েছে পুরনো হয়ে যাওয়ার জন্য, তাই দেখা যায় আজ যা নতুন দিন ফুরোলেই তা পুরনো। এক্ষেত্রে আমরা সেই নতুনকে চাই যা এক সময়ে ক্লাসিক হয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। ফরিদ কবিরের কবিতার মধ্যে এমন কিছু ভাবের আমরা দেখা পাই যার সঙ্গে চিরায়ত চিন্তাজগতের ঐক্য রয়েছে, আর এই ঐক্যই হয়ত ফরিদ কবিরের পরবর্তী কবিদের মধ্যে টিকে থাকার অস্ত্র। ফরিদ কবিরের কবিতাগুলোর দিকে তাকালে আমরা এক ধরনের দার্শনিক সিদ্ধান্তমূলক অনুভূতির দেখাই পাই।
ট্রেনে যাতায়াত, সাপলুডু খেলা, আয়না দর্শন, রাস্তা বা বাড়ির মত খুব পরিচিত অনুষঙ্গের ভেতর থেকে তিনি তার কবিতার বিষয় বের করে আনেন। পাঠকের ভেতরকার চিন্তাজগতকে খুঁচিয়ে দেন। বেশিরভাগ সময়ই কবিতার মধ্যে চিরায়ত মরমী অনুভূতিকে নিয়ে খেলেন এবং নিজেকে প্রকাশ করেন সহজ ও চেনা শব্দে। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ কবিতাতেই অক্ষরবৃত্তে তার দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। এছাড়া তার অনেক কবিতাতেই চিত্রকল্পের চেয়ে কথা বা ভাবটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যেমন- ‘যেখানে নেমেছি, কিংবা যেখানে যাওয়ার কথা ছিল/ কিছুই আসলে সত্য নয় [ট্রেন : ফরিদ কবির]’। কিংবা, ‘নিজেকে যতোই ভাবো দীর্ঘ, আজ বলি-/ পাখিদের চোখে তুমি সর্বদা ছোট/ [পাখি : ফরিদ কবির]’।

ফরিদ কবিরের কবিতা অধিকমাত্রায় পঠিত হোক এটাই কামনা করছি।


 

‘পাহাড়’ কবিতায় পাহাড়ের উচ্চতার সাথে মানুষের উচ্চতার তুলনা যথাযথ লাগেনি কেননা এই কবিতা মানুষকেন্দ্রিকতার ধারনা- যেখানে মানুষকে সবার চেয়ে উচু ও শ্রেষ্ঠে ধরে সামনে আগানো হয়- সেই পুরনো ও বাতিলযোগ্য ধারনাকে আঁকড়ে ধরে এগিয়েছে। তাছাড়া বৃষ্টি কবিতায় মেঘকে সেই আগের মতোই নারীর সাথে তুলনা করা হয়েছে (“মেঘের জরায়ু”) যেটি দুর্বল; “মেঘের মায়াবী ফোটা”ও একটি ক্লিশে প্রয়োগ

সৌম্য সরকার

সে দায় থেকে মুক্তি নেই

যেটুকু আমি বুঝি তাতে বলা যায় কবিতার- এবং সামগ্রিকভাবে লেখার- বিষয়বস্তু অফুরন্ত নয়, এমনকি তার একটা ছোটখাট তালিকাও তৈরি করে ফেলা যাবে চাইলে। লেখালেখির আদি থেকে দেশ-কাল-পাত্রভেদে সেই অল্পকিছু বিষয়ের মধ্যেই তো থাকেন লেখিয়েরা। নতুনটা সেখানে নয়, নতুন হয় ভাষার নিরীক্ষায়, আঙ্গিকের বৈচিত্র্যে, রসবোধের তারতম্যে, রাজনীতি সচেতনতায়। আমি যখন পড়ি তখন এগুলো মাথায় থাকে নিশ্চিত আর সর্বক্ষণ ভয়ে থাকি হতাশ হওয়ার- ক্লিশের মুখোমুখি হওয়ার ভয়।
যে কুড়িটি কবিতা পড়লাম এখানে সেগুলো আমাকে হতাশ করেনি। এমনকি প্রথম চারটি কবিতা- ‘ট্রেন’, ‘সাপ-লুডু’, ‘আয়না’, ‘গণিত’- পড়ে আমি আশান্বিত হয়েছি। কবিতা কয়টির মধ্যে যে অনুষঙ্গগুলো আমাকে নাড়িয়েছে : প্রচুর প্রশ্নবোধকের ব্যবহার, ব্যক্তির দ্বন্দ্ব, সংশয়, জীবন-যাপনের রহস্যময়তাকে স্বীকার করা, ‘না’-এর ব্যবহার, ধ্রুব সত্যকে অস্বীকার করা, বাস্তব ও অবাস্তবের মিশেল। ভালো লাগা কয়েকটি পঙক্তি তুলে দিই : “মানুষ যেখানে যেতে চায় সেটাই কি গন্তব্য?/ নাকি তারা যেখানে নামে/ নাকি গন্তব্যই খুঁজে নেয় তার নিজস্ব মানুষ!”; “যেখানে নেমেছি কিংবা যেখান যাওয়ার কথা ছিল/ কিছুই আসলে সত্য নয়”; “আমি ছোবল খাওয়ার জন্য তৈরি হতে থাকি”; “আমি দেখি নাকি আয়নাই আমাকে দেখায়”; “আয়নার ওপাশে ভয়ানক অন্ধকার”। ভালো লেগেছে এমন আর কবিতাগুলো : ‘বাড়ি’, ‘এখন রাস্তাকে এখন ছায়াকে’,। নতুনত্ব আছে আরো বেশ কিছু পঙক্তি ও শব্দবন্ধ তুলে দেয়ার লোভ সামলাচ্ছি না : “তুমি ঘরে আছো?/ আসলে কি ঘরে?”; “ সারা রাত জেগে খুব ভোরে ঘুমিয়ে পড়লো আয়নায় ঝুলে থাকা মুণ্ডুহীন শার্ট”; “কে যে করে কার লোনা জল পান ভুল স্বপ্নে/ কেউ জানে কি?”; “গোল দুঃখ একে...”; নিজেকে জানার জন্য মাঝে-মাঝে তোমার বাড়িতে তাদের (বৃক্ষদের) নিমন্ত্রণ কোরো”; “বিহ্বল স্টেশনে”। আরো উদাহরণ দেয়া যাবে।
তবে কিছু কবিতাকে এলিয়ে পড়তে দেখছি। যেটা হয় বেশিরভাগ ‘পুরুষ’ কবিদের- ‘তুমি’ যখন চলে আসে কবিতায়, ‘তুমি’র ব্যবহারে যথেষ্ট মুন্সিয়ানা থাকে না। কবিতার নাম : ‘শূন্য’, ‘ফুল’(কালো-অন্ধকার-ময়লা এই বিষয়গুলোকে সমার্থক দেখিয়ে বিপরীতে পরিষ্কার, সুন্দরকে দাঁড় করানো মানে রঙের রাজনীতিকে না বোঝা); ‘ঘ্রাণ’ কবিতায় নারীকে ফুল আর পুরুষকে মৌমাছি করা হয়েছে যে ক্লিশেটি আপত্তিকর। ‘খুন’ কবিতায় ব্যবহৃত “তোমার গরমে” ইমেজটি দুর্বল ও কাঁচা। ‘রাস্তা’ কবিতায় রাস্তার অসরলতাকে ‘রমণীস্বভাবী’ বলে অতি সরলীকরণ করা মানে জেন্ডার রাজনীতি বিষয়ে কবির অসচেতনতা প্রকাশ পাওয়া। ‘শরীর কবিতায় “সামান্য যে গাছ” শব্দবন্ধ ব্যবহার করা মানে যে বৃক্ষদের কাছে গিয়ে হৃদয়চর্চা শিখতে বলেছেন কবি ‘গাছ’ কবিতায়, সেই গাছদের অপমান করা। ‘পাহাড়’ কবিতায় পাহাড়ের উচ্চতার সাথে মানুষের উচ্চতার তুলনা যথাযথ লাগেনি কেননা এই কবিতা মানুষকেন্দ্রিকতার ধারনা- যেখানে মানুষকে সবার চেয়ে উচু ও শ্রেষ্ঠে ধরে সামনে আগানো হয়- সেই পুরনো ও বাতিলযোগ্য ধারনাকে আঁকড়ে ধরে এগিয়েছে। তাছাড়া বৃষ্টি কবিতায় মেঘকে সেই আগের মতোই নারীর সাথে তুলনা করা হয়েছে (“মেঘের জরায়ু”) যেটি দুর্বল; “মেঘের মায়াবী ফোটা”ও একটি ক্লিশে প্রয়োগ।
ব্যাপারটা হচ্ছে, কেউ কেউ দাবি করে আনন্দ পান কবিতা শুধু হৃদয়ের পণ্য(শব্দটি ইচ্ছে করে ব্যবহার করলাম কারণ কবিতাও আজকাল বিক্রি হয় কিনা!)। আমি একমত নই। কবিতা- শুধু কবিতা কেন, সব সাহিত্য ও শিল্পকর্ম- হৃদয়ের তো বটেই, তবে মাথারও। প্রজ্ঞা, মনন ইত্যদি ব্যবহার করে কবিতার বিষয়গত ও গঠনগত উৎকর্ষ বাড়ানোও কবির দায়। সে দায় থেকে মুক্তি নেই।
একজন কবির সবই ভালো কবিতা হয় না কিংবা একটি কবিতার সব শব্দই কাব্যিক হয় না, যেটুকু হয় সেটুকুর জন্যই আমাদের অপেক্ষা। আপাতত এটুকু বলা যায়, কুড়িটি কবিতা পড়ার পাঠপ্রতিক্রিয়া, মিডিয়ার ভাষায়, মিশ্র।


 

কবির যে গল্পের ছলে কাব্য প্রকাশে ভঙ্গিমা সেখানে কিন্তু কোনো অস্পষ্টতা, দুর্বোধ্যতা বা বাহুল্য ভাষার ছড়াছড়ি নেই তার কবিতার শরীরে। পাঠকদের ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছেন গোলকধাঁধা, হেঁয়ালি ও রহস্যচ্ছলে



জিনাত জাহান খান

জার্নি বাই এ ফিলোজফিক্যাল ট্রেইন

তখনো সন্ধ্যা নামেনি। শেষ বিকেলের কমলারোদ বলা যায়। চারিদিকে গুঁড়ো গুঁড়ো স্বর্ণাভ দ্যুতি ঝরছে। একজন নারী এমন এক দৃশ্যের ফ্রেমে ঢুকে পড়লো, মোলায়েম চুল ওড়ার মসৃণ শব্দে মাতাল কেউ একটা ছবি তুলে ফেললো তার। কিন্তু কে? কে এই ছবিটি তুললেন, কেনই বা তোলা হলো?

"আয়না রহস্যময়, ভার্চুয়াল আরেক দুনিয়া/ সেখানে আমার বিম্ব বরাবর ঝকঝকে/ জীবন্ত বরং কিছুটা স্মার্ট"
পরিচিত অথচ অপরিচিত জগত থেকে চেতন-নিশ্চেতনার পাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে যেন স্বপ্নের জগতে প্রবেশ। যদিও মনে হতে পারে জীবনানন্দ দাশ, হ্যাঁ এটা সঠিক জীবনানন্দ কাব্যকে স্বপ্নের কাছেই এনে চিত্রায়ন করতেন। কিন্তু এই কবির কবিতা পাঠে শুধু মনে হয়েছে vacation-এ ভ্রমণে যাওয়া। আর যাওয়ার পূর্বের, পরের এবং যাত্রাকালীন সব সময়টাই থাকা হয় একটা ঘোরের মাঝে। এই কবির কবিতাগুলো পাঠের সময় এমন ঘোর তৈরি করে...Journey by a philosophical train
"মানুষ যেখানে যেতে চায় সেটাই কি গন্তব্য?/ নাকি, তারা যেখানে নামে?/ নাকি/ গন্তব্যইই খুঁজে নেয় তার নিজস্ব মানুষ!"
আবার, "যেখানে নেমেছি, কিংবা যেখানে যাওয়ার কথা ছিল/ কিছুই আসলে সত্য নয়।"
বিশ্বের সবকিছুই সংশয়পূর্ণ। সংশয়হীন জ্ঞান অসম্পূর্ণ। চিন্তা বা মত প্রতিষ্ঠার পূর্বে সন্দেহই যাত্রা শুরু করে সংশয়বাদের। সন্দেহ, সংশয় ও দ্বিধা নিয়েই উৎপত্তি হয় একটা পরিপূর্ণ দর্শন। তাই প্রকৃতির বিষয়ে এক সর্বাত্মক দৃষ্টিলাভের অনুসন্ধান ও বস্তুর সার্বিক ব্যাখ্যা দেয়ার প্রচেষ্টাই এমন দর্শনের লক্ষ্য।
"বিশ্বাসে মেলে না যদি তবে খোঁজো তর্কে/ সেখান থেকেই শুরু হোক বৃক্ষরোপণের ধুম/ অবিশ্বাসে সকল মহিমা! "
এ কাব্যাংশে স্পট যে এই কবি, সমস্ত জ্ঞান যে সন্দেহে নিহিত তার এক দারুণ চিত্র এঁকেছেন। তার কবিতা পাঠে যে বিষয়টি বারবার উঠে এসেছে তা হলো, সুনির্দিষ্ট চিন্তা। আর তাকে যদি আমি গল্পকার বলি এই ক্ষেত্রে মনে হয় ভুল হবে না। প্রতিটি কবিতা অবলীলাক্রমে গল্পের ছলে কলমের নিব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লিখে গেছেন। আর এইভাবেই প্রবেশ করেছেন দার্শনিক ভ্রমণে। সাথে করে নিয়েছেন আদিসত্তার সরূপ ও সরূপের অঙ্গীভূত বৈশিষ্ট্যসমূহ।
এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের বাইরে আছে কী অন্য কোনো সত্তা? দ্রব্য, কার্যকারণ সম্পর্ক, ঈশ্বর, আত্মা, ইচ্ছার স্বাধীনতা সবটাই কী বিশ্বজগতের আদিসত্তার ধারক নয়? তবে এইসব তত্ত্ববিদ্যাই হোক প্রাণস্পন্দন।
"তোমার ঘ্রাণেও আছে আলাদা সৌন্দর্য/ সামান্য কথার পর সমুদ্র-দূরত্বও যেন নিমিষে উধাও/ আর, সেই ঘ্রাণ এসে মিশে যায় আমার শরীরে"
আবার-
"আজ বুঝি রূপে নয়, ঘ্রাণে আছে সকল রহস্য/ এর টানে ফুলের কাছেই/ বারবার ফিরে যায় সকল মৌমাছি"
কবি এখানে তার চিন্তা-চেতনা-কাব্যে রহস্য কিংবা সংশয় থেকে জৈবিক প্রেষণার চক্রে ঘুরতে চাইছেন। যদিও নিজেকে মায়াজাল থেকে উৎরে নিয়ে যেতে পারেননি।
"বল কেন হলে তুমি এতটা আগ্রাসী!/ মিশে যাচ্ছ রক্তের প্রচণ্ড লালে, শুভ্র কণিকায়/ ছুটে যাচ্ছ শরীরে আনাচেকানাচে!"
কবির যে গল্পের ছলে কাব্য প্রকাশে ভঙ্গিমা সেখানে কিন্তু কোনো অস্পষ্টতা, দুর্বোধ্যতা বা বাহুল্য ভাষার ছড়াছড়ি নেই তার কবিতার শরীরে। পাঠকদের ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছেন গোলকধাঁধা, হেঁয়ালি ও রহস্যচ্ছলে।
"বাড়িতে কেউ কি আছে? সারারাত জেগে/ খুব ভোরে ঘুমিয়ে পড়লো আলনায় ঝুলে থাকা/ মুণ্ডুহীন শার্ট/ পা কোথায়? হাতের আঙুল?/ বাতাসে ডানার গন্ধ, আর/ বাড়ির ভেতরে ফিসফিস হাত-পা আঙুল খুলে আলনায় ঝোলে মুণ্ডুহীন শার্ট/"
কবিতার ক্ষেত্রে সার্বিকতা ও নতুনত্বকে বলা যায় দর্শনের বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের ধারক। মনে আছে, একবার এক কবিতা আড্ডায় কেউ একজন আমাকে প্রশ্ন করেছিলো,' কবিতা কী?' উত্তরে বলেছিলাম অত জানি না, তবে এই মুহূর্তে মন বলছে, অধিবিদ্যা ও জ্ঞানবিদ্যার সঙ্গমই কবিতা। যাইহোক, কবি তার কবিতাকে নিয়ে যে দার্শনিক ভ্রমণ করেছেন সেখানে তিনি সফল।
"রাস্তাও আদতে এক নারী/ তোমাকে ডাকবেই/ ডেকে নিয়ে ফেলে দেবে তুমুল বিভ্রমে/ না রাস্তা না পথ তুমি কাউকেই পাবে না।"
আবার...
"রাস্তাও মানুষ খোঁজে, সেও জানে/ যে পথে যায় না কেউ, সে পথ কখনো পথ নয়"
অদ্ভুত উপমা। এক মাথা চুলে সিঁথি কাটলেই সিঁথিকাটা হয়ে যায়, ঘাসের জাজিমে কেউ হাঁটলেই পথ বনে যায়। এ এক অমোঘ নিয়ম। এখানে যুক্তির কোনো দুর্বলতা নেই, প্রাণবন্ত দৃষ্টিভঙ্গি এমন এক কোলেরিজকে সামনে নিয়ে এলো নদীর ধীর প্রবাহের মতো। তার কবিতায় "পাবো না জেনেও আমি বারবার রাস্তায় নেমেছি/ এ পথে সে পথে খুঁজেছি এখনো" দ্বন্দ্ব আর তর্কের জগত আচ্ছন্ন করে রাখে এই কবিকে প্রতিনিয়ত। দ্বান্দিকতার নঞর্থক ও সদর্থকের ব্যবহার।
"এক শূন্য থেকে ঢুকে যাচ্ছি/ অসংখ্য শূন্যের মধ্যে/ আর সরে যাচ্ছি ডান দিকে/ ক্রমাগত/ মানে, অন্ধকারে..."
যাইহোক, যা বলছিলাম ছবিটি কে তুললো? আর কেনই বা তোলা হলো? এই কী বা কেন সত্যিই রহস্যময়। জগত ও জীবনের মৌলিক সমস্যাবলীর যৌক্তিক সমাধান ঘিরে থাকে কী বা কেন এর মাঝে। যা ধরার চেষ্টায় নিজেকে সুদীর্ঘ পথ পরিভ্রমণে নিয়োজিত রেখেছেন এই কবি...


 

আগের লেখা পড়তে ক্লিক করুন-

রবীন্দ্রনাথ ও প্রাচ্যবাদ || শরীফ আতিক-উজ-জামান

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র আধুনিকায়নে কাজ করবে জাইকা ও বিএফডিসি
মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র আধুনিকায়নে কাজ করবে জাইকা ও বিএফডিসি
ট্রেনের ৪৫ হাজার টিকিট কিনতে দেড় কোটির বেশি হিট
ট্রেনের ৪৫ হাজার টিকিট কিনতে দেড় কোটির বেশি হিট
নোয়াখালীতে সনি স্মার্ট-এর শোরুম উদ্বোধন
নোয়াখালীতে সনি স্মার্ট-এর শোরুম উদ্বোধন
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের