X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০
সিকদার আমিনুল হকের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

উদ্ভ্রান্ত দিনের মুকুর

শামীম রফিক
১৭ মে ২০১৬, ১২:৫৩আপডেট : ১৭ মে ২০১৬, ১৩:০৭

প্রচ্ছদ : নরোত্তমা সিকদার আমিনুল হকের জন্ম ৬ ডিসেম্বর ১৯৪২। প্রয়াত হন ২০০৩ সালের ১৭ মে। ষাটের দশকের এই কবির বইয়ের সংখ্যা ১৮টির অধিকদূরের কার্নিশ (১৯৭৫), তিন পাপড়ির ফুল (১৯৭৯), আমি সেই ইলেক্ট্রা (১৯৭৯), বহু উপেক্ষায় বহুদিন অনধিকারে (১৯৮২), এক রাত্রি এক ঋতু (১৯৯১), সতত ডানার মানুষ (১৯৯১), সুপ্রভাত হে বারান্দা (১৯৯৩), কাফকার জামা (১৯৯৪), সুলতা আমার এলসা (১৯৯৪), লোরকাকে যেদিন ওরা নিয়ে গেল (১৯৯৭), বিমর্ষ তাতার (২০০২) উল্লেখযোগ্য


 

 

‘অবক্ষয়’ শব্দটি খুব সহজ নয়। সিকদার আমিনুল হক এ কথাটি হয়ত খুব ভাল করেই জানতেন। আর তা জানতেন বলেই বিষয়টিকে তিনি এড়িয়ে যাননি। সৃষ্টিতত্ত্ব ও ধ্বংসতত্ত্ব খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে। সৃষ্টিতত্ত্ব না জানলে অবক্ষয়বাদ সম্পর্কে কোনও ধারণা করা যায় না। সভ্যতার শুরু থেকেই অবক্ষয়বাদের উৎপত্তি। দূরেরকার্নিশ থেকে সিকদার তা পুরোপুরি অবলোকন করেছেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি তা দেখেছেন এবং আমাদেরকে দেখিয়েছেন। আমরা আজও তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তিনি যখন লিখেন:

পেয়েছি নিজের কর, কররেখা ছাড়া
উদ্ভ্রান্ত দিনের মুকুর
বিবস্ত্র সবুজ হ্রদে, পাখির পালকে
উগ্র চিহ্ন দুরন্ত দুপুর।
উচ্চাকাঙ্ক্ষী গাছ ভালোবাসো তুমি
আমি শুধু পূজারী পুকুর।
[নিয়তির কররেখা, দূরের কার্নিশ, ১৯৭৫]

কবি এখানে ‘কররেখা ছাড়া’, ‘ উদ্ভ্রান্ত দিনের মুকুর’, ‘ বিবস্ত্র সবুজ হ্রদ’, ‘ উগ্র চিহ্ন’, ‘দুরন্ত দুপুর’, ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষী গাছ ভালোবাসো তুমি’ এবং ‘আমি শুধু পূজারী পুকুর’ শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত সুনিপুণভাবে। কবিতাটির প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি লাইন, প্রতিটি উপমায় কবির ক্ষোভ, কষ্ট, অভিমান ঝরে পড়েছে। তাঁর কর, কররেখাবিহীন খাঁ খাঁ করছে, তাঁর মন ভাল নেই। অদৃশ্য মানসিক উন্মুখতায় তিনি অবক্ষয়জাড়িত। কোনও রহস্যময় বৈপরীত্য তাঁর চেতনাকে গ্রাস করেছে, যা তিনি প্রতিচিত্র হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন অত্যন্ত সূচারুভাবে। ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষী গাছ’ আর ‘পূজারী পুকুর’ শব্দ দু’টি অস্বাভাবিক প্রকরণে নিমজ্জিত। সিকদার আমিনুল হক চিত্রকল্প এবং উপমাকে প্রেমিকার মতো ভালোবেসে উপস্থাপন করেন যা পাঠকচিত্ত আলোড়িত করে খুব সহজেই। তিনি তৃষিত শাবকের মতো হৃদয়ের অতৃপ্তকে কবিতার ছত্রে ছত্রে গেঁথে নির্মাণ করেন এক মোহনীয় প্রতিমার। নৃসিংহ মুরারি দে তাঁর ‘অবক্ষয়বাদ’ গ্রন্থের প্রাক্কথনে লিখেছেন:

‘মানুষ জন্মগতভাবে অসভ্য। সভ্যতা তাঁর নিজস্ব অর্জন। জ্বর যেমন অস্বাভাবিকতা। অসভ্যতা কিন্তু ঠিক তেমন নয়। অসভ্যতা মানুষের স্বাভাবিকতা। অসভ্যতার অবস্থান অস্বাভাবিকতায়। এই ‘অ’ প্রধান জীবন যাপনের জন্যেই জীবজগতে মানুষ অনন্য, যার কোন বিকল্প নেই। বিকল্পহীনতার জন্যেই মানুষ জীব জগতে শ্রেষ্ঠ। মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ নেই।’

মানুষ যে সভ্যতাকে অর্জন করেছে নিজের চেষ্টায়, তিলে তিলে এবং ধীরে ধীরে। সেই সভ্যতাকে আবার মানুষই ধ্বংস করে নিজের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার প্রয়োজনে। সভ্যতার অপমৃত্যুতে যে অবক্ষয়ের জন্ম হয়, সিকদার আমিনুল হক যেনো সেই কৃৎসিত পরাবাস্তবতার অনুসন্ধান করেছেন স্বীয় বোধের তাগিদে। তাইতো তিনি লিখেন:

আলোর জায়গাটুকু কেন অন্ধকারের তাঁবুতে ঢেকে দিলে? কোন যুক্তিতে এই আত্মত্যাগ?
পুরোহিতের তর্জনীর সামনে নিষ্ফল অভিনয়... একদণ্ডও ভালোলাগে না ঊষর মরুর
বুকে ক্ষণ বিস্মৃতির মরীচিকা। গৃহ তো গৃহ, যেখানে খিলখিল হাসির উৎসব নেই, তাকে কী
ক’রে বেদনার মুকুট পরাবো?
[এই হাত দস্তানার মধ্যে, দূরের কার্নিশ, ১৯৭৫]

শুধু অন্ধকার থাকলে ধরে নেয়া যেতো, আলোর জন্মই হয়নি। কিন্তু এখানে তো আলো ছিল। তবে কেনো এই আত্মত্যাগ? এটা কি শুধুই আত্মত্যাগ নাকি বাধ্যগত বিসর্জন? যদি তাই হবে তবে পুরোহিতের সামনে দাঁড়িয়ে অভিনয়ের কি প্রয়োজন এমন প্রশ্ন তো স্বাভাবিক নিয়মে চলে আসতেই পারে। কবি তো প্রথম স্তবকেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘আমি যদি তখন কোনো চিহ্ন তুলে ধরতুম, তা’হলে তোমাদের চোখে গভীর অবিশ্বাসই ঝলসে উঠতো।’ এটা তো স্পষ্ট মানবিক বিপর্যয়। তাহলে তো সভ্যতার অপমৃত্যু অবশ্যই হয়েছে। এই যে অবক্ষয়, এখানে অসভ্যতা হয়তো নেই কিন্তু বিপর্যয় তো ঘটেছে-ই। সিকদার আমিনুল হক এভাবেই তাঁর কবিতায় অবক্ষয় ও সভ্যতাকে খুঁজে বেড়ান। তাইতো তিনি লিখেন—

মন-ও যথেষ্ট নয়, চাই ধ্যান, চাই পাতা ঝরা,
মাঝে-মাঝে ঝড়ো দিন— সমুদ্রের কর্কশ সাঁতার,
পথে-পথে সরীসৃপ, আকাশের গূঢ় অন্ধকার
হঠাৎ জাগায় ক্লান্তি, পেতে চায় শান্ত পান্থশালা।
[কবিতার দিকে তাকিয়ে কবি, তিন পাপড়ির ফুল,১৯৭৯]

মানব ও সভ্যতার বিকাশমান ধারায় মন-ই যথেষ্ট নয়, তার জন্য গভীর ধ্যানের প্রয়োজন রয়েছে। সভ্যতার সঙ্গে এই মতাদর্শের সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্যও যাই থাকুক না কেনো মতাদর্শের আবর্তে মানুষের নৈতিক চেতনার অবক্ষয় কখনো কখনো জরুরী হয়ে পড়ে। অবক্ষয়জারিত মানুষ শুধু যে ঝরা পাতা, ঝড়ো দিন, কর্কশ সাঁতার বা আকাশের গূঢ় অন্ধকার ঠেলে ঠেলে সভ্যতাকে খুঁজে বেড়ান শুধু তাই নয়। ক্লান্তিতে তিনি শান্ত পান্থশালা চান এবং তার মনও বৈষয়িক ও মানসিক আত্মকেন্দ্রিকতায় নিপতিত হয়। আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে শুরু আত্মনির্ভরতায় সৃষ্ট অবক্ষয় সিকদার আমিনুল হকের চৈতন্যকে গ্রাস করে। তিনি মানুষকে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়ে নিজেও বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। মাঝে মাঝে মুক্তি পেতে চান, ওষ্ঠের সাথে ওষ্ঠের চুম্বন প্রত্যাশী হয়ে সভ্যতাকে আলিঙ্গন করেন নিজস্ব ভঙ্গিতে। ‘আমি স্নাত, আমার ঈশ্বর শুদ্ধ করে দুই তীর— পড়ে থাকে বালি আর বালি।’ এই আকাঙ্ক্ষাও কবির অন্তরে ফল্গুধারার মতো বহমান থাকে এবং তিনি সভ্যতার অন্বেষণে পাড়ি দেন প্রবল স্রোতের সাগর। কেননা তিনি জানেন এই সভ্যতার পতন হলেই সভ্যতাকে গ্রাস করে নিবে অবক্ষয়। কিন্তু কবিমন সর্বদা স্বপ্নে বিভোর, তাই চৈতন্যে ভিড় করে থাকে আবহমান সময়ের বৈরী হাওয়া। তিনি শব্দের সাগরে আকন্ঠ নিমজ্জিত থেকে সভ্যতার জন্য নির্মাণ করেন সংস্কৃতির মাচা। আর তার ওপর সভ্যতার লতানো শরীর বিছিয়ে দিয়ে নির্মাণ করেন কাব্যের মজবুত অট্টালিকা। শব্দের অক্ষরে তিনি চিত্রিত করেন নগর-প্রকৃতির বিচিত্র বাস্তবতা।

মধ্যরাত্রি আকাশের; এই মাত্র ছেড়ে গেলো ট্রেন
পার্বত্য শহর থেকে; কিছু দূরে সমুদ্রের স্বর—
গ্রীস থেকে এসেছিলো, ক্লান্ত হ’য়ে এখন নিথর
জাহাজেরা নিরাশ্রয়, স্তব্ধ তাই অতিকায় ক্রেন।
[চট্টগ্রাম, তিন পাপড়ির ফুল,১৯৭৯]

পার্বত্য শহরের নগর-প্রকৃতির ও নাগরিক চেতনার এক বিমুগ্ধ চিত্র তিনি এঁকেছেন অত্যন্ত সূচারুরূপে। মূলত এই কবিতাটিতে স্থান করে নিয়েছে মধ্যরাত্রির আকাশ, পার্বত্য শহর ছেড়ে যাওয়া ট্টেন, সমুদ্রের স্বর, গ্রীস থেকে ছেড়ে আসা ক্লান্ত জাহাজ, অতিকায় ক্রেন, ভয়াবহ গলি, শকুনেরা কাঁপায় বন্দর, ধর্মের ঘর্ঘর, প্রকৃতির শান্ত ভোজ ইত্যাদি। এখানে সংস্কৃতি ও সভ্যতা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। তাইতো তিনি লিখেন—

নিঃশব্দ বারান্দা থেকে তুমি কি দেখতে চাও জানি;
আমাদের খঞ্জ গলি মেঘভর্তি নর্তকী আকাশ’
যেন বালা সরস্বতী জীবনের আহত ঝিলিক
দিয়ে যায় সুন্দরের হাতে হাতে। যাকেই দেখ না
তুমি, আমি কিন্তু তোমাকেই দেখি, তোমাকে ছাড়া তো
কিছুই দেখি না! সারাক্ষণ তোমার বারান্দা আর
যখন থাক না নিজে, ফ্ল্যাট বাড়িটার প্রৌঢ় ছায়া
গিলে খাই চোখ দিয়ে; আর তুমি আসছো না
[তোমার বারান্দা, পারাবত এই প্রাচীরের শেষ কবিতা, ১৯৮২]

কবিতাটিতে কবি খুব সচেতনভাবেই বাস্তবতার প্রকাশ ঘটান, শুধুই কল্পনাতাড়িত নয়। বরং চেতনায় ও অবচেতন সত্ত্বার স্বার্থক সম্মিলন। তিনি তার বিশ্লেষণে গলিটার খুব জীবন্ত চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। এখানে তার মুন্সিয়ানা আমিত্বের দাবীদার। আর সভ্যতার মূল উৎস তো আমিত্বের মধ্যেই নিহিত থাকে। ‘যাকেই দেখ না তুমি, আমি কিন্তু তোমাকেই দেখি, তোমাকে ছাড়া তো কিছুই দেখি না!’ এই লাইনটির মধ্যেই নিহিত রয়েছে কবির নন্দনচিন্তা। তিনি তাঁর কল্পনার রানীকে খুঁজে না পেলেও বারান্দাকে দেখেন আর এই ফ্ল্যাট বাড়িটার ‘প্রৌঢ় ছায়া’ গিলে খান চোখ দিয়ে। ‘প্রৌঢ় ছায়া’ শব্দটি ব্যবহার করে তিনি তার নিরলস কাব্য সাধনায় প্রতীকী ব্যবহারের মুর্ছনার কথা সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি যেনো যুগ যুগ ধরে এ দৃশ্য অবলোকন করছেন। তিনি শীর্ণ নর্দমায় বেড়ালের চলাফেরা আর দাঁত ভাঙা প্লাস্টিক চিরুনি কুড়ানো ছেলেটাকে দেখেছেন। তিনি মনে করেন কাকের চোখে প্রখর ঘৃণা ঝরে পড়ছে তথাপি অপচয় হয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রেম। তিনি প্রেমের অবক্ষয় দেখেছেন শিশুর বলের মতো ছুটে চলেছে। এমন অবক্ষয় দেখে কবি ক্রমশ গাঢ় হয়ে পড়েছেন। এই বারান্দাকে তিনি দূরবীণের সাথে তুলনা করেছেন। এই দূরবীণে পৃথিবীর সবকিছু স্পষ্ট হলেও কবির কল্পনার রানী অস্পষ্ট হয়ে অধরাই থেকে গেলেন। কবিতাটির শেষ চরণে তিনি যে কাব্যিকতা করেছেন তা পাঠক মাত্রকেই নাড়া দিয়ে যায়। বাস্তব ও কল্পনার সম্মিলনে এমন মিথস্ক্রিয়ার ব্যবহার বাংলাকাব্যে খুবই বিরল। আবার কবি শামসুর রাহমানের মতো নাগরিকতাও তাঁর কবিতার শরীরে নানা ব্যাঞ্জনার সৃষ্টি করেছে। যেমন—

রাত্রি মানে তারপাশা, থমথমে দোকান পসারী,
জনপদ নিদ্রামগ্ন যতবার এই পথে আসি—
অন্যদিকে নাগরিক অহঙ্কার যান্ত্রিক ঘর্ষণে
কাঁপায় আদিম রাত্রি, রুক্ষ বাল্ব, ধাতুর আঘাতে।
সচকিত তারপাশা; টলে ওঠে সুপ্তি, সান্ত্বনা
যাত্রীদের পদশব্দে— তীব্রগন্ধ কয়লার দম্ভ
অন্ধকারে রেখে যায় আধঘন্টা বর্বর তামাশা।
[রাত্রির তারপাশা, পারাবত এই প্রাচীরের শেষ ঠিকানা, ১৯৮২]

বস্তুত তাঁর কবিতাতেই ঠাঁই পেয়েছে নাগরিক চেতনা আর নগর-প্রকৃতির নানা পরা-বাস্তবতা। ইন্দ্রিয়ঘন পরাবাস্তবতার যে কাব্যিক বিন্যাস তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন কবিতাটির শরীরে তা আমাদের চেতনাকে আক্রান্ত করে প্রবলভাবে। ব্যক্তি, সমাজ, রাজনীতি, সংসার, শিল্প-সাহিত্য, শিক্ষার মতো উপাদানগুলো যখন অবক্ষয়ের করালগ্রাসে আক্রান্ত হয় তখন কবিমন ব্যথিত হয়। মধ্যরাতের তারপাশা কবিকে স্পর্শ করে, তিনি জাহাজের ডেকের উপর পদশব্দ আর রাতজাগা দীর্ঘশ্বাস শুনতে পান। তিনি ক্রোধমত্ত পদ্মার আক্রোশে পাড় ভাঙার শব্দ শুনতে পান আর দূর গ্রামে কুকুরের পদচারনা। নাগরিক বিষাদ আর হতাশাঘেরা অবক্ষয় কবিতার শরীরে নাগরিক চেতনার নিস্তরঙ্গ প্রভাব ফেলেছে। রোমান্টিক কবিতার ক্ষেত্রেও কবি সিকদার আমিনুল হক নিবিড় চর্চা আর কঠিন সাধনায় একটা জগত সৃষ্টি করেছেন। যেমন—

তোমাকে খুঁজতে আসি এলোমেলো সোনালি আড্ডায়
আর তুমি লতাগুল্ম, জাননা তো প্রতীক্ষার অর্থ;
যেহেতু এখনো তুমি হলুদ কলঙ্ক মেখে ব’সে আছো
স্যাঁতস্যাঁতে নিরালায়। কিংবা তুমি মজা পুকুরের
কচুরি পানার মতো রুদ্ধশ্বাস নিস্প্রাণ সবুজ;
প্রখর সূর্যের তাপ প্রগাঢ় হয়নি কোনদিন
অন্তরঙ্গ ঠোঁটে, স্তনে; রয়েছো শৈশব থেকে শুধু
মেঘের আড়ালে খাপছাড়া জ্বরতপ্ত নিরুপায় একা।
[তোমাকে বাঁচাতে আসি, পারাবত এই প্রাচীরের শেষ ঠিকানা, ১৯৮২]

কিন্তু সেখানেও তিনি হতাশার বা অবক্ষয়ের গন্ধ খুঁজে পান। কবি কাকে খুঁজতে আসেন কিন্তু তা এলোমেলো আড্ডায় কেনো? আর কেনো-ই বা সে লতাগুল্ম হয়ে প্রতীক্ষার অর্থ খুঁজে পায় না? হলুদ কলঙ্ক মেখে সে তো স্যাঁতস্যাঁতে নিরালায় বসে আছে কিংবা মজা পুকুরের কচুরি পানার মতো নিস্প্রাণ সবুজ। তাহলে এখানে তো অবক্ষয় সুষ্পষ্ট। আয়নায় নিজের মুখ আর শ্বেতবর্ণ চুল দেখে বিষ্মিত হন। নানাভাবে তা আড়ালের ব্যর্থ চেষ্টা করেন যদিও এই রুক্ষ বাস্তবতার অর্থ তিনি জানেন। সবকিছু জেনেও ভালোবাসার গভীর আবেগে তিনি নিজেকে বিষ্ফারিত করেন। বিষাদ, হতাশা আর ক্লান্তি তাকে রোমান্টিক কবিদের মতো আচ্ছন্ন করে রাখে। তিনি জানেন কোন ভাবাবেগে প্রেমের কবিতাকে নান্দনিক করে তুলতে হয়, তুলে আনতে হয় অবক্ষয়ের দ্বারপ্রান্ত থেকে মোহনীয় লোকালয়ে। ‘বাঘিনীর প্রেম’ কবিতায় তিনি লিখেন—

দারুণ ঠুনকো সখে আবর্জনা বাড়ে
জড়ো করি যতো,
পতঙ্গ লুকোয় ঘাসে, তুমি অন্য ঘরে
অন্যদের মতো।
[বাঘিনীর প্রেম, বহুদিন উপেক্ষায় বহুদিন অন্ধকারে, ১৯৮৭]

মানুষের মনোবিশ্বের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম ও স্পর্শকাতর অংশের নাম প্রেম বা ভালোবাসা, যা এই কবিতায় অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছে। কবি বুকভরা মান্ধাতার আশা নিয়ে নষ্ট বিবেচনায় বিভোর। ভালোবাসার অবক্ষয় থেকেই তো তিনি বলেছেন প্রেমে পড়ে নির্ঘাত পতন। তবুও মোহ ক্রীতদাসের মতো আমাদেরকে কামনাতাড়িত করে প্রতিনিয়ত। এইরকম ঠুনকো সখে শুধু আবর্জনা বাড়ে। বস্তুত সবাই স্বার্থপরের মতো প্রয়োজন ফুরুলে কেটে পড়ে। যখন তিনি লিখেন—

রেখে দাও। প্রৌঢ়ের বিলাস নিদ্রা, আর কিছু নয়।
কেন আনো জঙ্ঘা, জানু; ক্যাভিয়ার, তীব্র লাল মদ
শরীর নেয় না আর! বরঞ্চ পিচ্ছিল করে দাও।

হতাশার পথ, ম্রিয়মান বেলা, হাঁটুর পতন—
আমি নই ব্যতিক্রম, মরত্বের অভিপ্রায় জানি;
বাঁচাই অশ্লীল কাজ— শাপভ্রষ্ট পেতে চাই ছুটি।
[সম্পর্কের ছুটি, বহুদিন উপেক্ষায় বহুদিন অন্ধকারে, ১৯৮৭]

কবি সিকদার আমিনুল হক তাঁর প্রেমের কবিতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমন সব হতাশার চিহ্ন এঁকে দেন যা তাঁর হৃদয়ের অনভূতি প্রসূত চেতনার ফসল। প্রেমের ক্ষেত্রে আবেগের আতিশয্যকে আধুনিকতা আর বাস্তবতার মোড়কে ঢেকে জঙ্ঘা, জানু, ক্যাভিয়ার, লাল মদ ইত্যাদি উপমার অবতারনা করেন। ‘শরীর নেয় না আর’ লাইনটির পর ‘বরঞ্চ পিচ্ছিল করে দাও’ লাইনটি দুটি বিপরীতমুখী চেতনার সৃষ্টি করে কবির সৌন্দর্য্যবোধকে আমাদের সামনে সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি হতাশা ও অবক্ষয়ে নিপতিত সত্ত্বেও অমরত্বের অভিপ্রায় সম্পর্কে সচেতন। ‘বাঁচাই অশ্লীল কাজ-শাপভ্রষ্ট পেতে চাই ছুটি’ লাইনটির মাধ্যমে কতটা বিপরীতমুখী বাস্তবতাসমৃদ্ধ দার্শনিকতা এক সরলরেখায় এসে একীভূত হয়েছে কবির মননভূমিতে তার অপরূপ চিত্র বিনির্মিত হয়েছে। তিনি যখন লিখেন—

কী যে হয়, আর কি যে করি! থাকি নিজ ঘরে। নষ্ট
জাহাজ অথবা কোন ম্লেচ্ছ দ্বীপ হ’লে কি আমাকে
পোড়াতো এভাবে আয়ু ক্ষয় ক’রে? সারাদিন মিত্র
সমুদ্রের তীরে বসে দেখতাম নারিকেল বীথি—
সোনালি কাঁকড়া আর গাঙচিল। কাঁচা মাছ খেয়ে
ঘুমোতাম মনুষ্যত্বে— রাত্রিবেলা অমর পৌরুষে
ছুটতো আমার ঘোড়া অভ্যন্তরে। গুহায় সাজানো
বনমোরগের মাংস, জলপাই, সতেজ ডুমুরে
ক্ষুন্নিবৃত্তি মিটে যেতো; বস্তুত হতাম সুখীজন।
আর আজ সভ্যতার মঞ্চে বিশ্রী পাহারা বসিয়ে
ট্রাউজার পরে ঘোরে চৌরাস্তার টেরিকাটা মাথা
আপিসের ক্লিন্সেভ, ক্লাব-প্রাণ অশ্লীল মাস্তান।
[দিনগত পাপক্ষয়, পাত্রে তুমি প্রতিদিন জল, ১৯৮৭]
কালের বিবর্তনে মানুষের আত্মপ্রকাশের শুরু থেকেই সে গভীর চেতনার অধিকারী। কেবলমাত্র চেতনসত্ত্বার কারণেই মানুষ জীবজগতে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করে আছে। চেতনাকে ধারণ করে এবং শুধুমাত্র সাধনাকে কাজে লাগিয়ে মানুষ দিনে পর দিন পৌঁছে যাচ্ছে সভ্যতার সুউচ্চ শিখরে এবং চরিতার্থ করছে তার আশা-আকাঙ্খার, কামনা-বাসনার ও চিন্তা-ভাবনার। তিনি আক্ষেপ করেছেন, কেননা তিনি স্বজ্ঞানে নিজের আয়ু ক্ষয়কে অবলোকন করছেন। তিনি তো মিত্র সমুদ্রের তীরে বসে সুখীজন হতে পারতেন কিন্তু আজ তাঁকে বিশ্রী রকম পাহারায় রেখেছে ক্লাব-প্রাণ অশ্লীল মাস্তান। নাগরিক সভ্যতার বিস্তারে তিনি অস্বস্তিবোধ করছেন। সার্কাসের ভাঁড়ের মতো লোকেরা যতই লোক হাসাক বা সুস্থতার অভিনয় করুক না কেনো কবি তাতে বিচলিত নন মোটেও। তাই তো তিনি লিখেন—

বাড়ি ফিরে নৈশ আহারের পালা। তারপর যেই
নিশিথ সঙ্গম শেষ
হাতে থাকে দীর্ঘ রাত্রি, নিথর নিঃশব্দ এক ঘর—
যেখানে তোমার ছায়া, যার নাম মৃত্যুভয়। তাকে
ইদানীং বেশ কাছাকাছি দেখি। এমন কি তার
অস্থিচর্মসার দেহ, ঝড়ের সঙ্গীত
আমাকে ফাঁপরে ফ্যালে। কলপের আত্মছলনায়
যায় কি বার্ধক্য আর তার অপরাধ?
ফলে বেশ মুষড়ে পড়ি। যকৃৎ ঠকিয়ে
করেছি অনেক পান, তার পরিণামে
এ— জীবন প্রকৃতই মাঝিমাল্লাহীন;
চোখে পড়ে ঘুনে ধরা
অসুখী মাস্তুল আর জীর্ণ জাহাজের ভাঙা খোল।
[যে-ভাবেছিলেন রিল্কে, এক রাত্রি এক ঋতু, ১৯৯১]

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কবি অভ্যস্ত রুটিন জীবনের বাইরে অন্য এক প্রভাব কবির চেতনাকে তাড়িত করছে। হতাশা এবং মৃত্যুচিন্তা সিকদার আমিনুল হকের লেখার এক প্রধান অনুষঙ্গ। বাহ্যজগতের স্পর্শে এবং মননবিশ্বের সমন্বিত সংরাগে কবির চেতনজগত ভীষণ রকমভাবে উদ্বেলিত মৃত্যুনামক প্রকৃতিগত পরাবাস্তবতায়। মানুষ প্রকৃতির অংশ হওয়ার ফলে অস্তিত্বের প্রয়োজনে, নৈতিকতার তাগিদে বা সামাজিকতার প্রয়োজনে যতকিছুই করুক না কেনো প্রকৃতির নিয়ম তাকে মানতেই হবে। তিনি আবেগতাড়িত হয়ে বার্ধক্যকে অপরাধ বলে মনে করছেন। অনুপেক্ষণীয় মৃত্যুকে তিনি খুব কাছে দেখতে পেয়ে বিচলিত হয়ে পড়েছেন। তাই তিনি আত্মদহনে নিজেকে নানারকমভাবে অপরাধী মনে করছেন। অথচ এ রকম ছিল না তার জীবন। জীবনে অনেক কিছু ছিল। নারী, প্রেম, প্রভাব, প্রতিপত্তি, সচ্ছলতা ও সফলতা সবকিছুই ছিল। কিন্তু এখন সবকিছু শেষ মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে কিছুই নেই। এক নীলাভ ঘুম তাকে নীলিমায় ডাকছে। মৃত্যুভয় তাকে মানসিক অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মৃত্যুকে নিয়ে সিকদার আমিনুল হক যতরকম ফর্ম তৈরি করেছেন বাংলা কাব্যে তা সত্যিই বিরল। তিনি যখন লিখেন—
মৃত্যুর বিরক্ত কান্না শোনার আগে আমি শুনছি তোমার বুকের স্পন্দন। শুনতেই হবে,
যেহেতু বর্ষা অনেক লাবণ্যময়; আর ইলিশগুলি শাদা ঐশ্বর্যের! তুমি দিয়েছো গোড়ালি
থেকে বুকের মাধুর্য পর্যন্ত একটি অবিমিশ্র মাদকতা।— অনুগ্রহ নয়, দান ফেলবার জন্যে
তুমি পেতে দিয়েছো তোমার সমস্ত গৌরব।
[সতত ডানার মানুষ, সতত ডানার মানুষ, ১৯৯১]
কবিতাটির প্রতি পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে মৃত্যু এবং মৃত্যুর ভয়াল অনুষঙ্গের ছোঁয়া। তিনি মনে করেন পৃথিবীতে মৃতের গল্পই বেশি। মৃত্যুর মুচলেকা দিয়েই তো প্রতিটা মানুষকে এই পৃথিবীর পাসপোর্ট নিতে হয়। তাই এই ভয়াল সত্যকে উপেক্ষা করার সাধ্য কারো নেই। কবি সিকদার আমিনুল হকেরও নেই। তিনি মনে করেন আমরা যে দস্তানা পরে আছি, তাও একজন মৃতেরই রেখে যাওয়া। দৈহিক অবক্ষয় মানুষকে ধীরে ধীরে মানসিক অবক্ষয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায় এবং প্রতিটা মানুষ অবধারিত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এ থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই। এটাই কবির মানসিক অশান্তির মূল কারণ। তিনি যখন লিখেন—

ঘুমিয়ে কাটলো বেলা; যেই শুরু হ’লো ফের রাত্রি
দেখি দূরে পর্বত আবার—
ক্রমশ বড়ই হ’চ্ছে, যত নিচ্ছি চামড়ার গন্ধ
উপচে পড়ে আমার খাবার।

সকল দিকেই আলো, এত ফর্সা, সাতদিকে শাদা
তাইতো আদর করি চুল...
কিছু ত্রুটি ভাল লাগে!...স্বাস্থ্য, আয়ু কতদিন আর?
চেটে খাবো অতীতের ভুল।

স্মৃতির সম্বল জল বাষ্প হ’য়ে ওড়েনা আকাশে
থাকে শুধু লেহনের তৃষ্ণা—
হে নগ্ন, এখানে আয়, সিল্কগুলি পরাবো সকালে
অকারণ যাতনা দিস্না!
[এখানে আয়, সুলতা আমার এলসা, ১৯৯৪]

সিকদার আমিনুল হকের কবিতায় ভাষাবিন্যাস, উপমায়ণ, গঠনশৈলি সময়ের আবহে মাধুর্যমন্ডিত। অবহেলায় হারিয়ে ফেলা সময়কে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। এখানে কবি অবক্ষয়িত সময়ের বিরূপ সময়কে সুচারুরূপে বর্ণনা করেছেন। কবির সময় চেতনা কবিতাটিকে ভিন্নরূপে অলংকৃত করেছে। সমকালের নানা দৃশ্যচিত্রের কাব্যিক বর্ণনায় জীবন্ত হয়ে ওঠেছে কবির আত্মক্ষয়ের কদর্যরূপ। তিনি দেখতে পাচ্ছেন তাঁর সামনে বাঁধার পাহাড় হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সে পর্বত ক্রমশ বড়ই হচ্ছে, কেননা কবি অবহেলায় নষ্ট করছিলেন মহামূল্যবান সময়। কিন্তু তাঁর সকলদিক আলোকি বলে কিছু ত্রুটিও তাকে আর আত্মপীড়নে ভোগাচ্ছে না। তবুও তার মনে পড়ে এই স্বাস্থ্য আর আয়ু ক্ষণকালের। যদিও তিনি শুধু একা নন আমরা সকলেই অতীতের ভুলগুলিকে বিস্তৃত করি। স্মৃতিকে যতই সম্বল ভাবা হউক না কেন সে তো শুধু অতীতের কষ্টকেই দীর্ঘায়ু করে। নগ্নকে সিল্ক পরাবার বাসনা নিয়ে অকারণ দ্বন্দ্বময় যন্ত্রণাকে এড়িয়ে চলেন। মানুষের বিস্ময়কর আচরণ কি রকম রহস্যের মায়াজাল বিস্তৃত করে তা সিকদার আমিনুল হক নানা দৃশ্যকল্পের মাধ্যমে দেখিয়েছেন সিদ্ধহস্তে।

মানুষই তো মানুষ সৃষ্ট সভ্যতাকে ধ্বংসের জন্য দায়ী। যে কোনো অবক্ষয়ের পেছনেই কাজ করে দুটি নিয়ামক : ব্যক্তি ও সময়। এই দুয়ের সমন্বয় না হলে অবক্ষয় বা সভ্যতা কোনটাই হবে না। প্রাকৃতিক অবক্ষয় যেমন আছে সামাজিক অবক্ষয়ও আছে। প্রাকৃতিক অবক্ষয় যেমন— ভূমিকম্প, দাবানল, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, আগ্নেয়গিরির দাবানল, সুনামি ইত্যাদি তেমনি আত্মিক অবক্ষয় হলো— লালসা, ইপ্সা, লোভ, উচ্চাশা, তিতিক্ষা, ভিক্ষা, ক্ষমতা, হতাশা, হত্যা, রাহাজানি, ধর্ষণ ইত্যাদি। তিনি যখন লিখেন—

দাঁড়াই নিজের জোরে, জ্বর নেই, আজ ভালো আছি।
একা একা হেঁটে যাই, বাতাস বেয়াড়া ষোল স্ট্রীটে;
নির্দিষ্ট যাচ্ছি না কোনখানে, দ্বিপ্রহর বলা যায়..
ছায়াচ্ছন্ন হ’য়ে আসে দুপুরেই। কারণ কি এতো
হাইরাইজের ঘটা, কিংবা কালো মার্বেলের রোগ
এদের করেছে রুগ্ন, ম্যানহাটানেই প্রধানত।
আজ আর ম্যাক্ডোনাল্ডের লাল-সুন্দরীর পাশে
নয়। ভিন্ন কোন রেস্তোরাঁয়। চুপচাপ ব’সে খাবো।
[সেপ্টেম্বর ভোর, রুমালের আলো ও অন্যান্য কবিতা, ১৯৯৫]

মানুষ তো নিজের জোরেই দাঁড়ায়। কিন্তু তবুও কবির কেন এই আত্ম-আর্তি? মানুষ মাত্রেরই চেতনায় দ্বন্দ্ব আছে, স্বত্ত্বারও আছে দ্বৈততা। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য যেমন অভ্যন্তরীন আর্তি তেমনি বাহ্যিক চেতনা তাড়িত হতাশা, ক্লান্তি, বিরূপতা, অতৃপ্তি, অহংকার, বিমর্ষতা এবং হাহাকার মানুষ প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। মানুষ নিঃসঙ্গ হয়ে যায় নিজের কাছেই, তাইতো একা একা হেঁটে যায় বেয়াড়া ষোল স্ট্রীটে। কিন্তু এই যাত্রা যেনো যাত্রা নয় কবির কাছে, তিনি কোনোখানেই যাচ্ছেন না। তিনি দুপুরেই ছায়চ্ছন্ন হয়ে পড়েন, প্রচণ্ড ক্লান্তি তাঁকে গ্রাস করে। তাহলে কেনো এতো হাইরাইজ বা কালো মার্বেলের ঘটা? যে জীবনের এত ক্লান্তি, এত হতাশা তার জন্য এত আয়োজন কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু এই হাতাশা পীড়নের মধ্যে উত্তরণের দ্বন্দ্ব-পীড়িত তাগিদ তাঁকে বিবমিষ করে তোলে, চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। তবুও তিনি কিছুক্ষণ ঘোরার তাগিদ অনুভব করেন। একাকীত্ব নেশার চেয়ে প্রিয় হয়ে ওঠে। তাঁর চিত্ত স্মৃতিবিভোর হয়ে ঘোরে আসে স্বদেশের নর্দমার ক্বাথ আর বস্তি। কিন্তু তিনি আগন্তুক ঐশ্বর্যবানদের মতো উন্মুক্ত রাস্তায় সরব হয়ে ওঠতে পারেন না। তিনি জানেন এই শহরের কোথাও তিনি স্মৃতিস্বর নন, খ্যাতিমান নন, নন তথাকথিত যশস্বী। অথচ চাটুকার কিভাবে ওঠে যান খ্যাতির সুউচ্চ শিখরে। তাদের বাহারী পোশাকের আচরণ তাঁর কাছে দারিদ্র্যের কপটতা বলে মনে হয়। তিনি ভোটের বাক্সে দরিদ্র কৃষকের কান্না শুনতে পান। রোজ রাতে ঘাতকের সচকিত চীৎকারে তিনি শিউরে ওঠেন। তিনি অপরূপ বর্ণনায় এবং নান্দনিক উপস্থাপনার সৌকর্যে যে সব উপমা ব্যবহার করেছেন তা হৃদয়কে স্পর্শ করে অজান্তেই। সিকদার আমিনুল হকের আত্মিক সভ্যতা আমাদের প্রাত্যহিক অবক্ষয়কে অঙ্গুলি নির্দেশ করে যাত্রা করেছে নিরুদ্দেশ অন্ধ-যাত্রা। তিনি যখন লিখেন—

এক গ্লাস থেকে অন্য এক গ্লাস। আর মনে নেই
শরীরের সব রন্ধ্রে বাতি জ্বলে। যেই রাত্রি গাঢ়;
এসেছে উটের গলা। কালো তিমি। বিকট ডাইনী।
...অথচ সবাই বলে, এই ঘুম কাফ্রিরা ঘুমায়

রাত্রির একান্ত কক্ষে। তাঁবুর ভেতর দেখা যায়
বেদেনীর এই ঘুম। কিন্তু আমি কোন্ শাস্ত্রমতে
ঘুমিয়ে লেহন করি নীলিমাকে? যার নীচে নেই
জলপাই বন, ভেনিসের নারী, নিরিবিলি হ্রদ।
[আর্ত সময়ের কথা, লোর্কাকে যেদিন ওরা নিয়ে গেলো, ১৯৯৭]

কবি সিকদার আমিনুল হকের কবিতায় আমরা বোধের অনুভূতিশীল শব্দ প্রয়োগ, নান্দনিক বাকাংশের উপস্থাপনা আর নৈঃসাঙ্গিক নিষ্ক্রিয়তার যৌাগিক উপপদ খুঁজে পাই। ‘এক গ্লাস থেকে অন্য এক গ্লাস। আর মনে নেই শরীরের সব রন্ধ্রে বাতি জ্বলে।’ কবিতার জন্য আর তো কোনকিছুর প্রয়োজন নেই। এই একটি লাইনে আর কি নেই? বোধের এমন বিলোড়ন, এমন অভিপ্রায় আত্মিক চেতনায় বৈকল্যের নান্দনিক সভ্যতা তৈরি করে। কিন্তু ঠিক পরের কয়েকটা লাইনে যেমন উপমা তিনি বিচ্ছুরিত করেছেন তা তো চেতন বিশ্বের আকাশে স্বপ্নের রংধনু সৃষ্টি করে। ‘যেই রাত্রি গাঢ়’, ‘এসেছে উটের গলা’, ‘কালো তিমি’, ‘বিকট ডাইনী’ উপমাগুলো যন্ত্রণাদগ্ধ কবি মনের উন্মথিত অস্থিরতাকে বিধৃত করে। এই যন্ত্রণা তাঁকে অবক্ষয়ের করালগ্রাস থেকে তুলে এনে রাত্রির নিঃসঙ্গ ঘরে বন্ধী করে দেয়। কিন্তু তিনি তবুও নীলিমাকে লেহন করবার মতো স্বার্থপর হয়ে ওঠেননি। তিনি মনে করেন অবক্ষয়বাদকে জানবার প্রয়োজন এসেছে। নতুবা মানুষের শ্রমে-ঘামে আর সাধনায় তিল তিল করে গড়ে তোলা সভ্যতা অবক্ষয়ের ভয়াল থাবায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তাই তো তিনি লিখেন—

ভয় নেই
আমার জন্যে আর তোমাকে খুব বেশিদিন
এমন দাঁতাল ভঙ্গিতে হাঁটু মুড়ে বসে থাকতে হ’বে না!

চুম্বনের প্রিয় ঠোঁটগুলি যেদিন থেকে বিরল হ’য়ে ওঠে
যখন সেচ্ছায় আর কেউ ব্লাউজ খুলে বুকের নরম হ্রদে
হাত রাখতে বলে না...
[খুব বেশিদিন অপেক্ষায় রাখবো না, অগ্রন্থিত]

স্বার্থের সংঘাত আর স্বার্থঘটিত নানা বিরোধের মধ্য দিয়ে যেমন সভ্যতার ইতিহাস বিকাশমানতা লাভ করে, তেমনি আত্মিক দাবদাহের মধ্য দিয়ে মানুষের স্বার্থ বেড়ে ওঠে বিকাশমানতা লাভের প্রত্যাশায়। কবি ‘ভয় নেই’ বলে কাকে আশ্বস্ত করছেন? তিনি অনুভব করেন চুম্বনের প্রিয় ঠোঁটগুলো আগের মতো সহজলভ্য নয়, একটা দুরত্ব এবং সমূহ একাকীত্বও তাকে আগলে ধরে। সংসার বা সম্পদ ক্ষণস্থায়ী এই চরম সত্যটি তিনি উপলব্ধি করেন জীবনের শেষ পাতায় এসে। তাই তো তিনি লিখেন, ‘অসতর্ক আমি নই, আমি বুঝতে পারি’। তিনি মনে করেন তাকে নিশ্চিহ্ন করার কৌশল ভয়ংকর কিছু নয়। এটাই যেনো স্বাভাবিক। ‘তুমি স্বভাবতই ক্ষুধার্ত’— তিনি এখানে কাকে ক্ষুধার্ত বলেছেন? সে কেনো স্বার্থপর হয়ে ওঠলো এবং তাকে নিশ্চিহ্ন করার প্রবল ক্ষুধায় উন্মত্ত হয়ে ওঠেছে? এটা কি তাঁর মনের অবক্ষয়িত রূপ নাকি অবক্ষয়ের অন্ধকার-অসভ্য রূপ? নাকি লালসা নামক মানুষের আত্মিক অবক্ষয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির পথের প্রধান বাঁধা হয়ে আপাদমস্তক গ্রাস করে ফেলেছে? কবি সিকদার আমিনুল হক বুকের নিভৃতে স্বযত্নে লালন করা সভ্যতা নিয়ে পারিপার্শ্বিকতাকে উপেক্ষা করলেও তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি চারিদিক থেকে ছুটে আসা অবক্ষয়ের প্রবাহমানতা থেকে।


 

সিকদার আমিনুল হকের কবিতা


অতি প্রগলভ শতাব্দীর কবিতা

কবিতাকে থাকতে দাও একা, অস্পষ্ট আর পরস্ত্রীর মতো পবিত্র। মানুষের হাত, সে স্বচ্ছন্দে নামুক পাতালের নিচে, অন্ধকারে। পাল তোলার জন্যে কবজির জোর এবং পাহাড়ে ওঠর জন্যে শক্ত গোড়ালি এখনো দরকার।

কবিতা সে থাকুক কামনাদাত্রীর ওষ্ঠে, বগলের নিচের ছোটো অন্ধকার, এবং যার প্রণয়িনী নেই, পানশালায় তার শেষ পাত্রে।

কবিতা উজ্জ্বল হও। তুমি বাঁচো। এবং সুবিশাল নারীর প্রশস্ত নিতম্বের মতো দায়িত্ববোধে আবৃত হও!….

মানুষকে তর্ক করতে দাও। জুয়াখেলার ক্রুটি নিয়ে সে চালাক ছুরি। তার পথ ছেড়ে দাও। সমুদ্র আর বালির দ্বীপ তাকে ডাকে। আসবাবের বার্নিশ তাকে দিক আত্মবিশ্বাস! গণিকার প্রণয়সংগীতে সে টুকরো টুকরো করুক তার শৈশব স্মৃতি…

কিন্তু কবিতা, তুমি তো সম্রাট! তোমাকে নিয়ে গল্প করবে ক্ষতবিক্ষত সৈনিক, যারা তোমাকে দ্যাখে না। তুমি সেই কিশোরীর অন্তর্বাস, বৃদ্ধেরা যার রং পর্যন্ত আঁচ করতে পারে না। বেতের চেয়ারে বসে যারা কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

কবিতা তুমি ওঠে! অগ্নিশিখা আর ক্রোধের মতো। পশুর মতো তোমার গর্জন। গুম্ফার সন্ধ্যার মতো তুমি সমগ্র হও। এবং বিষন্ন, কবরের গোলাপের মতো।

এবং যে-নারী প্রায়শ প্রতারণা করে, তার মতো তুমি সমস্ত রাত্রির জন্যে কামার্ত হও…!

(অংশ)

 

বিষাদে সম্পাদিত এই গ্রহ

তোমার চায়ের কাপে রয়েছে আমার ভাবনা, যখন আমি টেবিলের এ-পাশে। তোমার দাঁতে ফলের খোসার লাল টুকরো। কিছুক্ষণ পরে চুমু খেলে যার মালিক হবো আমি; আর সারা রাত্রি স্মরণ করবো তোমার ঘন দমবন্ধ করা তিরষ্কারের নিশ্বাস।

তুমি কী ভাবছো আমি জানি। এক নতুন অশান্তির কথা। আরেকটি নতুন প্রেম, আরেকজন পুরুষের ঘন কালো চুল, আলুথালু আদর, অন্য ধরনের আলিঙ্গন এবং সবশেষে অনির্বচনীয় অধৈর্য্য উত্তেজনা!

তারপর সেই-ই বিতৃষ্ণা, সেই ক্রোধ, পার্কে বসে নখর-শাসানো তর্ক। তৃষ্ণা মিটবার আগেই যথারীতি প্রেমের মৃত্যু হয়। আগে পুরুষের এবং চিরকাল আলিঙ্গন শেষ হওয়ার সাথে সাথেই নারীর। অবিশ্বাস্য, তবু মৃত্যু হয় বন্ধুত্বের এবং স্মৃতিরও।

চামচ দিয়ে তুমি অদৃশ্য দাগ কাটছো টেবিলে; দেখতে পাচ্ছো পর পর এই ছবি। জীবনের। প্রেমের চিরকালের খাটুনির আগে মেয়েরা যেভাবে ভাবে, তার অতিরিক্ত তোমার এক কণাও বেশি মেধা আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না।

আমি শুধু অপেক্ষা করি। রেস্তোরাঁর বাইরে চাঁদের জন্যে রাতের পরিচারিকার বা নার্সের অপেক্ষার মতো। প্রসূতির প্রথম সন্তানের মুখে প্রথম চুম্বন খাওয়ার মতো।

(অংশ)

 

সুপ্রভাত হে বারান্দা

সুপ্রভাত, হে বারান্দা!… দেখলে তো কবি বেঁচে আছে।
পাদরিও চায় না মরে। খাদ্যগুণ, শর্করার ছলে
রোজ ধর্ম-কর্ম খায় একদলা!… কাল মাঝরাতে
দেখেছি অদ্ভুত স্বপ্ন। এক হ্রদে, আমার নৌকায়
আমি চার-জোড়া রূপসীকে পেয়েছি একাই!
গায়িকা মেয়েটি ছোটো, দেহ-মিলনের মতো নয়;
তবে পৃথুলার গন্ধ বেশ সুস্থ!… স্তন ভালো যার
ডেনিশ মেয়েটি হাসে,… ‘তা হলে কোথায় চললাম?’
কেন জাহান্নামে!- শোনো খুকি, গীতা পড়ো নাই বুঝি?
আমরা করবো কাজ, ফল আছে ঈশ্বরের হাতে!

সুপ্রভাত, হে বারান্দা!… দেখলে তো আজও স্বপ্ন দেখি।
শীতের রাত্রির ক্রুটি, মৃত্যু আসে; নিরক্ষর ভূত-
বিছানাটা ছোটো হয়, বেশ ঠান্ডা, কবরের মতো।
তখন খুলতে থাকে কলকব্জা, শরীরের খিল;
আজকাল বিড়ালেরা চলে যায়!… রোজ দুধ দিতে
পাঁচটি টাকার কম লাগে না তো? পেনশন শেষ।
একা জন্মাবার ভুল সকলের, তাই থাকি একা!
তথাপি ভোরেই উঠি!… খাসা! সুপ্রভাত, হে বারান্দা!
ইঁদুরের মতো নয়, ফ্লানেলের সস্তা জামাটায়
দেখলে কেমন ঘুম ঘুমালাম, গতকাল রাতে?

 

মধ্যবয়স্কা কাউকে যখন চিঠি লিখি

তোমার কাছেই চিঠি লিখছি এখন;
এই একমাত্র খবরের শেষে আর অতিরিক্ত নেই।
তুমি সুন্দর। অনেকখানি পাওয়া যায় একসঙ্গে।
সমস্তটা আমার হলে একসঙ্গে কিছুক্ষণের জন্যে
কে আর কবর, বিচ্ছেদ এসব বিশ্বাস করে!
চিঠি লিখছি আলোয় অথচ অন্ধকারের গন্ধ পাচ্ছি!

মেদ কি অন্ধকার? মাংস কি অন্ধকার? সব গহ্বর কি,
অন্ধকার?— নাকি বসন্ত বলেই আমি আজ এত কামার্ত!
চিঠি তো লিখছি না, যেন বাতাসে উড়তে উড়তে সংগম করছি।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
তাইওয়ানে সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রের
তাইওয়ানে সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রের
নারীবান্ধব টয়লেট সুবিধা পান না ৯৩ শতাংশ নারী
জরিপের তথ্যনারীবান্ধব টয়লেট সুবিধা পান না ৯৩ শতাংশ নারী
সিলেট নগরীতে অপরাধী শনাক্তে ১১০ সিসি ক্যামেরা
সিলেট নগরীতে অপরাধী শনাক্তে ১১০ সিসি ক্যামেরা
সমরাস্ত্র প্রদর্শনীতে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির পণ্য
সমরাস্ত্র প্রদর্শনীতে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির পণ্য
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা